র‍্যাবের বিলুপ্তি ও পুলিশ কমিশন চায় বিএনপি

নিজস্ব প্রতিবেদক: দুই দশক আগে বিএনপি সরকারের সময় দেশের অভ্যন্তরীণ জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমনের লক্ষ্যে গঠিত বাংলাদেশ পুলিশের স্পেশাল ইউনিট র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র‍্যাবের বিলুপ্তি চেয়েছে দলটি। গতকাল মঙ্গলবার সকালে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির গঠিত পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিটির প্রধান ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহমদ সুপারিশমালা তুলে ধরেন। অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেনের কাছে পুলিশকে জনবান্ধব ও মানবিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে ‘পুলিশ কমিশন’ গঠন এবং ‘র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) বিলুপ্তি চেয়ে এ সংক্রান্ত সংস্কার প্রস্তাব ও সুপারিশ জমা দিয়েছে বিএনপি।

হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেন, এই সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে পুলিশ বিভাগের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নানা অসংগতি ও অনিয়ম দূর হবে। র‍্যাবের অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য এই বাহিনীকে বিলুপ্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। বিএনপি নিজেদের আমলে গঠিত এই বাহিনীকে সংস্কার না করে কেন বিলুপ্ত করতে চায়, প্রশ্ন করা হলে হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেন, র‍্যাব আন্তর্জাতিকভাবে নিন্দিত হয়েছে, আর দেশে তো র‍্যাব মানেই একটা দানব তৈরি করা হয়েছে। যত ধরনের খুন-গুম, যত এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিং (বিচারবহির্ভূত হত্যা), অধিকাংশই এই র‍্যাব বাহিনীর মাধ্যমে হয়েছে। সে জন্য আমরা এটিকে বিলুপ্ত করার সুপারিশ করেছি। এই মুহূর্তে র‍্যাবকে বিলুপ্ত করা হলে জনগণের কাছে একটা ভালো সিগন্যাল যাবে বলে মনে করেন হাফিজ। তিনি বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিটিরও এর প্রতি নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব এস এম জহিরুল ইসলাম, সাবেক আইজিপি আবদুল কাইয়ুম, আশরাফুল হুদা, সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সাঈদ হাসান খান ও আনসার উদ্দিন খান পাঠান উপস্থিত ছিলেন।

প্রসঙ্গত, ২০০৪ সালে পুলিশের একটি বিশেষায়িত ইউনিট গঠন করার প্রক্রিয়া শুরু করে তৎকালীন বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার। ঐ বছরের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের প্যারেডে কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণের মাধ্যমে এলিট ফোর্স র‍্যাবের আত্মপ্রকাশ ঘটে। দি আর্মড পুলিশ অর্ডিন্যান্স ১৯৭৯ (সংশোধনী ২০০৪) অনুসারে বাংলাদেশ পুলিশ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ নৌবাহিনী, বাংলাদেশ বিমান বাহিনী, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড সদস্যদের নিয়ে র‍্যাব গঠিত হয়। র‍্যাবের সদর দপ্তর ঢাকার উত্তরায় অবস্থিত। মূলত দেশে জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমন এবং আইনশৃঙ্খলার মানোন্নয়নে গঠন করা হয়েছিল র‍্যাব। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে এই প্রতিষ্ঠানটি রীতিমতো দানবে পরিণত হয়। গত ১৫ বছরে বহু খুন-গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় র‍্যাব জড়িত ছিল বলে সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে ডেথ স্কোয়াড বলে অভিহিত করা হয়।

পুলিশ সংস্কারে পাঁচ সুপারিশ :পুলিশ বাহিনীর সংস্কারের জন্য বিএনপি পাঁচটি প্রস্তাবনা দিয়েছে। এর মধ্যে র‍্যাব বিলুপ্তির সুপারিশও রয়েছে। প্রস্তাবে বিএনপি উল্লেখ করেছে, পুলিশ বাহিনীকে সঠিক দিকনির্দেশনা, পরামর্শ এবং সহায়তা দেওয়ার জন্য একটি পুলিশ কমিশন গঠন করা প্রয়োজন। হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘তাদের (পুলিশ বাহিনী) ক্লোজড মনিটরিংয়ের (নিবিড় পর্যবেক্ষণ) জন্য পুলিশ কমিশন থাকবে…এই কমিশন ওয়াচ ডগ হিসেবে কাজ করবে। উপজেলা পর্যায়ে নাগরিক কমিটি থাকবে, সেখানে স্থানীয় জনগণ মিলে পুলিশের কর্মকাণ্ড দেখবে এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবে। সর্বশেষে গ্রামাঞ্চলে প্রতিটি ইউনিয়নে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের জন্য আমরা সুপারিশ করেছি।’

সুপারিশে বলা হয়েছে, পুলিশ কমিশনের চেয়ারম্যান হবেন সংসদ থাকলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান। সংসদ না থাকলে অন্তর্বর্তী সরকারের সময় চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক। আট সদস্যের এই কমিশনে থাকবেন সরকার ও বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, উচ্চ আদালতের আইনজীবী, সমাজের বিশিষ্ট নাগরিক এবং স্বরাষ্ট্র সচিব মনোনীত অতিরিক্ত সচিব। আইজিপির মনোনীত একজন অতিরিক্ত আইজি এই কমিশনের সদস্যসচিব হিসেবে কাজ করবেন। সরকারি বিধিবিধান দ্বারা এই কমিশনের সদস্য নির্বাচন পদ্ধতি, কাজের পরিধি ও কর্মকাল নির্ধারণ করা হবে।

স্থানীয় পর্যায়ে পুলিশকে অপরাধ দমনে সহায়তা প্রদান, জনসাধারণ-পুলিশ সম্পর্ক উন্নয়নে এবং সংশ্লিষ্ট এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পরামর্শ দিতে প্রতিটি উপজেলা/থানায় একটি নাগরিক কমিটি গঠন করা হবে। স্থানীয় গণ্যমান্য, সুশিক্ষিত ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিবর্গ সমন্বয়ে এই কমিটি গঠিত হবে। গ্রামাঞ্চলে প্রতিটি ইউনিয়নে এবং শহরাঞ্চলে প্রতিটি ওয়ার্ডে কমপক্ষে একজন অবসরপ্রাপ্ত কমিউনিটি পুলিশ কর্মকর্তা (সাব-ইন্সপেক্টর পদের নিচে নয়) নিয়োজিত হবেন। সংশ্লিষ্ট এলাকায় তার একটি অস্থায়ী দপ্তর থাকবে। কমিউনিটি পুলিশ অফিসারের বেতন-ভাতা সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষ বহন করবে। প্রতি বছর পুলিশ সদস্যদের সম্পদের হিসাব বিবরণী দাখিল করতে হবে। প্রতিটি জেলায় পূর্ণাঙ্গ পুলিশ হাসপাতালসহ বিভাগ ও মেট্রোপলিটন শহরে ঢাকার রাজারবাগ কেন্দ্রীয় হাসপাতালের মতো পুলিশ হাসপাতাল নির্মাণেরও সুপারিশ করেছে বিএনপি।

Related Articles

Back to top button