বিএনপির মনোনয়ন ঘিরে তীব্র অস্বস্তি, অর্ধশতাধিক আসনে কোন্দল

অনলাইন ডেস্ক: আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির ভেতরে মনোনয়নসংক্রান্ত কোন্দল ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করছে। সারাদেশে অন্তত অর্ধশতাধিক আসনে ঘোষিত সম্ভাব্য প্রার্থীর বিরুদ্ধে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীদের প্রকাশ্য অসন্তোষ, আন্দোলন ও লিখিত অভিযোগ দলটির সাংগঠনিক পরিস্থিতিকে চাপে ফেলেছে। কোথাও মাঠে বিক্ষোভ, কোথাও কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অভিযোগপত্র—সব মিলিয়ে মনোনয়ন নিয়ে অস্বস্তি এখন বেশ বিস্তৃত।

দলীয় সূত্র ও তৃণমূল নেতাদের ভাষ্য, যেসব আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে, সেখানে অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় নেতারা উপেক্ষিত হয়েছেন। পরিবর্তে বয়সে প্রবীণ, বিতর্কিত কিংবা সুবিধাভোগী নেতাদের মূল্যায়ন করায় ক্ষোভ দানা বাঁধছে। এই পরিস্থিতিতে ত্যাগী, অপেক্ষাকৃত তরুণ ও ‘ক্লিন ইমেজের’ প্রার্থী দেওয়ার দাবিতে সংগঠিত হচ্ছেন অসন্তুষ্টরা। তাদের আশঙ্কা, এই কোন্দল দীর্ঘস্থায়ী হলে নির্বাচনী মাঠে এর সুবিধা পাবে প্রতিপক্ষ।

তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বলছেন, কেন্দ্র থেকে ঐক্যের বার্তা এলেও বাস্তবে কোন্দল নিরসনের লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে না। বরং প্রার্থী বদলের দাবিতে বিভক্তি আরও স্পষ্ট হচ্ছে। অনেকের মতে, অযোগ্য ও বিতর্কিত ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়াই এই সংকটের মূল কারণ। সময়মতো সিদ্ধান্ত সংশোধন না হলে নির্বাচনে বিরূপ ফলের শঙ্কাও প্রকাশ করছেন তারা।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু জানিয়েছেন, মাঠপর্যায়ের একাধিক জরিপ ও সাংগঠনিক মতামতের ভিত্তিতেই সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা করা হয়েছে। তবে এটিকে চূড়ান্ত ধরে নেওয়ার সুযোগ নেই। প্রয়োজন হলে পরিবর্তন আসতে পারে এবং কোনো অবস্থাতেই অভ্যন্তরীণ কোন্দল বরদাশত করা হবে না। ঐক্যবদ্ধভাবেই নির্বাচনে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

উল্লেখ্য, গত ৩ নভেম্বর প্রথম দফায় ২৩৭টি আসনে এবং ৪ ডিসেম্বর আরও ৩৬টি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা করে বিএনপি। একটি আসনে প্রার্থী পরিবর্তনের ফলে মোট ২৭২টি আসনে প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত হয়। তবে প্রথম তালিকা ঘোষণার পর থেকেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রার্থী বদলের দাবিতে বিক্ষোভ ও অভিযোগ চলমান।

অসন্তুষ্ট নেতাদের অভিযোগ, দলের ভেতরের একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট ও কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতার প্রভাবে আন্দোলন-সংগ্রামে নিষ্ক্রিয় কিংবা বিতর্কিত ব্যক্তিরা মনোনয়ন পেয়েছেন। বিপরীতে রাজপথে সক্রিয়, মামলা-নির্যাতনের শিকার নেতারা বাদ পড়েছেন। কোথাও ‘নব্য’ ও ‘হাইব্রিড’ নেতৃত্ব, কোথাও বয়সের ভারে ন্যুব্জ ব্যক্তিদের সামনে আনার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তারা।

এরই মধ্যে একাধিক আসনে লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। চট্টগ্রাম-১২ আসনে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও তৃণমূল নেতাদের শত শত স্বাক্ষরসংবলিত অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়েছে। অভিযোগে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, সন্ত্রাসী তৎপরতা, অবৈধ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ ও দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার নানা অভিযোগ তোলা হয়। স্থানীয় নেতাদের দাবি, এসব কারণে এলাকায় তার গ্রহণযোগ্যতা নেই।

নেত্রকোনা-৫ ও সিরাজগঞ্জ-৩ আসনেও ঘোষিত প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিতর্ক ও লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। নৈতিক স্খলনের অভিযোগ থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায়ে অগ্রহণযোগ্যতার বিষয়গুলো তুলে ধরে প্রার্থী বদলের দাবি জানানো হয়েছে দলীয় হাইকমান্ডের কাছে।

দিনাজপুর-২ আসনে ঘোষিত প্রার্থীর বিরুদ্ধেও একই ধরনের অভিযোগ করেছেন দলের একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী। সেখানে ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় সুবিধাভোগ, মামলায় ছাড়, চাঁদাবাজি, সংখ্যালঘু নির্যাতন ও মাদক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে মনোনয়ন পুনর্বিবেচনার দাবি জানানো হয়েছে। স্থানীয় নেতারা আশঙ্কা করছেন, দুর্বল প্রার্থিতার কারণে ভোটের সমীকরণ বদলে যেতে পারে।

এ ছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪, কুষ্টিয়া-৪, জামালপুর-২, চট্টগ্রাম-১৩সহ আরও কয়েকটি আসনে বয়সজনিত অক্ষমতা, দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকা, আন্দোলনে নিষ্ক্রিয়তা কিংবা অতীত রাজনৈতিক অবস্থানকে কেন্দ্র করে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবি উঠেছে। কোথাও বলা হচ্ছে, এসব সিদ্ধান্ত বহাল থাকলে দল নিশ্চিতভাবে আসন হারাতে পারে।

সব মিলিয়ে মনোনয়নকে কেন্দ্র করে বিএনপির ভেতরের এই অস্থিরতা নির্বাচনী প্রস্তুতিকে কঠিন করে তুলছে।

Related Articles

Back to top button