ফিফা বিশ্বকাপ ২০২৬ ড্র শেষ, কে কোন গ্রুপে খেলবে? 

অনলাইন ডেস্ক: ১২টি গ্রুপ, ৪৮টি দল, তিন দেশে হবে খেলা- ফুটবল বিশ্বকাপকে এমনিতেই বলা হয় ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ – পৃথিবীর সেরা স্পোর্টস প্রতিযোগিতা যেন আরও বড় পরিসর করে নিলো, যেখানে ফিফার সদস্য তালিকার চার ভাগের এক ভাগ দলই এবারে প্রথম বিশ্বকাপ খেলবে।

এতো বড় পরিসরে আয়োজিত হতে যাওয়া এই বিশ্বকাপের ড্র সম্পন্ন হয়েছে শুক্রবার মধ্যরাতে। ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার মতো দলগুলোর খেলা কাদের বিপক্ষে হবে তা এখন প্রকাশ্যে এসেছে।

বিশেষ কায়দায় পটের মাধ্যমে দলগুলোকে র‍্যাংকিং-এর শক্তিমত্তা, আগের আসর ও আয়োজক দেশের হিসাব করে আলাদা করে এই লটারি করা হয়েছে, যাতে ব্রাজিল আর্জেন্টিনার যদি দেখা হয়েও যায়, তা সেমিফাইনালের আগে হবে না।

ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার গ্রুপ নিয়ে সমর্থকদের বড় অংশই খুশি। কেউ কেউ লিখেছেন জার্মানি এবার চাইলেও গ্রুপ পর্বে বাদ পড়তে পারবে না, ইংল্যান্ডকে নিয়ে শংকা প্রকাশ করছেন দেশটির বিশ্লেষকরাই।

তবে অনেকেই এবারের বিশ্বকাপে স্পেনকে ‘হট ফেভারিট’ ধরছেন।

এবারের বিশ্বকাপে ১২টি গ্রুপ এখান থেকে ২৪টি দল সরাসরি দ্বিতীয় রাউন্ডে যাবে। ৮ গ্রুপ থেকে তৃতীয় সেরা ৮টি দল নিয়ে মোট ৩২ দল খেলবে দ্বিতীয় রাউন্ড।

আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের গ্রুপে কারা আছে?

২০২২ সালের চ্যাম্পিয়ন দল লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা এবারে তুলনামূলক সহজ গ্রুপে পড়েছে, গ্রুপ-জে তে আর্জেন্টিনার সাথে আছে আলজেরিয়া, জর্ডান ও অস্ট্রিয়া। এর মধ্যে জর্ডান প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলবে।

পাঁচ বারের বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলের গ্রুপে আছে গত বিশ্বকাপের সেমিফাইনালিস্ট মরক্কো, গ্রুপ-সিতে আরও আছে স্কটল্যান্ড ও হাইতি।

ইউরোপের বড় দলগুলো কে কোন গ্রুপে?

২০২৬ ফিফা বিশ্বকাপে হয়তো সবচেয়ে সহজ গ্রুপে পড়েছে ৪ বারের বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন জার্মানি। গ্রুপ-ইতে জার্মানির সাথে আছে কিউরাসাও যারা এই প্রথম বিশ্বকাপ খেলবে। এছাড়া আছে ইকুয়েডর ও আইভরি কোস্ট।

গ্রুপ-এফ এ আছে নেদারল্যান্ডস, সাথে আছে তিউনিসিয়া, জাপান ও প্লে অফ খেলে উঠে আসা আরেকটি দল। সেই আরেকটি দল হতে পারে তুরস্ক, স্লোভাকিয়া, কসোভো অথবা রোমানিয়া।

গ্রুপ-জিতে আছে বেলজিয়াম, মিশর, ইরান ও নিউজিল্যান্ড।

ইউরোপিয়ান ফুটবল বিশ্লেষক জুলিয়েন লরেন্স বিবিসি রেডিও ফাইভ লাইভ-কে বলেন, “এডেন হ্যাজার্ডের যে প্রজন্ম, সেটা এখন ইতিহাস। আর ডি ব্রুইনে, লুকাকু, কোর্তোয়া, এই সোনালি প্রজন্মের জন্য হয়তো এটাই শেষ বড় সুযোগ। জাতীয় দলের কোচ হিসেবে রুডি গার্সিয়ার প্রতি খুব একটা আস্থা নেই আমার। মাঝেমধ্যে ভালো মুহূর্ত এসেছে ঠিকই, কিন্তু ম্যাচ দীর্ঘ সময় ধরে নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষমতা এখনো দলের মধ্যে দেখা যায় না।”

গ্রুপ-এইচে আছে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন স্পেন, প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে আসা কেপ ভার্দে, উরুগুয়ে ও সৌদি আরব। গ্রুপ-আইতে ২০০২ বিশ্বকাপের মতো এবারো মুখোমুখি হতে যাচ্ছে ফ্রান্স ও সেনেগাল।

সেবার সেনেগাল প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে নেমেই তৎকালীন বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকে হারিয়েছিল ১-০ গোলে। এই গ্রুপে আরও আছে এর্লিং হালান্ডের দল নরওয়ে।

ইউরোপিয়ান ফুটবল বিশ্লেষক জুলিয়েন লরেন্স বিবিসি রেডিও ফাইভ লাইভ-কে বলেন, “একদিক থেকে দেখলে কিলিয়ান এমবাপ্পের দুর্দান্ত ফর্মই ফ্রান্সের সবচেয়ে বড় শক্তি, আর সামনে যে চারজন আক্রমণভাগে সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে, তাদের ওপরও বড় আশা রাখা যায়। তবে বাস্তবতা হলো, এখন দলটি অনেকটাই এমবাপ্পেকে ঘিরে নির্ভর করে আছে।”

তবে ফুটবল সমর্থকদের জন্য মজার ব্যাপার গ্রুপ পর্বেই এমবাপে বনাম হালান্ড লড়াই তারা দেখতে পাবে।

গ্রুপ-কেতে আছে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর পর্তুগাল, সাথে উজবেকিস্তান, কলম্বিয়া এবং প্লে অফ খেলে উঠে আসার সুযোগ থাকছে জ্যামাইকা, ডিআর কঙ্গো ও নিউ ক্যালেডোনিয়ার মধ্যে একটি দলের।

গ্রুপ-এলএ আছে ইংল্যান্ড, বলা হচ্ছে এটাই সবচেয়ে কঠিন গ্রুপ। এই গ্রুপে আছে ক্রোয়েশিয়া, ঘানা ও পানামা।

ইংল্যান্ডের কোচ থমাস টুখেল বিবিসি স্পোর্টকে বলেছেন, “গ্রুপটা কঠিন, শুরুর ম্যাচটাও কঠিন। ক্রোয়েশিয়া আর ঘানা, দু’টো দেশই নিয়মিত বিশ্বকাপে খেলে এমন শক্তিশালী দল ও গর্বিত ফুটবল খেলুড়ে দেশ । পানামা সম্পর্কে এখনই খুব বেশি জানি না, তবে টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই অবশ্যই তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেব।”

স্বাগতিকদের গ্রুপ কেমন?

গ্রুপ-এ তে আছে মেক্সিকো, তাদের সাথে আছে দক্ষিণ আফ্রিকা ও দক্ষিণ কোরিয়া। এই গ্রুপের বাকি একটি দল এখনও নির্ধারিত হয়নি, সেখানে উঠে আসতে পারে ডেনমার্ক, চেক প্রজাতন্ত্র, আয়ারল্যান্ড অথবা নর্থ ম্যাসেডোনিয়া।

গ্রুপ-বিতে আছে কানাডা, সাথে গত বিশ্বকাপের স্বাগতিক কাতার ও সুইজারল্যান্ড। এখানে খেলতে পারে ইতালি, ওয়েলস, বসনিয়া অথবা নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড।

গ্রুপ-ডিতে আছে যুক্তরাষ্ট্র, প্যারাগুয়ে ও অস্ট্রেলিয়া, সাথে খেলতে পারে তুরস্ক, স্লোভাকিয়া, কসোভো অথবা রোমানিয়া।

এবারই যাদের প্রথম বিশ্বকাপ

রেকর্ড ৪৮টি দেশ অংশ নিচ্ছে এবারের বিশ্বকাপে, ফলে অনেক দেশেরই প্রথমবার ফুটবল বিশ্বকাপের স্বাদ পাওয়া নিশ্চিত হলো।

ব্রাজিল যেখানে আগের সব ২২টি বিশ্বকাপেই খেলেছে, সেখানে ফিফার ২১১ সদস্য দেশের মধ্যে ১৩২টি দল কোনোদিনই বিশ্বকাপের মঞ্চে উঠতে পারেনি।

কেপ ভার্দে

ফিফা বিশ্বকাপের কোনও আসরে এবারে প্রথম বারের মতো খেলছে কেপ ভার্দে।

আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলের কাছে ছোট্ট দ্বীপপুঞ্জ কেপ ভার্দের জনসংখ্যা মাত্র ৬ লাখ। অক্টোবর মাসে তারা বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে, ২০১৮ সালের আইসল্যান্ডের পর বিশ্বের দ্বিতীয় সবচেয়ে ছোট দেশ হিসেবে ফাইনালে পৌঁছানোর কীর্তি গড়েছিল। তবে এই রেকর্ড দ্রুত হারিয়ে যায় কিউরাসাওর কাছে।

কেপ ভার্দি এই বিশ্বকাপে স্থান পেতে এসওয়াটিনি-কে হারায় এবং এটি তাদের শেষ ৪০ বছরে ফুটবলে অভূতপূর্ব উত্থানের প্রমাণ। তারা ১৯৯০ সালে প্রথমবার বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব খেলেছিল, এবং ধীরে ধীরে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কেপ ভার্দের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত খেলোয়াড় খুঁজে নেওয়ার মাধ্যমে গ্লোবাল টুর্নামেন্টে পৌঁছানোর পথে এগিয়েছে।

বর্তমান স্কোয়াডে আছে ছয় জন নেদারল্যান্ডস জন্ম নেয়া খেলোয়াড় এবং একজন আইরিশ, শ্যামরক রোভার্সের ডিফেন্ডার রবার্তো লোপেস।

৩৩ বছর বয়সী লোপেস ডাবলিনে জন্ম হলেও তার পিতার মাধ্যমে কেপ ভার্দের হয়ে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। আরও মজার ব্যাপার পেশাদার কাজের জন্য পরিচিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম লিঙ্কডইন ব্যবহার করে দলটি তাকে নিয়োগ করেছিল।

কিউরাসাও

ছোট্ট ক্যারিবিয়ান দ্বীপ কিউরাসাও বিশ্বকাপে খেলার ইতিহাসে সবচেয়ে ছোট দেশ হয়ে উঠল জ্যামাইকার সাথে ড্র করে। কিউরাসাও এর জনসংখ্যা মাত্র ১ লাখ ৫০ হাজার এবং ১৭১ বর্গমাইল এলাকা, যা আইল অফ ম্যানের থেকেও ছোট।

কিউরাসাওর কোচ ডিক অ্যাডভোকাট ব্যক্তিগত কারণে ম্যাচে উপস্থিত ছিলেন না, তবে ৭৮ বছর বয়সে তিনি বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া সবচেয়ে বয়সী কোচ হিসেবে ইতিহাস গড়বেন।

কিউরাসাও ভেনেজুয়েলার উপকূল থেকে ৩৭ মাইল দূরে অবস্থিত এবং ২০১০ সালে নেদারল্যান্ডস অ্যান্টিলিসের বিলুপ্তির পর নেদারল্যান্ডসের অধীনে স্বতন্ত্র দেশ হিসেবে পরিচিতি পায়।

দশ বছর আগে তারা ফিফা র‍্যাঙ্কিংয়ে ১৫০তম স্থানে ছিল, এখন ৮২তম।

জর্ডান

দীর্ঘ পথ পার হলেও জর্ডান শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করল।

আরব দেশটি প্রথমবার ৪০ বছর আগে বাছাইপর্বে অংশগ্রহণ করেছিল। এবারে এএফসি গ্রুপ বি–তে দক্ষিণ কোরিয়ার পেছনে রানার-আপ হয়ে ২০২৬ সালের টুর্নামেন্টে খেলার যোগ্যতা নিশ্চিত করল।

প্রাক্তন টটেনহ্যাম, পোর্টসমাউথ ও কুইন্স পার্ক রেঞ্জার্সের কোচ হ্যারি রেডনাপ জর্ডানের দায়িত্বে ছিলেন ২০১৮ সালের রাশিয়ার বিশ্বকাপের দুটি বাছাই ম্যাচের জন্য। রেডনাপের অধীনে জর্ডান ৮-০ গোল ব্যবধানে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জয় পায়, আর অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৫-১ গোল ব্যবধানে হার হয়।

উজবেকিস্তান

এশিয়ার বাছাইপর্ব থেকে প্রথমবার বিশ্বকাপে পৌঁছানো আরেকটি দেশ হলো উজবেকিস্তান।

উজবেকিস্তান আগেও বিশ্বকাপে খেলার খুব কাছাকাছি গিয়েছিল- ২০০৬ সালের জার্মানি এবং ২০১৪ সালের ব্রাজিলে হওয়া বিশ্বকাপ টুর্নামেন্টের বাছাইপর্বের শেষ রাউন্ডে তারা বাদ পড়েছিল।

দলে রয়েছে কিছু প্রতিভাবান খেলোয়াড়, যার মধ্যে অন্যতম ম্যানচেস্টার সিটির ডিফেন্ডার আবদুকোদির খুসানভ, যিনি প্রথম উজবেক খেলোয়াড় হিসেবে প্রিমিয়ার লিগে খেলেছেন।

খেলা হবে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোতে। প্রথমবারের মতো একসঙ্গে তিন দেশের যৌথ আয়োজনে এটি হবে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ও বিস্তৃত বিশ্বকাপ। তিন দেশই উন্নত অবকাঠামো, আধুনিক স্টেডিয়াম ও বিশাল দর্শকসমর্থন নিয়ে প্রস্তুত, যা টুর্নামেন্টকে করবে আরও বর্ণিল ও বাণিজ্যিকভাবে সফল।

মেক্সিকো এরই মধ্যে তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ আয়োজন করে রেকর্ড গড়তে যাচ্ছে, আর যুক্তরাষ্ট্র তাদের বিশাল ক্রীড়া বাজার ও দর্শকসংস্কৃতির পরিবর্তনের সুযোগ দেখছে।

কানাডা প্রথমবার আয়োজন করবে ফিফা বিশ্বকাপ।

সব মিলিয়ে উত্তর আমেরিকার তিন দেশের এ যৌথ আয়োজন ফুটবলের বৈশ্বিক বিস্তৃতি, দর্শকসংখ্যা এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে নতুন মাত্রা দেবে, এমনটাই আশা করছে ফুটবলবিশ্ব।

২০২৬ সালের বিশ্বকাপের গ্রুপ ড্র

গ্রুপ এ: মেক্সিকো, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, ইউরো প্লে‑অফ ডি বিজয়ী

গ্রুপ বি: কানাডা, ইউরো প্লে‑অফ এ বিজয়ী, কাতার, সুইজারল্যান্ড

গ্রুপ সি: ব্রাজিল, মরক্কো, হাইতি, স্কটল্যান্ড

গ্রুপ ডি: যুক্তরাষ্ট্র, প্যারাগুয়ে, অস্ট্রেলিয়া, ইউরো প্লে‑অফ সি বিজয়ী

গ্রুপ ই: জার্মানি, কিউরাসাও, আইভরি কোস্ট, ইকুয়েডর

গ্রুপ এফ: নেদারল্যান্ডস, জাপান, ইউরো প্লে‑অফ বি বিজয়ী, টিউনিশিয়া

গ্রুপ জি: বেলজিয়াম, ইজিপ্ট, ইরান, নিউ জিল্যান্ড

গ্রুপ এইচ: স্পেন, কেপ ভার্দে, সৌদি আরব, উরুগুয়ে

গ্রুপ আই: ফ্রান্স, সেনেগাল, ফিফা প্লে‑অফ ২ বিজয়ী, নরওয়ে

গ্রুপ জে: আর্জেন্টিনা, আলজেরিয়া, অস্ট্রিয়া, জর্ডান

গ্রুপ কে: পর্তুগাল, ফিফা প্লে‑অফ ১ বিজয়ী, উজবেকিস্তান, কলম্বিয়া

গ্রুপ এল: ইংল্যান্ড, ক্রোয়েশিয়া, ঘানা, প্যানামা

প্লে‑অফ বিজয়ী- মানে হলো বাছাইপর্বের প্লে‑অফ থেকে আসা দল।

Related Articles

Back to top button