সড়ক-মহাসড়কে মৃত্যুফাঁদ ফিটনেসবিহীন যানবাহন

  • প্রতিদিন ঘটে যাওয়া সড়ক দুর্ঘটনার প্রায় ২০ শতাংশের জন্য দায়ী আনফিট মোটরযান 
  • ১৭ লাখ যানবাহনের মধ্যে ৭ লাখের নেই হালনাগাদ ফিটনেস

অনলাইন ডেস্ক: মানুষ দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজে যাতায়াতের জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে থাকেন বাস, মিনিবাস, হিউম্যান হলার এবং অটোরিকশা। তবে এসব যানবাহনের বেশির ভাগেরই ফিটনেস সনদ নেই, যা সড়কে যাত্রীদের জন্য এক একটি চলন্ত মৃত্যুফাঁদ তৈরি করছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে প্রতিদিন ঘটে যাওয়া সড়ক দুর্ঘটনার প্রায় ২০ শতাংশের জন্য দায়ী আনফিট মোটরযান। ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কারণে প্রতিদিনই ঘটছে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি।

ফিটনেসবিহীন ও লক্কড় ঝক্কড় যানবাহনের কারণে প্রতিনিয়ত সড়কে দুর্ঘটনার কথা স্বীকার করেছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক (সদর) এ এস আহাম্মেদ খোকন। তিনি বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে আমরাও উদ্বিগ্ন। আমাদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পরিবহন মালিক সমিতিগুলো তাদের সদস্যদের এই ব্যাপারে সচেতন করার জন্য সভা, সেমিনার ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। গাড়ি মালিকদের ফিটনেস সনদ নবায়ন করা এবং গাড়ির প্রয়োজনীয় মেরামত করার জন্য কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন। এ নিয়ে গতকালও (বুধবার) তারা জরুরি বৈঠক করেছেন। পাশাপাশি ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে প্রশাসন যে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, আমরা তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করব।

ফিটনেস সনদ: দেশের প্রচলিত আইনানুযায়ী ফিটনেসবিহীন যানবাহন রাস্তায় চালানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সড়কে গাড়ি চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন অনুমতিপত্রের মধ্যে অন্যতম হলো—ফিটনেস সনদ, যা ইস্যু করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। ফিটনেস পরীক্ষা হয় গাড়ির এক্সেল লোড, টায়ারের বিড, ব্রেক, ধোঁয়া নির্গমন, হেডলাইট, অ্যালাইনমেন্ট, রং, আসন, ইঞ্জিন ও বডির বিভিন্ন বিষয় পর্যালোচনা করে। সবকিছু ঠিক থাকলে গাড়ি পায় ফিটনেস সনদ। বিআরটিএর হিসাব অনুযায়ী, দেশে মোটরযানের সংখ্যা প্রায় ৬৪ লাখ, এর মধ্যে মোটরসাইকেল ৪৭ লাখ। মোটরসাইকেলের ক্ষেত্রে ফিটনেস সনদ বাধ্যতামূলক নয়। ফিটনেস সনদ থাকা বাধ্যতামূলক যানবাহনের সংখ্যা ১৭ লাখের বেশি, কিন্তু এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ৬ লাখ যানবাহনের হালনাগাদ ফিটনেস সনদ নেই।

যানবাহনের পরিস্থিতি: সম্প্রতি দেশে পরিবহনবিষয়ক প্রকাশিত এক তথ্য থেকে জানা যায়, গণপরিবহন হিসেবে ব্যবহার করা বাসের সংখ্যা ৫৬ হাজার ৭৩৩টি, মিনিবাস ২৮ হাজার ৫৬১টি, হিউম্যান হলার ১৭ হাজার ৩৭৪টি। এর মধ্যে ভাড়ার বিনিময়ে নির্দিষ্ট রুটে যাত্রী পরিবহনে ব্যবহৃত ২৩ হাজার ৬৬৫টি বাস, ১১ হাজার ৯০৫টি মিনিবাস ও ১৪ হাজার ৫১০টি হিউম্যান হলারের হালনাগাদ ফিটনেস সনদ নেই। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য বলছে, নিবন্ধিত চুক্তিভিত্তিক পরিবহন হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া অটোরিকশা, অটোটেম্পো ও ট্যাক্সি ক্যাবের সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ ৮০ হাজার। এর মধ্যে অটোরিকশা প্রায় ৩ লাখ ২৭ হাজার, অটোটেম্পো ১৬ হাজার ও ট্যাক্সিক্যাব রয়েছে ৩৬ হাজার। বিআরটিএর তথ্যানুযায়ী, চুক্তিভিত্তিক পরিবহনের ২ লাখ ২৩ হাজারের বেশি মোটরযানের হালনাগাদ ফিটনেস নেই। সারা দেশে প্রায় ২ লাখ ১১ হাজার অটোরিকশার হালনাগাদ ফিটনেস সনদ নেই।

মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন ও সড়কে ঝুঁকি: সরকার বাস ও ট্রাকের ইকোনমিক লাইফ ২০ ও ২৫ বছর নির্ধারণ করে দিয়েছে। বিআরটিএর হিসাবে, ঢাকা মহানগর ও ঢাকা জেলায় ২০ বছরের পুরোনো বাস ও মিনিবাস রয়েছে ১০ হাজার ৫৫৬টি। এর বাইরে সারা দেশে আরও ১৮ হাজার ২০৫টি বাস ও মিনিবাস রয়েছে, যেগুলোর বয়স ২০ বছর বা তার থেকেও বেশি। পাশাপাশি ঢাকা মহানগর ও ঢাকা জেলায় ২৫ বছরের পুরোনো পণ্যবাহী (ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, ট্যাংকলরি) মোটরযানের সংখ্যা ১৪ হাজার ৬৮৩টি। এর বাইরে সারা দেশে আরও ৩১ হাজার ৭৯৮টি পণ্যবাহী মোটরযান রয়েছে, যেগুলোর বয়স ২৫ বছর বা তার থেকেও বেশি। সব মিলিয়ে দেশে মেয়াদোত্তীর্ণ বাস ও ট্রাকের সংখ্যা ৭৫ হাজারের বেশি।

ঝুঁকিতে পড়ছেন যাত্রী এবং পথচারী: ফিটনেসবিহীন মোটরযান সড়ক-মহাসড়কে অবাধে চলাচল করায় নানাবিধ ঝুঁকিতে পড়ছেন যাত্রী এবং পথচারী। যখন তখন স্টার্ট বন্ধ হয়ে কিংবা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলায় বাড়ছে হতাহতের ঘটনা। এসব গাড়ির কালো ধোঁয়া ও বিকট শব্দ পরিবেশ দূষিত করে, ফলে দেশের জনগণ আক্রান্ত হচ্ছে বহুবিধ রোগে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি মাঝ রাস্তায় খারাপ হয়ে যানজট তৈরি করে।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ : বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা সাধারণত দুর্ঘটনার যেসব কারণ দেখি, তার মধ্যে একটি হচ্ছে মেকানিক্যাল ফেইলিওর অব ভেহিকেল। আনফিট গাড়ির মেকানিক্যাল ফেইলর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। সুতরাং দুর্ঘটনা ঘটার এটা একটা অন্যতম কারণ।

বিআরটিএ: ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বিষয়ে পদক্ষেপ প্রসঙ্গে রোড সেফটি শাখার পরিচালক শীতাংশু শেখর বিশ্বাস বলেন, ফিটনেসবিহীন গাড়ির কারণে সড়কে দুর্ঘটনা ও বিশৃঙ্খলা বাড়ছে। তাই, সড়কে শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনতে নিয়মিতভাবে এই ধরনের অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে আমরা নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছি। এবং জরিমানা করা, সেই সঙ্গে কিছু গাড়ি ডাম্পিংয়ে পাঠানো হচ্ছে।

Related Articles

Back to top button