হামাস নেতাদের ওপর আরও হামলার ইঙ্গিত দিলেন নেতানিয়াহু

অনলাইন ডেস্ক: ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু কাতারে হামাস নেতাদের ওপর সাম্প্রতিক হামলার পর ভবিষ্যতে আরও হামলার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, হামাস নেতাদের জন্য কোনো ধরনের ‘অনাক্রম্যতা’ নেই এবং তারা ‘যেখানেই থাকুক না কেন’ ইসরায়েলের টার্গেট হবেন।

গত রোববার (১৪ সেপ্টেম্বর) জেরুজালেমে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে নেতানিয়াহু এ কথা বলেন।

নেতানিয়াহু যুক্তি দেন, প্রতিটি দেশেরই সীমান্তের বাইরে নিজেদের নিরাপত্তা রক্ষার অধিকার রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র কাতারে হামাস নেতাদের ওপর ইসরায়েলের এই হামলা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও এর কড়া সমালোচনা করেছেন। হামাস জানিয়েছে, এ হামলায় ছয়জন নিহত হলেও তাদের শীর্ষ নেতারা প্রাণে বেঁচে গেছেন।

নেতানিয়াহুর বক্তব্য আসে এমন এক সময়ে, যখন হোয়াইট হাউস এর আগে কাতারকে আশ্বস্ত করেছিল যে, তাদের ভূখণ্ডে আর কোনো হামলা হবে না। হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল কি না—এমন প্রশ্নে নেতানিয়াহু সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা এককভাবে এটি করেছি, ব্যস।’ অন্যদিকে রুবিও বিবিসিকে বলেন, ওয়াশিংটন উপসাগরীয় মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক অটুট রেখেছে। উত্তেজনার মধ্যেও দুই নেতা ঐক্যের বার্তা দেন। রুবিও দুই দেশের প্রযুক্তি ও সংস্কৃতির সম্পর্কের প্রশংসা করেন, আর নেতানিয়াহু বলেন, ইসরায়েলের এর চেয়ে ভালো মিত্র নেই।

কাতারে আর হামলা করবে না ইসরায়েল: ট্রাম্পকাতারে আর হামলা করবে না ইসরায়েল: ট্রাম্প
এই বৈঠকটি আরব নেতাদের শীর্ষ সম্মেলনের সময়ে অনুষ্ঠিত হয়, যা কাতারের প্রতি সংহতি প্রকাশের উদ্দেশ্যে আহ্বান করা হয়েছিল। কাতারের প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দ্বৈত মানদণ্ড বাদ দিয়ে ইসরায়েলকে তার ‘অপরাধের জন্য’ শাস্তি দেওয়ার আহ্বান জানান। পরে, ইসরায়েল আবার কাতারে হামলা চালাবে কি না—এমন প্রশ্নে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দু’বার বলেন, নেতানিয়াহু ‘কাতারে আঘাত করবেন না।’

কাতারে একটি গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন বিমানঘাঁটি রয়েছে, যা গাজা যুদ্ধ বন্ধে কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় দীর্ঘদিন ধরে ভূমিকা রেখে আসছে। ২০১২ সাল থেকে দেশটি হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোকে আশ্রয় দিয়ে আসছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, ইসরায়েল সফর শেষে রুবিও কাতারেও যাবেন। রোববার নেতানিয়াহু বলেন, যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সম্পর্ক ‘ওয়েস্টার্ন ওয়ালের পাথরের মতোই স্থায়ী।’ এরপর দুই নেতা জেরুজালেমের পুরনো শহরের পবিত্র স্থান ‘ওয়েস্টার্ন ওয়াল’ পরিদর্শন করেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হাকাবিও এ সময় তাদের সঙ্গে ছিলেন। রুবিও দেয়ালে একটি নোটও রেখে আসেন, যা দর্শনার্থীদের ঐতিহ্য। তবে সাংবাদিকরা কাতারে ইসরায়েলি হামলা নিয়ে প্রশ্ন করলে তারা এড়িয়ে যান।

নেতানিয়াহু ও রুবিওর বৈঠকে গাজা সিটি দখলের ইসরায়েলি পরিকল্পনা এবং পশ্চিম তীরে বসতি সম্প্রসারণ নিয়েও আলোচনা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত সপ্তাহে ইসরায়েলি বাহিনী গাজা সিটিতে আবাসিক ভবন ধ্বংস অব্যাহত রাখে এবং স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানায়, এখন শহরের পশ্চিমাঞ্চলে স্থল অভিযান শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে সেনারা। বাসিন্দাদের শহর ছেড়ে দক্ষিণের কেন্দ্রীয় এলাকায় যেতে বলা হয়েছে। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, প্রায় আড়াই লাখ ফিলিস্তিনি ইতিমধ্যে সরে গেছেন, যদিও বহু মানুষ এখনও শহরে রয়ে গেছেন।

গাজার বাসিন্দারা বলছেন, দক্ষিণেও নিরাপত্তা নেই, কারণ সেখানেও বিমান হামলা হয়েছে। অনেকেই জানিয়েছেন, তাঁবু বা আশ্রয়ের জায়গা না পেয়ে ফের শহরে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন। গাজা সিটির হাফেজ হাবুস বলেন, ‘তারা বলছে বাড়ি ছেড়ে যেতে, যেন আমরা ভ্রমণে যাচ্ছি। আমাদের কোনো অর্থ নেই, তাঁবু নেই, অস্থায়ী আশ্রয় নেই, পরিবহন নেই। দক্ষিণে যেতে এক চালক ৩০০ শেকেল চায় (প্রায় ৯০ ডলার), অথচ আমার কাছে ১০০ও নেই। আগামীকালের খাবারের টাকা পর্যন্ত নেই, আমরা কীভাবে দক্ষিণে যাব?’

জাতিসংঘ সতর্ক করেছে, যেখানে ইতোমধ্যেই দুর্ভিক্ষ ঘোষণা হয়েছে, সেখানে হামলার তীব্রতা বাড়লে সাধারণ মানুষ আরও ভয়াবহ বিপর্যয়ে পড়বে। নেতানিয়াহু ও রুবিওর এই বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হলো জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের আগ মুহূর্তে। আগামী সপ্তাহে ওই অধিবেশনে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনসহ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বিবেচনা করছে। এ সম্ভাবনা ইসরায়েলের অভ্যন্তরে বিতর্ক আরও বাড়িয়ে তুলেছে। কট্টরপন্থীরা বলছে, ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র ঠেকাতে একমাত্র উপায় হলো পশ্চিম তীরকে ইসরায়েলের সঙ্গে সংযুক্ত করা।

গত আগস্টে ইসরায়েলি সরকার জেরুজালেমের পূর্বে ই১ বসতি প্রকল্প অনুমোদন দেয়, যা পশ্চিম তীরকে কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত করবে। ওই প্রকল্পের চুক্তি স্বাক্ষরের সময় নেতানিয়াহু বলেন, ‘আমরা প্রতিশ্রুতি পূরণ করছি—কোনো ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র হবে না। এই ভূমি আমাদের।’ চলতি মাসেই ইসরায়েলের অতিডানপন্থী অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ পশ্চিম তীরের চার-পঞ্চমাংশ সংযুক্ত করার প্রস্তাব দেন।

১৯৬৭ সালের যুদ্ধে পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম দখলের পর থেকে ইসরায়েল সেখানে প্রায় ১৬০টি বসতি গড়ে তুলেছে, যেখানে প্রায় ৭ লাখ ইহুদি বাস করছে। ফিলিস্তিনিরা গাজাসহ ওই অঞ্চলগুলো নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখছে। আন্তর্জাতিক আইনে এসব বসতি অবৈধ।

সোমবার সন্ধ্যায় রুবিও অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমের সিলওয়ানে ‘সিটি অফ ডেভিড’ প্রত্নতাত্ত্বিক পার্ক পরিদর্শন করবেন। ওই পার্ক বসতি স্থাপনকারী একটি সংগঠন পরিচালনা করে। রুবিও সেখানে ‘তীর্থযাত্রা পথ’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও যোগ দেবেন। এটি ফিলিস্তিনি বাড়ির নিচ দিয়ে খনন করা একটি সুড়ঙ্গ, যা প্রাচীন রোমান যুগের রাস্তা বলে দাবি করা হয়। ইহুদিরা একে টেম্পল মাউন্ট বলে মানে, আর মুসলিমদের কাছে এটি আল-হারাম আল-শরীফ। সমালোচকরা বলছেন, প্রত্নতত্ত্বকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে ফিলিস্তিনি বাসিন্দাদের স্থানচ্যুত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

Related Articles

Back to top button