পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৮ বছর আজ

শান্তিচুক্তির পর পাহাড়ে গড়ে উঠেছে আরো পাঁচ সশস্ত্র সংগঠন

অনলাইন ডেস্ক: পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির ২৮ বছরেও পাহাড়ে সংঘাত থামেনি। অস্ত্রের ঝনঝনানি, চাঁদাবাজি, গুম-খুন ও সংঘর্ষ পাহাড়কে অশান্ত করে রেখেছে। চুক্তির পর গড়ে উঠেছে আরো পাঁচটি সশস্ত্র সংগঠন। যদিও পার্বত্য চুক্তির আগে পাহাড়ে সশস্ত্র সংগঠন বলতে কেবল ছিল শান্তি বাহিনী। এমন বাস্তবতায় আজ পালিত হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৮তম বর্ষপূর্তি।

জানা গেছে, চুক্তির আগে শুধু একটি আঞ্চলিক সংগঠন থাকলেও গত ২৮ বছরে নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও কোন্দলের ফলে নতুন করে আবির্ভাব হয়েছে আরো পাঁচটি সশস্ত্র আঞ্চলিক সংগঠনের। বর্তমানে তিন পার্বত্য জেলায় ছয়টি আঞ্চলিক সংগঠনের সশস্ত্র তত্পরতা রয়েছে। সেগুলো হলো সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পিসিজেএসএস, তাদের বিরোধী সংস্কারপন্থি পিসিজেএসএস এমএন লারমা গ্রুপ, প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), তাদের বিরোধী গ্রুপ ইউপিপিডিএফ গণতান্ত্রিক, মগ লিবারেশন পার্টি (এমএলপি) ও কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। এসব সংগঠনের সশস্ত্র গ্রুপের মধ্যে প্রতিনিয়তই ঘটছে রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংঘাত। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গেও সংঘাতে লিপ্ত হচ্ছে একাধিক গ্রুপের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। ফলে পাহাড়ে আজো অশান্তির বাতাস বইছে। ২৮ বছরে এসব সশস্ত্র গ্রুপের তত্পরতায় হত্যাকাণ্ড ঘটেছে শতাধিক। অপহরণ ও চাঁদাবাজির ঘটনা তো নিত্যদিনের।

১৯৯৭ সালের এই দিনে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন তত্কালীন গেরিলা সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ও তত্কালীন আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যুগ যুগ ধরে চলা রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংঘাত বন্ধ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি ফিরিয়ে আনাই ছিল চুক্তির মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু তা অর্জিত হয়নি।

অনেকটা আক্ষেপের সুরে রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী এন্টিনা চাকমা বলেন, ‘চুক্তির অধিকাংশ ধারাই এখনো অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে। এখনো এই চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। আন্দোলন করতে হচ্ছে।’ শুধু এন্টিনা চাকমা নন, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মানুষের কাছে চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে আছে এমন ক্ষোভ, হতাশা আর অবিশ্বাস। তবে আশার কথা হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির হাত ধরে পিছিয়ে পড়া পার্বত্য অঞ্চলে নেওয়া হয়েছে ব্যাপক উন্নয়ন প্রকল্প। বিশেষ করে শিক্ষা, যোগাযোগ, স্বাস্থ্যসেবা আর পর্যটনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে হয়েছে ব্যাপক পরিবর্তন। অর্থনৈতিক ভাবেও এসেছে সমৃদ্ধি।

এদিকে বরাবরই চুক্তির বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে এটিকে ‘কালো চুক্তি’ ও ‘বৈষম্যমূলক চুক্তি’ বলছে বাঙালিভিত্তিক আঞ্চলিক সংগঠনগুলো। এই চুক্তির মাধ্যমে পাহাড়িদের অধিকার সংরক্ষণ করা হলেও বাঙালিদের গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের রাঙ্গামাটি জেলার সভাপতি মোহাম্মদ সোলাইমানের। এটাই পাহাড়ে শান্তি না ফেরার অন্যতম কারণ বলে দাবি করেন তিনি। পার্বত্য চট্টগ্রাম সম-অধিকারের রাঙ্গামাটি জেলার আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর কামাল বলেন, ‘শান্তিচুক্তি পাহাড়ে বৈষম্য এবং বিভেদ বাড়ানোর পাশাপাশি পাহাড়িদের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত বাড়িয়েছে। চুক্তির পর পাহাড়ে অস্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে।’

চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে গত ২০২৪ সাল পর্যন্ত সরকারের তরফ থেকে ৭২টি ধারার ৬৯টি বাস্তবায়িত হয়েছে বলা হলেও জনসংহতি সমিতি বলছে ভিন্ন কথা। সংগঠনটির দাবি সাধারণ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন এবং জেএসএস সদস্যসহ অভ্যন্তরীণ ও প্রত্যাগত উদ্বাস্তু পুনর্বাসনে উদ্যোগ নেয়নি সরকার। আবার পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এবং রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন ও ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনও রয়েছে বন্ধ। ফলে সরকারের মনোনীত ব্যক্তিদের দিয়ে সচল রাখায় এসব প্রতিষ্ঠান জনআকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারছে না। এমন বাস্তবতায় চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে নতুন করে বর্তমান সরকারের ওপর ভরসা রাখতে চাইছেন পাহাড়ের মানুষ।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) রাঙ্গামাটি জেলা সভাপতি ডা. গঙ্গা মানিক চাকমা বলেন, ‘বর্তমান সরকার চুক্তির গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে বলেই সরকারিভাবে আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তির বর্ষপূর্তি পালনের উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে আমরা চুক্তি বাস্তবায়ন ও পার্বত্য সমস্যা সমাধানে আশাবাদী।’

বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান :চুক্তির বর্ষপূর্তি উদ্যাপন উপলক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আজ পরিষদ প্রাঙ্গণে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি রাঙ্গামাটি শহরের কুমার সমিত রায় জিমনেসিয়াম প্রাঙ্গণে গণসমাবেশের আয়োজন করেছে।

Related Articles

Back to top button