ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে জাপানের কাছ থেকে যা শিখতে পারে বাংলাদেশ

অনলাইন ডেস্ক: গত ২১ নভেম্বর সকালে ভূমিকম্পের ঝাঁকুনিতে গোটা বাংলাদেশে যে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে সপ্তাহ পেরিয়েও তা থেকে বের হতে পারেননি অনেকে। এক সপ্তাহের মধ্যে ছয়বার কম্পন অনুভূত হওয়ায় বলতে গেলে আতঙ্ক ফিরে ফিরে এসেছে। ফলে ভূমিকম্প নিয়ে নানা প্রশ্ন জানতে চাইছে মানুষ।

বাংলাদেশের কাছাকাছিই এমন দেশ রয়েছে যেখানে ভূমিকম্প প্রায় নিত্যদিনের ব্যাপার। দেশটি বাংলাদেশের পূর্বদিকের একটু দূরবর্তী প্রতিবেশী জাপান। সে দেশে বছরে প্রায় দেড় হাজারের মতো ভূমিকম্প হয়, সুনামির সতর্কতাও দেওয়া হয় বিভিন্ন সময়। তো, জাপান কীভাবে ভূমিকম্পের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে? দেশটিতে অসংখ্য বহুতল ভবনও রয়েছে। নিয়মিত ভূমিকম্পের মধ্যে থাকা একটি দেশ আকাশচুম্বী ভবন নির্মাণে কোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করে কিংবা কোন বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখে? এবং এক সপ্তাহের মধ্যে কয়েকটি ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠা বাংলাদেশ জাপানের কাছ থেকে কী শিখতে পারে? তার আগে জেনে নেওয়া যাক, জাপানে এত ভূমিকম্প কেন হয়।

জাপানি দ্বীপপুঞ্জ প্রশান্ত মহাসাগরের ‘রিং অব ফায়ার’-এর ওপর অবস্থিত। যেখানে ইউরেশিয়ান, ফিলিপাইন এবং প্যাসিফিক টেকটোনিক প্লেট মিলিত হয়েছে। অর্থাৎ, জাপান তিনটি মিলিত টেকটোনিক প্লেটের ওপর অবস্থান করছে। এটিকে পৃথিবীতে ভূতাত্ত্বিকভাবে সবচেয়ে সক্রিয় অঞ্চল বলা হয়। এই ভূতাত্ত্বিক অস্থিতিশীলতার কারণেই জাপানে এত ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর মধ্যে অনেক ছোট ভূমিকম্প সাধারণ মানুষ হয়তো টেরই পায় না, আর মাঝারি ধরনের ভূমিকম্প দেশটিতে একরকম স্বাভাবিক ঘটনা। তবে, অনেকবার বড় ভূমিকম্পের সংক্ষীও হয়েছে জাপান
জাপান থেকে শেখার যা আছে বাংলাদেশে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রায় প্রতি বছরই আবির্ভূত হয়। আর তা হয় এখানকার আবহাওয়া ও ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে। দুর্যোগ হিসেবে ভূমিকম্প এখানে কন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের মতো নিয়মিত নয়। দেশটিতে সরকারি ও নাগরিক পর্যায়ে বন্যা বা ঘূর্ণিঝড় নিয়ে যতটুকু প্রস্তুতি থাকে, ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে ততটুকুও নেই। বাংলাদেশে ভূমিকম্পে ঝাঁকুনির মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা ছাড়া এ নিয়ে আর কোনো ধারণা পাওয়া যায় না সাধারণ আলাপচারিতায়। এমন প্রেক্ষাপটে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভূমিকম্পের বিষয়ে জাপানের কাছ থেকে বাংলাদেশের অনেক কিছু শেখার আছে।

জাপানের সঙ্গে আর্থসামাজিক পার্থক্যকে বিবেচনায় রেখেও তারা বলছেন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করুর মতো কিছু বিষয়ে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশটিকে অনুসরণ করতে পারে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের একজন ভূতত্ত্ববিদ ও ভূমিকম্প বিষয়ক বিশেষজ্ঞ সৈয়দ হুমায়ূন আখতার বিবিসি বাংলাকে বলেন, গত ২১ নভেম্বরের ভূমিকম্প বাংলাদেশ যেভাবে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল, জাপানের নাগরিকরা সাধারণত সেভাবে ভয় পান না। তার জন্য, প্রতিনিয়ত ভূমিকম্পের মুখোমুখি হওয়াকেই একমাত্র কারণ বলে মনে করেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের এই অধ্যাপক। বরং, ‘সচেতনতা ও প্রস্তুতি’র কারণেই সেটি সম্ভব হয়েছে, যোগ করেন তিনি।

অধ্যাপক আখতার যে ‘প্রস্তুতি’র কথা বলছিলেন একেবারে অল্প বয়স থেকেই প্রতিটি জাপানি নাগরিক তার মধ্য দিয়ে যায় বলে জানান বাংলাদেশি স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব। তিনি বলেন, জাপানে একটা বাচ্চা জন্মের পর থেকেই ভূমিকম্পের বিষয়ে শেখা শুরু হয়। নিয়মিত মহড়ার মধ্য দিয়ে তারা জানে তাৎক্ষণিক কী করতে হবে। শৈশবে ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতির জন্য স্কুলগুলোতেও নিয়মিত মহড়া হয়। শিশুরা মহড়ায় ডেস্কের নিচে আশ্রয় নেওয়ার অনুশীলন করে। ভূমিকম্পের পরপর তার নিরাপদ আশ্রয়ের স্থান কোথায় হবে তা সম্পর্কেও ধারণা দেওয়া হয় তাদের। সাধারণত ১৫ দিন পরপর এ ধরনের অনুশীলন হয় বলে জানা যায়।

নিয়মিত ড্রিল (মহড়া) করতে বিশেষ অর্থের প্রয়োজন নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য জয়গায় সেটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করা যেতে পারে বলে মনে করেন অধ্যাপক হুমায়ূন আখতার। জাপানে নিকটতম আশ্রয়কেন্দ্র যেমন পার্ক বা খেলার মাঠ কোথায় অবস্থিত সে সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করা থাকে, যাতে তারা ভবন থেকে নিরাপদ জায়গায় সরে আসতে পারে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য বড় শহরগুলোতে তেমন নিরাপদ জায়গা নিশ্চিত করা ও সেটি সম্পর্কে সবাইকে অবগত করার কথা বলছেন স্থপতি ইকবাল হাবিব।

জাপানে অবকাঠামোগত নিরাপত্তাব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে। বড় শহরের উঁচু ভবনগুলো এমনভাবে নকশা করা হয়েছে যাতে ভূমিকম্পের সময় সেগুলো কঁপে না, বরং দুলতে থাকে, যা এগুলোকে নিরাপদ করে তোলে। বাংলাদেশে তেমন সুউচ্চ ভবন অপেক্ষাকৃত কম। স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, বাংলাদেশেও সাধারণত সুউচ্চ ভবনগুলো বিল্ডিং কোড মেনে ভূমিকম্প সহনীয় হিসেবে নির্মাণ করা হয়। ‘কিন্তু, অপেক্ষাকৃত ছোট ব্যক্তি মালিকানাধীন ভবনগুলোর ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড মানা হয় না এবং ভূমিকম্পের আঘাত সামলানোর মতো নির্মাণশেলী প্রয়োগ করা হয় না। এই ভবনগুলোই অপেক্ষাকৃত ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেন হাবিব। এক্ষেত্রেও জাপানকে অনুসরণ করে ‘অবকাঠামোগত নিরাপত্তা কার্যকর’ করার ওপর জোর দেন তিনি। এছাড়া রেজিলিয়েন্স প্ল্যান বা পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা কার্যকর করা জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
জাপানে আকাশচুম্বী ভবনগুলো কীভাবে টিকে থাকে বছর জুড়ে শত শত কম্পম্প সহ্য করার পরও জাপান কী করে বিশ্বের সবচেয়ে ‘স্থিতিস্থাপক’ ভবনগুলোর আবাসস্থল, তা একটি কৌতূহলের বিষয়। স্থিতিস্থাপকতার মানে হলো, কোনো আঘাত বা চাপের ফলে কিছুটা সরে আবার আগের অবস্থানে ফিরে আসার ক্ষমতা। জাপানের ভবনগুলোর স্থিতিস্থাপকতার রহস্য লুকিয়ে আছে মূলত মাটির নিচে ‘নেচে ওঠার’ ক্ষমতায়। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার ও সহযোগী অধ্যাপক জুন সাতো বলেন, জাপানের টাওয়ার ব্লকগুলো সাধারণ ভবন নয়। দেশটিতে সব ভবন, ছোট বা অস্থায়ী হলেও ভূমিকম্প-সহনশীল হতে হয়।

ইঞ্জিনিয়াররা দুটি প্রধান পর্যায়ে স্থিতিস্থাপকতা নিয়ে কাজ করেন বলে জানা যায়। প্রথম পর্যায় হলো স্বল্প মাত্রার ভূমিকম্প সহ্য করা। তেমন ভূমিকম্পে মেরামত করার মতো কোনো ক্ষতি হওয়ার কথা নয়। ভবনের নকশা এমনভাবে করা হয় যাতে এসব ভূমিকম্পে কোনো ক্ষতি না হয়। দ্বিতীয় পর্যায় হলো, ভয়াবহ ভূমিকম্প সহ্য করা, যা অপেক্ষাকৃত বিরল। এক্ষেত্রে মানদণ্ড হিসেবে ধরা হয়য় জাপানের ইতিহাসে অন্যতম প্রলয়ংকরী গ্রেট কান্তো ভূমিকম্পকে। ১৯২৩ সালের ৭ দশমিক ৯ মাত্রার এই ভূমিকম্পে টোকিও ও ইয়োকোহামা বিধ্বস্ত হয় এবং এক লাখ ৪০ হাজারের এর বেশি মানুষ নিহত হয়। এই মাত্রা বা তার চেয়ে বড় ভূমিকম্পে ভবনকে সম্পূর্ণ অক্ষত রাখা আর লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয় না। প্রাণহানি এড়ানোই মূল লক্ষ্য।

ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ জিপি লুববেলভস্কি বলেন, আপনি ভবনগুলো মানুষের জীবন রক্ষার জন্য নকশা করেন। এটাই এক্ষেত্রে ন্যূনতম শর্ত। আর সাতোর মতে, যখন কোনো কাঠামো ভূমিকম্পের সব শক্তি সহ্য করতে বা শুষে নিতে পারে, তখনই আর এটি ধসে পড়বে না। সিসমিক আইসোলেশন নামে একটি প্রক্রিয়া এক্ষেত্রে কাজ করে।

ভবনগুলোকে এমন এক ধরনের বিয়ারিং বা শক অ্যাবজরবার (আঘাত সহনীয় বস্তু) এর ওপর বসানো হয় যা ভূমিকম্পের প্রভাবে নড়াচড়া প্রতিরোধ করে। কখনো কখনো ৩০ থেকে ৫০ সেমি পুরু রাবারের ব্লক ব্যবহার করা হয়। যেখানে ভবনের কলাম ফাউন্ডেশন বা ভিত্তির সঙ্গে জুড়ে থাকে, সেখানে এই রাবার প্যাড বসানো হয়। এছাড়া, মোশন ড্যাম্পার ও মেশ স্ট্রাকচারের মতো বিভিন্ন প্রযুক্তিও প্রয়োগ করা হয় ভূমিকম্প সহনশীলতা বাড়াতে।

লুবকোভস্কি বলেন, মোশন ড্যাম্পারগুলো দেখতে অনেকটা সাইকেলের পাম্পের মতো, তবে এতে বাতাসের বদলে তরল থাকে। তিনি বলেন, একটি উঁচু ভবন হয়তো দেড় মিটার বা পাঁচ ফুট নড়তে পারে। কিন্তু যদি নির্দিষ্ট স্তরে, প্রতি দ্বিতীয় তলায় ড্যাম্পার বসানো হয়, তবে সেই নড়াচড়া অনেক কমে যায়। ফলে সুপারস্ট্রাকচারের (ওপরের কাঠামোর) ক্ষতি রোধ হয়। আর, মেশ স্ট্রাকচার ব্যবহার ভবনের সাপোর্টগুলোকে বাঁকানো থেকে রক্ষা করে। যদি একটি অংশ বাঁকতে শুরু করে, কাছাকাছি থাকা অন্য অংশ তা ঠেকায়। এসব প্রযুক্তি ও প্রকৌশলের কাজে লাগিয়েই দিনের পর দিন ভূমিকম্পের সঙ্গে বসবাস করে আসছে জাপানিরা। যদিও বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতা বিবেচনায় সুউচ্চ ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে এসব প্রযুক্তির চেয়ে প্রস্তুতিমূলক মহড়া ও সচেতনতা বৃদ্ধির ওপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রচলিত আইন ও বিধিবিধান যাতে সবাই মেনে চলেন তা নিশ্চিত করার তাগিদ তাদের। ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ও নগর পরিকল্পনাবিদদের অভিমত, এসব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি -বিবিসি

Related Articles

Back to top button