রক্তে যার তেজ, সেই মারুফার চোখে অশ্রু

অনলাইন ডেস্ক: গেল কিছুদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হরহামেশায় একটি ছবি চোখে পড়ে, কর্দমাক্ত জমিতে বাবার সঙ্গে হাল চাষ করছেন একটি মেয়ে। প্রথম দেখায় চিনতে একটু কষ্ট হলেও আপনি যদি দেশের ক্রিকেটে নজর রাখেন, তাহলে চিনতে খুব একটা অসুবিধা হওয়ার কথা না। তিনি হচ্ছেন বাংলাদেশ নারী দলের তারকা পেসার মারুফা আক্তার।
ভারত এবং শ্রীলঙ্কায় চলছে নারী ওয়ানডে বিশ্বকাপ। বৈশ্বিক আসরে বাংলাদেশ কিংবা বাংলাদেশি খেলোয়াড়দের নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয় না। তবে ২২ গজে মারুফা বল হাতে যা করছেন, তাতে বড় বড় ক্রিকেটবোদ্ধাদের প্রশংসা কুড়াচ্ছেন বাংলাদেশের মারুফা।
চলমান আসরের প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানকে হারিয়েছে বাংলাদেশের মেয়েরা। এই জয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন মারুফা। দ্বিতীয় ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে না জিতলেও লড়াই করেছে টাইগ্রেসরা। শুরুতে দুই উইকেট নিয়ে ইংলিশ শিবিরে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলেন মারুফা। তবে ইনজুরির কারণে পাঁচ ওভার বল করে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল তাকে। অনেকের মতে, সেই ম্যাচে মারুফা ইনজুরি নিয়ে মাঠ না ছাড়লে গল্পটা ভিন্ন হতে পারত।
তবে এই মারুফাকে ক্রিকেটার মারুফা হয়ে ওঠার পথটা মোটেও মসৃণ ছিল না। চরম দারিদ্র্যতাকে পেছনে পেলে মারুফা এখন নেতৃত্ব দিচ্ছেন ক্রিকেট বিশ্বে। সম্প্রতি আইসিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নিজের উঠে আসা এবং সংগ্রামের গল্প বলতে গিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন মারুফা। তার চোখ বেড়ে পড়ছিল অশ্রু। এই অশ্রু যতটা কষ্টের ছিল তার চেয়ে বেশি ছিল আনন্দের।
২০০৫ সালে নীলফামারীর সৈয়দপুরের দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন মারুফা আক্তার। ৬ সদস্যদের পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন ক্রিকেটার মারুফার বাবা। নিজেদের জমি না থাকায় অন্যের জমিতে বর্গা চাষ করতেন তিনি। বাবার কাজে সাহায্য করতেন মারুফারাও আর্থিক দুর্দশার কারণে ভালো জামাকাপড় গায়ে জড়াতে পারতেন না। যার কারণে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে আত্মীয়রা তেমন ডাকতেন না তাদের।
আইসিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মারুফা বলেন, ‘কোথাও যদি বিয়ে বা কোনো কিছু (অনুষ্ঠান) হয়, দাওয়াত দেয় না? আমাদেরকে সেটাও দিতো না। বলত ওদের ড্রেস নাই, ঐ খানে গেলে আমাদের মান-সম্মান থাকবে না। এরকম বলত অনেকে। একটা সময় ছিল যখন আমরা ঈদেও নতুন জামা কিনতে পারিনি।’
নিজের পরিবার নিয়ে আলাদা করে মারুফা বলেন, ‘আমার বাবা একজন কৃষক। আমাদের ঐ রকম পয়সাকড়ি ছিল না। আব্বা যখন বাসায় থাকত না, বাজারে যেত, তখন মাকে এসে অনেকে অনেক কথা বলত। অনেক খারাপ খারাপ কথা বলত, যেগুলো মেনে নেওয়ার মতো না। আমার মা রুমে গিয়ে কান্না করত। আমি আবার গিয়ে এক কোণায় কান্না করতাম, যে আমার জন্য এতকিছু হচ্ছে।’
মারুফা আজ বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে। তবে তার এই পথচলায় সমাজের মানুষের কটু কথাও কম শুনতে হয়নি, তবে দমে যাননি তিনি। নিজের ইচ্ছেশক্তি এবং অদম্য মানসিকতা তাকে আজকের অবস্থানে নিয়ে আসছে। তিনি বলেন, ‘আমি ভাবতাম আমি একদিন ভালো কিছু করে দেখাব। এখন আমরা যেরকম অবস্থাতে এসেছি, অন্যরা এখন সেরকম জায়গায় নেই। আমি যেভাবে ফ্যামিলিকে সাপোর্ট করছি, অনেক ছেলেরাও হয়তো সেভাবে পারছে না। এটা অন্যরকম একটা শান্তি দেয়। ছোটবেলায় ভেবেছি মানুষ কবে আমাদের এভাবে দেখবে, হাততালি দিবে। কিন্তু এখন টিভিতে নিজেকে দেখলে লজ্জা লাগে (হাসি)।’