ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তিতে প্রেমতলীর নারীদের নতুন সম্ভাবনার গল্প

অনলাইন ডেস্ক: রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলা। যেখানে বেশি মানুষের পেশা কৃষি। আম চাষের জন্য বিখ্যাত জেলাটি নারী-পুরুষ সবাই কমবেশি লাভজনক এ ফলটি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। তবে আমের মৌসুম বাদে অনেকেই ভিন্ন পেশার কাজ করেন। তাদেরই একজন শ্রাবণী কর্মকার। উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম প্রেমতলীর এ নারী পরিবারকে আর্থিকভাবে সাহায্য করার জন্য ঘরেই দর্জির কাজ করেন। সারা দেশের মতো শ্রাবণীর এলাকায় প্রযুক্তি উৎকর্ষের ছোঁয়া লেগেছে। যোগাযোগের প্রয়োজনে ব্যবহার করলেও স্মার্টফোনের কল্যাণে ইন্টারনেট দুনিয়া তাদের হাতের মুঠোয়। তবে গ্রামীণ এ নারীর কাছে ইন্টারনেটের দুনিয়া ছিল অজানা। কীভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করে জীবনযাপনকে আরও সহজ করা যায়—সে বিষয় তার জানা ছিল না। এক প্রশিক্ষণ তার ভাবনার জগৎটাকেই যেন খুলে দিয়েছে। শ্রাবণী এক আত্মবিশ্বাসী মানুষ।

‘গ্রামে থাকলেও ইন্টারনেটের কল্যাণে স্মার্টফোন ব্যবহার করে ঘরে বসেই সব সুবিধা পাচ্ছি। আমার বানানো পোশাক ইন্টারনেট ব্যবহার করে সারা দেশে মানুষের কাছে তুলে ধরার সুযোগ পাচ্ছি। অনলাইনেই বিক্রি করতে পারছি এবং টাকা পেয়ে যাচ্ছি ঘরে বসেই।’ চোখেমুখে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে এমনটাই জানান শ্রাবণী।

কৃষি কাজের পাশাপাশি হাতের অসাধারণ ছোঁয়ায় কাঁথার মধ্যে ফুল তোলায় দক্ষ মল্লিক কর্মকার। তার বানানো অসাধারণ ডিজাইনের নকশিকাঁথা এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু ইন্টারনেটের সুবিধা ব্যবহার করে তার হাতের তৈরি নকশিকাঁথা অনলাইনে বিক্রি করে ভালো আয় করা সম্ভব; এমনটা জানার পর মল্লিক কর্মকার স্বপ্ন বোনা শুরু করেন। তাদের দুজনের মতো এমন অনেক মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে আর্থিক অবস্থা আরও একটু ভালো রাখার জন্য প্রশিক্ষণ নিয়ে পরিবারকে সাহায্য করার চেষ্টা করছে।

শুধু আর্থিকভাবেই নয়, সামাজিকভাবে প্রেমতলীর অনেক নারী আজ আরও শক্তিশালী। বহু নারীকে সোশ্যাল মিডিয়া অপব্যবহার করে সামজিকভাবে বুলিংয়ের চেষ্টা করা হতো। ডিজিটাল পৃথিবীটা ছিল নারীদের কাছে ছিল একটা ভয়ের জগৎ। সোশ্যাল মিডিয়াতে কোনো ছবি দিলেই তারা থাকত ভয়ে। খারাপ মন্তব্যে ভরে যেত তাদের কমেন্ট বক্স। কিন্তু প্রেমতলীর নারীরা এখন জানেন ডিজিটাল জগতে কীভাবে নিজেদের রক্ষা করতে হবে। অনলাইন প্রতারণা করলে এখন আর নিজে ভয় পেয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকার দিন শেষ। এখন ভয় পাবে যারা ডিজিটাল জগতে বুলিং করে তারা।

গ্রামীণফোন, টেলিনর ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগ ‘পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি’ প্রকল্পে তাদের শেখানো হচ্ছে কীভাবে নারী ডিজিটাল স্পেসে নারীরা আরও বেশি নিরাপদ থাকবে। একই সঙ্গে প্রযুক্তির সর্ব্বোচ সুবিধা নিয়ে আর্থিকভাবে আরও ভালো থাকা যাবে। প্রশিক্ষণের শেষ দিন সম্প্রতি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার প্রেমতলী গ্রামে প্রশিক্ষণ পাওয়া নারী-পুরুষদের সঙ্গে তাদের গল্প শুনে নিজেদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন আন্তর্জাতিক তিন প্রতিষ্ঠানের কর্তা ব্যক্তিরা।

আয়োজকেরা জানান, বাংলাদেশের দ্রুত বর্ধনশীল ডিজিটাল অবকাঠামো সত্ত্বেও লক্ষ লক্ষ মানুষ, বিশেষ করে নারী, যুবসমাজ এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এখনো ডিজিটালভাবে বঞ্চিত রয়েছেন। প্রান্তিক গ্রামীণ অঞ্চলে জেন্ডার বৈষম্য, সাক্ষরতার ঘাটতি এবং বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাধার কারণে ডিজিটাল ডিভাইস ও তথ্যের সহজলভ্যতা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এখনো অনেক নারী অনলাইনে যোগাযোগের জন্য পরিবারের পুরুষ সদস্যদের ওপর নির্ভরশীল। জাতিগত সংখ্যালঘু, বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তি এবং জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্তসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিক্ষা, সরকারি সেবা এবং ডিজিটাল জীবিকা অর্জনের ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছেন। কোনো পদক্ষেপ না নিলে ডিজিটাল বিভাজনের ফলে ক্রমশ সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে ধারণা করছেন আয়োজকরা। তাই পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকে ডিজিটাল সাক্ষরতা এবং অনলাইন নিরাপত্তা বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতেই এ আয়োজন।

২০২৩ সালে শুরু হওয়া প্রশিক্ষণ প্রকল্পটিতে ৮টি প্রান্তিক গ্রামীণ অঞ্চলে প্রায় ৩৩ লাখ মানুষকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণ নেওয়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছিল জাতিগত সংখ্যালঘু, বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তি, চা-বাগানের শ্রমিক, ট্রান্সজেন্ডার, হাওর ও চরের জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি, মহিলা প্রধান পরিবার ও পথশিশু। উঠান বৈঠক, স্কুল প্রোগ্রাম এবং যুব-নেতৃত্বাধীন অ্যাডভোকেসি প্রশিক্ষণে প্রায় ৬৮ শতাংশ নারী অংশ নিয়েছেন।

প্রশিক্ষণের আগে যেখানে মাত্র ৬৮ শতাংশ অংশগ্রহণকারী প্রতিদিন ইন্টারনেট ব্যবহার করতেন, এখন তা বেড়ে ৮১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আগে যেখানে অংশগ্রহণকারীদের কেউই ডিজিটাল মাধ্যমে সরকারি সেবা পেতেন না, এখন ৭৯ শতাংশই জন্মনিবন্ধন, ভর্তির আবেদনসহ বিভিন্ন সেবা অনলাইনে গ্রহণ করছেন। প্রকল্পটি আগামী তিন বছরের জন্য দ্বিতীয় ধাপে প্রবেশ করছে। এই ধাপে সাধারণ প্রশিক্ষণের পাশাপাশি অংশগ্রহণকারীদের জন্য আয় সংক্রান্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে, যা তাদের স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করবে।

এ আয়োজন নিয়ে গ্রামীণফোন পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও টেলিনর এশিয়ার প্রধান জন ওমুন্ড রেভহাগ বলেন, ‘প্রযুক্তি ব্যবহারের দক্ষতা মানুষের সামনে অগ্রগতি ও সুযোগের দরজা খুলে দেয়। এখানকার নারীদের গল্পগুলোই প্রমাণ করে যে ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি কতটা রূপান্তরমূলক হতে পারে। সবার জন্য ডিজিটাল বিশ্বকে উন্মুক্ত করতে আমরা সংকল্পবদ্ধ।’ এই প্রকল্পের মাধ্যমে প্রান্তিক তরুণদের নিরাপদে ইন্টারনেট ব্যবহারে সমর্থ করে এক বাস্তবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর কবিতা বোস।

Related Articles

Back to top button