রক্ষণাবেক্ষণের দায় নিয়ে লুকোচুরি: বেবিচক-আইইএবি দ্বন্দ্বে সত্য আড়ালে

- ইজারা চুক্তি অনুযায়ী রক্ষণাবেক্ষণের দায় কুরিয়ার সংস্থাগুলোর— বেবিচক
- দুই বছর আগে বেবিচক নিজেরাই দায়িত্ব নিয়ে নেয়— আইইএবি
- অবহেলা, শর্টসার্কিট ও তদারকির ব্যর্থতা মিলেই ঘটিয়েছে এ দুর্ঘটনা
অনলাইন ডেস্ক: হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো হাউসে সাম্প্রতিক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর দায়বদ্ধতা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায় নিয়ে এখন চলছে ঠেলাঠেলি ও দোষারোপের খেলা। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) এবং কার্গো হাউসের একটি অংশের ইজারাদার ইন্টারন্যাশনাল এয়ার এক্সপ্রেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইইএবি)— এই তিন পক্ষই এখন দায় এড়াতে একে অপরের দিকে আঙুল তুলছে।
ফায়ার সার্ভিসের প্রাথমিক তথ্যমতে, আগুন লাগে কার্গো হাউস কমপ্লেক্সের উত্তর পাশে কুরিয়ার ইউনিটে। দুপুর আড়াইটার দিকে কর্মীরা ধোঁয়া দেখতে পেয়ে খবর দেন। টানা ২৭ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এতে মূল্যবান ইলেকট্রনিকস, পোশাক, ফার্মাসিউটিক্যালসসহ বিপুল পরিমাণ আমদানি পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অগ্নিকাণ্ড তদন্তে বিমান মন্ত্রণালয়, বেবিচক, ফায়ার সার্ভিস ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স— চারটি পৃথক তদন্ত কমিটি কাজ করছে। এদিকে দুর্ঘটনার পর থেকেই শুরু হয়েছে ‘দায়িত্ব কার’ তা নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের জনসংযোগ বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার বোশরা ইসলাম বলেন, “যে অংশে আগুন লেগেছে, সেটি কুরিয়ার ইউনিট। ওই অংশের দায়িত্ব সম্পূর্ণ বেবিচকের। বিমান কেবল রপ্তানি ও আমদানি পণ্য হ্যান্ডলিং করে; রক্ষণাবেক্ষণ আমাদের আওতায় নয়।”
তিনি আরও জানিয়েছে, তাদের ‘ইমপোর্ট কার্গো সিকিউরিটি প্রোগ্রাম’ বা ‘কার্গো অপারেশন ম্যানুয়াল’-এ কুরিয়ার ইউনিটের নিরাপত্তা বা রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে কোনো বিধান নেই। কার্গো হাউস কমপ্লেক্সের কুরিয়ার অংশটি বেবিচক কুরিয়ার সংস্থাগুলোকে ভাড়া দিয়েছে, ফলে নিরাপত্তার দায়ও বেবিচকের।
অন্যদিকে বেবিচক বলছে, ২০১৩ সালে কার্গো হাউজে বড় ধরনের আগুন লাগার পর পুরো ব্যবস্থাপনা আমরা নিজেরা হাতে নিয়েছিলাম। কিন্তু পরে কার্গো ইউনিটের একটি অংশ লিজ দেওয়া হয় কুরিয়ার অ্যাসোসিয়েশনকে। ইজারা চুক্তি অনুযায়ী রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তাদের ওপরই বর্তায়। আগুন লাগার কারণ এখনো নিশ্চিত নয়, তবে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। ভবনের রক্ষণাবেক্ষণ ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা যাদের তত্ত্বাবধানে, তাদের ব্যর্থতার কারণেই এমন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
কুরিয়ার অ্যাসোসিয়েশনের দাবি, ২০১৩ সালের পর তারা বেবিচকের কাছ থেকে কার্গো গুদাম লিজ নেয়, কিন্তু ২ বছর আগে বেবিচক এটার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিয়ে নেয়। ফলে এটার দায়িত্ব বেবিচকের।
এ ছাড়াও ২০২৪ সালের ১৫ই অক্টোবর ইন্টারন্যাশনাল এয়ার এক্সপ্রেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইইএবি)-এর সভাপতি কবির আহমেদ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে (বেবিচক) একটি লিখিত অভিযোগপত্র দেন। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, কার্গো হাউসে বৈদ্যুতিক লাইন, ওয়াশরুম, পরিচ্ছন্নতা, বিভিন্ন খাঁচার রক্ষণাবেক্ষণসহ নানা ধরনের ত্রুটি ও অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে।
তিনি চিঠিতে আরও জানানো হয়, বেবিচক কয়েক মাস ধরে ওয়্যারহাউজ পরিচালনার দায়িত্বে থাকলেও সে সময় এসব প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণমূলক কাজ করা হয়নি। ফলে সেখানে এখনো স্তূপ আকারে ময়লা-আবর্জনা জমে আছে।
অন্যদিকে এক কুরিয়ার মালিক বলেন, “বেবিচক কয়েক মাস ধরে আমাদের চিঠির জবাব দেয়নি। শুধু ভাড়া বাড়ানোর নোটিশ পাঠিয়েছে। বিদ্যুৎ ও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা পুরোটাই তাদের হাতে ছিল।”
আইইএবির ট্রেজারার মোহাম্মদ জাকির হোসেন রিপন বলেন, “২০১৩ সালের পর আমরা বেবিচকের কাছ থেকে লিজ নিয়েছিলাম। তখন নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আমাদের ছিল। কিন্তু দুই বছর আগে বেবিচক নিজেই সেই দায়িত্ব নিয়ে নেয়। তখন জানানো হয়েছিল— ভবনের ভেতরের মেরামত ও বিদ্যুৎ-সংক্রান্ত কাজ তারা করবে।”
তিনি আরও বলেন, “দুই বছর ধরে আমরা কোনো দায়িত্বে নেই। বেবিচককে অন্তত ১৪টি চিঠি দিয়ে অব্যবস্থাপনার কথা জানিয়েছি, কিন্তু কোনো জবাব পাইনি। বরং ভাড়া ২০০ থেকে ৪০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে, যা নিয়ে আদালতে রিট চলছে।”
তুরস্ক থেকে আসা তদন্ত দল পারফিউম বোতলসহ কয়েকটি আলামত সংগ্রহ করেছে। প্রশাসনিক অবহেলা ও বৈদ্যুতিক নিরাপত্তাহীনতা দেখে তারাও বিস্ময় প্রকাশ করেছে।
বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিক বলেন, “আইকাও প্রোটোকল অনুযায়ী শাহজালাল বিমানবন্দরের সব কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ইজারা চুক্তি অনুযায়ী কার্গো হাউসের দায় ইজারা গ্রহীতাদেরই। আগুনের সূত্রপাত আমদানি কুরিয়ার সার্ভিস থেকে হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। রানওয়ের অ্যাপ্রনে পণ্যসামগ্রী স্তূপ করে রাখা হয়েছিল।”
কার্গো হাউসের এই অগ্নিকাণ্ডে প্রকৃত দায় কার— তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে তিন পক্ষের দায়িত্বহীনতা, সমন্বয়হীনতা ও ব্যবস্থাপনার ঘাটতিই অভিভাবকহীন কার্গো কমপ্লেক্স’।




