পণ্য-লাগেজ সিন্ডিকেটে জড়িত লোডাররা

দামি পণ্যের তথ্য আগেই জেনে যায় চোর-চক্র
অনলাইন ডেস্ক: বছরের পর বছর ধরে পণ্য চোর চক্র আর লাগেজ গায়েব সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে দেশের প্রধান বিমানঘাঁটি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। প্রতিদিন গড়ে তিন-চারটি করে লাগেজ গায়েব ও দামি ব্র্যান্ডের পণ্য চুরি ঠেকাতে পারছে না। বিমানে পণ্য পরিবহনে যুক্ত বিভিন্ন ফরওয়ার্ডিং কোম্পানির পক্ষ থেকে দফায় দফায় লিখিত অভিযোগ দিলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। রপ্তানি কার্গো পণ্য চুরির এসব ঘটনায় শুধু রপ্তানিকারক বা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানই নয়, আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহন ও চালান পরিচালনাকারীরাও বিপুল ক্ষতির মুখে পড়ছেন। বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা হারানোর সঙ্গে রপ্তানি আদেশ বাতিলের মতো পরিস্থিতিও তৈরি হচ্ছে।
দায়িত্বশীল কয়েক জন কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রপ্তানি কার্গো ভিলেজে কার্টন থেকে দামি ব্র্যান্ডের পণ্য চুরির সঙ্গে একাধিক চক্র জড়িত। এসব চক্রের সদস্যরা আগেভাগেই পণ্যের তথ্য জেনে যায়। কোনো পণ্য প্রেরণকারী বা শিপিং ব্যবস্থাপনা সংস্থা কোন ব্র্যান্ডের দামি পণ্য রপ্তানি করছে, তা জানার পর তারা চুরির পরিকল্পনা করে। টার্গেট করা সেসব পণ্য কার্গো ভিলেজে পৌঁছানোর পর পর্যাপ্ত সিসিটিভি কভারেজের অভাব, দুর্বল মনিটরিং ও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার সুযোগে তা কৌশলে চুরি করে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্যমতে, কার্গো ভিলেজ থেকে দামি ব্র্যান্ডের পণ্য চুরির পর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বস্তায় ভরে ওয়্যারহাউজের ভেতরে ময়লার স্তূপে রেখে দেয়। পরে ময়লার গাড়ি সেই বস্তাগুলো তুলে নিয়ে ময়লা ফেলার স্থানে ঢেলে দেয়। তখন চক্রটি চোরাই মালামাল সেখান থেকে উদ্ধার করে। অনেকে আবার শৌচাগারে গিয়ে পোশাকের ওপর আরেক পোশাক পরে চুরি করা পণ্য বাইরে নিয়ে আসে। কখনো কখনো আবার স্ক্যানিংয়ের পর অথবা লোডিংয়ের সময় পণ্য চুরি হয়। একইভাবে পণ্যের গুদাম বা ওয়্যারহাউজের বাইরে রাখা অবস্থাতেও চুরি করা হয়।
শুধু তাই নয়, টার্মিনালের প্রবেশপথের কাছে বিমানযাত্রীদের স্বজনদের অবস্থানের স্থান বা ক্যানোপি এলাকা থেকেও অনেক সময় পণ্য বা লাগেজ চুরি হয়। চোর চক্র প্রধান প্রবেশপথ দিয়ে নিরাপত্তা প্রহরী ও অঙ্গীভূত আনসার সদস্যদের সামনে দিয়েই বস্তা বা ব্যাগে করে চোরাই পণ্য বাইরে নিয়ে যায়। এভাবেই গত ৫ নভেম্বর বিকালে ক্যানোপি এলাকায় রাখা ইয়াংওয়ান করপোরেশনের একটি শিপমেন্ট থেকে দামি ব্র্যান্ডের ৯ পিস পণ্য চুরি হয়। ভুক্তভোগী ফরওয়ার্ডার তাৎক্ষণিক বাফার সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে চুরি করা ব্যক্তিকে শনাক্ত করেন।
পরে পরিচয় অনুসন্ধানে জানা যায়, অভিযুক্ত ব্যক্তি বিমান সিকিউরিটি অফিসে খাদ্য সরবরাহকারী হিসেবে কাজ করেন। আরও জানা যায়, তিনি স্থায়ী কর্মচারী নন। এমনকি কার্গো ভিলেজে প্রবেশের পাশও নেই তার। অথচ দীর্ঘদিন ধরে সেখানেই কাজ করছেন। শেষ অবধি বিমান বাহিনী একাডেমির (বাফা) সুপারভাইজারের সহায়তায় চুরি হওয়া পণ্যের মধ্যে ছয় পিস ফেরত আনা সম্ভব হয়। সিসিটিভি ফুটেজে বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সবার চোখের সামনে দিয়েই চোরাই পণ্য নিয়ে তিনি প্রধান প্রবেশপথ পেরিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কার্গো ভিলেজসহ বিমানবন্দরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানের বেশকিছু সিসিটিভি ক্যামেরা অচল হয়ে পড়েছে। কিছু কিছু নষ্ট হয়েছে বা ভেঙে গিয়ে ঝুলে পড়েছে। আবার কিছু ক্যামেরা স্থির অবস্থায় থাকায় চারপাশের কভারেজ পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া ছাদে ক্যামেরা স্থাপন না থাকায় কার্গো স্তূপের আড়ালের ফুটেজে ধরা পড়ছে না। ফলে চোর চক্র তাদের চোরাই পণ্য নিরাপদে সরিয়ে নিতে সক্ষম হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কার্গো ভিলেজে কর্মরত কিছু বাফা সদস্য কোম্পানির লোডার ছাড়াও বিমানের লোডাররা এসব চোর সিন্ডিকেট সম্পর্কে বিশেষভাবে অবগত। লোডারদের অনেকে এসব সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িতও আছেন। এমনকি এসব চক্র সম্পর্কে বিমান কর্তৃপক্ষ, সিভিল এভিয়েশন ও বিমান সিকিউরিটি কর্মকর্তাদের কাছে তথ্য আছে। তাদেরও কেউ কেউ এই চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারেন।
কার্গো ভিলেজ থেকে রপ্তানি পণ্য চুরির ঘটনায় দফায় দফায় লিখিত অভিযোগ দিলেও কার্যকর কোনো প্রতিকার পাচ্ছে না বিমানে পণ্য পরিবহনে যুক্ত বিভিন্ন ফরওয়ার্ডিং কোম্পানি। রপ্তানি কার্গো ভিলেজের মহাব্যবস্থাপকের কাছে গত ১৪ অক্টোবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন টাওয়ার ফ্রেইট লজিস্টিক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। গেল বছরের ২১ মার্চ একই ধরনের লিখিত অভিযোগ দিয়েছিল কোম্পানিটি। সর্বশেষ কার্গো ভিলেজে চুরির ঘটনায় ৬ নভেম্বর আবারও তিনি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। তবে এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বলে ক্ষোভ বাফা ও ফরওয়ার্ডারদের। ফলে তারা বছরের পর বছর ধরে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। সেই সঙ্গে রপ্তানি আদেশ বাতিল হয়ে চলে যাচ্ছে প্রতিযোগী দেশগুলোতে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিমানবন্দরের মতো সবচেয়ে স্পর্শকাতর ও উচ্চ নিরাপত্তার স্থানে অপরাধী চক্র অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠার কারণে দেশের আর্থিক ক্ষতি যেমন হচ্ছে, তেমনি বিমানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রশ্নের মুখে পড়ছে। শুধু তাই নয়, বৈশ্বিকভাবে দেশের ভাবমূর্তিও নষ্ট হচ্ছে। অত্যন্ত উদ্বেগজনক এমন পরিস্থিতিতে দেশের রপ্তানি বাণিজ্য ও বিমানবন্দরের সুনাম রক্ষায় কর্তৃপক্ষের দ্রুত, দৃশ্যমান ও কার্যকর পদক্ষেপ সময়ের দাবি বলে মনে করছেন তারা।
এ ব্যাপারে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কার্গোর জেনারেল ম্যানেজার এ বি বি নোজমুল হুদার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিমানের জনসংযোগ বিভাগে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক বোসরা ইসলামকে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের বাফার ইনচার্জ আবু বকর সিদ্দিককে ফোনে যোগাযোগ করা হলে সাংবাদিক পরিচয় জেনে ফোনের লাইন কেটে দেন।
প্রসঙ্গত, ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে গত ১৮ অক্টোবর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর সিলগালা করা স্ট্রংরুমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য আমদানি করা বেশকিছু আগ্নেয়াস্ত্র রাখা ছিল। তবে সেই সিলগালা অবস্থাতেই স্ট্রংরুমে তালা ভাঙার ঘটনা ঘটে। গত ২৭ অক্টোবর সেই ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় জিডি হলে ৪ নভেম্বর তা প্রকাশ পায়। অনেকের আশঙ্কা, স্ট্রংরুম থেকে কয়েকটি অস্ত্র চুরি গেছে। সেই ঘটনার রেশ শেষ না হতেই কার্গো ভিলেজে ভস্মীভূত দ্রব্যের মধ্যে থাকা ১৫টি বাটন ফোন লুকিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন দায়িত্বে নিয়োজিত জেনারুল নামের এক আনসার সদস্য। গত ৫ নভেম্বরের সেই ঘটনায় পরদিন ৬ নভেম্বর তাকে আটক করা হয়।




