জামালপুরে রাসায়নিক সারের প্রভাবে কমছে মাটির গুণাগুণ

অনলাইন ডেস্ক: জামালপুরের কৃষিজমির মাটিতে অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে ফসফরাস, কমেছে পিএইচ ও অর্গানিক ম্যাটারের পরিমাণ। এসবের প্রভাবে হ্রাস পাচ্ছে মাটির গুণমান। ফসলি জমির উর্বরতা কমাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষক। মাটি গবেষকরা বলছেন, মাত্রাতিরিক্ত সার ব্যবহারের কারণে দেখা দিয়েছে এই পরিস্থিতির। তাই ফসলের মাঠে জৈব সার ব্যবহার করার পরামর্শ দিচ্ছে কৃষি বিভাগ। কৃষিজমির মাটিতে ১৭টি উপাদানের মধ্যে সার হিসেবে ব্যবহৃত হয় সাতটি। এর মধ্যে জামালপুরের ফসলি মাঠের মাটিতে চারটি স্বাভাবিক থাকলেও অস্বাভাবিকভাবে পরিবর্তন হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি উপাদান। বেড়েছে ফসফরাস আর কমেছে পিইচ ও অর্গানিক ম্যাটারের পরিমাণ।
জামালপুরের মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউটের আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে জানা যায়— ফসফরাসের পরিমাণ ১৫ দশমিক ৭৫ পিপিএম থেকে ২১ পিপিএম থাকার কথা থাকলেও জামালপুরের কৃষিজমিতে রয়েছে ৩৫ থেকে ৪০ পিপিএম। পাঁচ বছর আগে এর পরিমাণ ছিল ৩.৫ থেকে ১০ পিপিএম। অর্গানিক ম্যাটার পাঁচ শতাংশ থাকার দরকার থাকলেও রয়েছে মাত্র দেড় শতাংশ। আর পিএইচ ৬ দশমিক ৬ থেকে ৭ দশমিক ৩ থাকার প্রয়োজন থাকলেও রয়েছে ৫ থেকে ৬ নিউট্রাল। পাঁচ বছর আগে ছিল ৬ থেকে ৬ দশমিক ৫ নিউট্রাল। এসবের প্রভাবে হ্রাস পাচ্ছে মাটির গুণমান। তাই ফসলি জমির উর্বরতা কমে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষক।
জেলার মেলান্দহ উপজেলার চরপলিশা গ্রামের কৃষক সেলিম আব্বাস। পূর্বপুরুষ থেকে জমিতে চাষাবাদ করাই তাদের মূল পেশা। একসময় জমিতে খুবই কম পরিমাণে সার ব্যবহার করতেন তারা। অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে সেলিম আব্বাস বলেন, ‘আমাদের এখানে আবাদে আগে গোবর ব্যবহার করা হতো। অন্যান্য ছাই ব্যবহার করা হতো। জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পেত। এখন ঐরকমভাবে গোবর পাওয়া যায় না। গোবর লাকরি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর গরুর সংকট। তাই সব মিলিয়ে গোবর আর ছাই খেতে দেওয়া হয় না। আমরা এখন খেতে প্রচুর পরিমাণে সার দিই।’ জেলার ইসলামপুর উপজেলার গুঠাইল এলাকার কৃষক আমান উল্লাহ বলেন, “এখন মাটিতে শক্তি নেই। ফলন বাড়াতে গেলে সার-বিষ বেশি করে দিতে হয়। এতে মাটির শক্তি আরো কমে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের খরচ প্রচুর পরিমাণে বাড়ছে। এভাবে চললে তো আমাদের কাজ হবে না।
জামালপুর শহরতলীর হাটচন্দ্রা গ্রামের কৃষক শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘২০-৩০ বছর আগে কোনো পোকা-মাকড় ছিল না। এখন ধান খেতে চার বার করে বিষ দিচ্ছি, তাও পোকা মরে না। ধানের মুরদ কম। এই ধানের ভাত তেমন স্বাদ লাগে না। ২০ বছর আগে ভাত স্বাদ লাগত। শুধু লবণ মাখিয়ে ভাত খেয়ে ফেলতাম তখন।’
জামালপুরের সদরের কালীবাড়ি এলাকার কৃষক জুয়েল আহমেদ বলেন ‘আগে যে পরিমাণ আবাদ মৌসুম করেছি, তেমন ফলন হয়নি। কিন্তু সার- বিষ তেমন লাগেনি। এখন ফলন হয়, ঠিক আছে। অতিরিক্ত সার-বিষ খেতে দেওয়া লাগে। মাটির তেমন কোনো শক্তি নেই। একদম নরম হয়ে গেছে।
মৃত্তিকা গবেষকরা বলছেন—মাত্রাতিরিক্ত সার ব্যবহারে এই তিনটি উপাদান পরিবর্তন হওয়ায় উর্বরতা হারাচ্ছে কৃষিজমি। তাই ফসলের মাঠে জৈব সার ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছে কৃষি বিভাগ।
জামালপুর মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউটের আঞ্চলিক গবেষণাগারের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘জামালপুরের কৃষিজমিতে পিএইচটা কমে যাচ্ছে, কারণ আমরা প্রচুর পরিমাণ নাইট্রোজেন জাতীয় সার ব্যবহার করছি। ফসফরাসের পরিমাণটা বেড়ে যাচ্ছে, কারণ আমরা মাটিতে ফসফরাসের উৎস হিসেবে টিএসপি সারের পাশাপাশি ডিএফপি সার ব্যবহার করছি। আর জৈব পদার্থ কমে যাওয়ার কারণ হলো আমরা আগে যে পরিমাণ জৈব পদার্থ দিতে পারতাম, এখন আমরা সেই পরিমাণ জৈব পদার্থ ব্যবহার করতে পারছি না।’ জামালপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (উদ্ভিদ সংরক্ষণ) জেসমিন জাহান বলেন, ‘আমরা এখন কৃষককে জৈব সারের প্রতি বেশি উদ্বুদ্ধ করছি। তাদেরকে পরামর্শ দিচ্ছি প্রয়োজনীয় পরিমাণে জৈব সার ব্যবহার করার। নিয়মিত যদি জৈব পদার্থ ব্যবহার করতে পারি, তাহলে মাটির গুণাগুণ ঠিক থাকবে এবং মাটির উর্বরতাও বাড়বে।’




