চট্টগ্রাম বন্দরকে বিদেশিদের হাতে দেওয়ার তোড়জোড় আবারও শুরু 

অনলাইন ডেস্ক: দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের দেওয়ার তোড়জোড় শুরু করেছিল বিগত সরকার। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) অথরিটির মতো প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়েছিল এজন্য। বিনা প্রতিযোগিতায় ইতিমধ্যে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) বিদেশিদের দিয়ে দেওয়া হয়েছে। বন্দরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) বিদেশিদের দিয়ে দেওয়ার জন্য আবারও তোড়জোড় শুরু হয়েছে।

পিপিপি অথরিটির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, আগামীকাল বৃহস্পতিবার এনসিটি নিয়ে তাদের কার্যালয়ে বৈঠক ডাকা হয়েছে। বৈঠকে বিদেশি কোম্পানির লোকজন উপস্থিত থাকবেন বলে পিপিপির ঐ কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন।

বন্দর-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, বন্দরের কার্যক্রম বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা উঠে পড়ে লাগেন। পিসিটিকে বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার কাজ তিনি সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে পারলেও এনসিটির বিষয়টি আটকে যায়। যদিও এনসিটি বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার কার্যক্রম অনেক দূর এগিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তবে সম্প্রতি ডিপি ওয়ার্ল্ড নামক ঐ কোম্পানি নৌপরিবহন উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করলে স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শঙ্কা বিরাজ করছে। তারা বলছেন, বন্দরের টাকায় গড়ে ওঠা বন্দরের অবকাঠামোগুলো বিদেশিদের হাতে তুলে দিলে এর নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে চলে যাবে। দেশের মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা চলে যাবে দেশের বাইরে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশের মোট কনটেইনার পণ্য ওঠানামার ৫৫ শতাংশই হয় চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি দিয়ে। সবচেয়ে আধুনিক সব যন্ত্রে সজ্জিত এই টার্মিনাল থেকে বছরে হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আয় করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, ২০০৭ সালের আগে চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে ভেড়ার আগে একটি কনটেইনার জাহাজকে বহির্নোঙরে অপেক্ষায় থাকত গড়ে ১২ থেকে ১৫ দিন। আধুনিক যন্ত্র এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনায় জাহাজের গড় অপেক্ষমাণ সময় ১২ দিন থেকে কমে নেমে এসেছে দুই থেকে আড়াই দিনে।

২০০৬ সালে বিএনপি সরকারের আমলে নির্মিত হলেও টার্মিনালটি পরিচালনা জটিলতায় আটকে ছিল। বিএনপি সরকারের আমলে এবং পরে সেনা-সমর্থিত সরকার, এরপর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও এনসিটি বিদেশি অপারেটর দিয়ে পরিচালনার চেষ্টা হয়, কিন্তু প্রতিবাদের মুখে সেটি সফল হয়নি। পরে এই টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব পায় দেশীয় প্রতিষ্ঠান সাইফ পাওয়ারটেক। তারা বিদেশি বন্দরে কর্মরত দক্ষ কর্মী এনে এনসিটি পরিচালনা শুরু করে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদেশি অপারেটর দিয়ে এনসিটি পরিচালনার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। এজন্য সরকারের পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) কর্তৃপক্ষ ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজর পর্যন্ত নিয়োগ করেছিল। তখন বন্দর ব্যবহারকারীদের অনেকেই এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকলেও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টার একক আধিপত্যের কারণে বিদেশি কোম্পানি দিয়ে এনসিটি চালানোর কাজ এগোতে থাকে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রেক্ষাপটে এনসিটি বিদেশি অপারেটর দিয়ে পরিচালনার উদ্যোগে ভাটা পড়ে। এই পরিস্থিতিতে ডিপি ওয়ার্ল্ডের শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূত গত ২৯ সেপ্টেম্বর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাত্ করলে বিষয়টি আবারও আলোচনায় আসে। জানা গেছে, নৌপরিবহন উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে তারা এনসিটি, বে-টার্মিনালে বিনিয়োগের আগ্রহের বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছে।

এরপর প্রতিনিধিদলটি বন্দর চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাত্সহ বন্দর পরিদর্শন করেছে। সেখানে বে-টার্মিনাল ও এনসিটি পরিচালনা নিয়ে তাদের আগ্রহ পুনর্ব্যক্ত করেছে।

পিপিপি অথরিটির একজন সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, এনসিটি টার্মিনাল বিদেশি অপারেটর দিয়ে পরিচালনার সিদ্ধান্ত থেকে সরকার সরে আসেনি। এ নিয়ে উচ্চপর্যায় থেকে ইতিবাচক বা নেতিবাচক কিছুই জানানো হয়নি।

এদিকে, বিদেশি অপারেটর দিয়ে এনসিটি পরিচালনার বিরোধিতা করছেন স্থানীয় অপারেটররা। তারা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি টার্মিনাল পরিচালনায় বিদেশি অপারেটর এলে বন্দরের রাজস্ব আয় হবে ঠিকই, কিন্তু রাজস্বের সিংহভাগ চলে যাবে বিদেশে। তাদের মতে, এনসিটি এখন যেভাবে চট্টগ্রাম বন্দরের একক নিয়ন্ত্রণে আছে, সেটি আর থাকবে না। ফলে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে ঝুঁকি তৈরি হবে। কারণ চট্টগ্রাম বন্দরের হাতে ৫৫ শতাংশ কনটেইনার ওঠানামার জন্য বিকল্প কোনো টার্মিনালও নেই।

এছাড়া বিদেশি অপারেটর এলে এনসিটির পণ্য ওঠানামার খরচ বাড়বে বলে মনে করেন তারা। আর খরচ বাড়লে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

বন্দর ব্যবহারকারীদের মতে, নতুন স্থানে একটি আধুনিক টার্মিনাল তৈরি করে সেটি পরিচালনার দায়িত্ব আন্তর্জাতিক স্বনামধন্য অপারেটরদের দেওয়া যেতে পারে। চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে চার গুণ বড় প্রস্তাবিত ‘বে-টার্মিনাল’ কিংবা ‘মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর’, এমনকি ‘পায়রা সমুদ্রবন্দরে’ নতুন টার্মিনাল নির্মাণে বিদেশিদের আগ্রহকে প্রাধান্য দেওয়া যেতে পারে। এতে বিদেশিরা নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারবে। বন্দরের টাকায় গড়া, বন্দরের কেনা যন্ত্রপাতি দিয়ে বিদেশি অপারেটরদের টার্মিনাল পরিচালনায় সফলতার কিছুই নেই। এসব বিবেচনায় এনসিটিতে বিদেশি অপারেটর কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে স্থানীয় অপারেটররা জানিয়েছেন।

Related Articles

Back to top button