মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি

হতাহতের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক
সঠিক সংখ্যা নির্ধারণে কমিটি গঠন
অনলাইন ডেস্ক: মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কের জন্ম নিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে গতকাল বুধবার পর্যন্ত এ ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বলা হয়েছে ২৯ জন। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, এ ঘটনায় বুধবার পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৩১ জন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী নিহতের সংখ্যা ৩২ জন। এর মধ্যে ছয় জন এখনো অশনাক্ত রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দাবি করা হচ্ছে, এ ঘটনায় নিহতের সংখ্যা শতাধিক। কোথাও কোথাও প্রশাসনের বিরুদ্ধে দাবি করা হচ্ছে, বহু ‘লাশ গুম’ করা হয়েছে।
এ অবস্থায় বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা নিয়ে সর্বশেষ তথ্য তুলে ধরেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল হোসেন। তার সই করা এক পরিসংখ্যানের তথ্যের (টেলিফোনের মাধ্যমে প্রাপ্ত) বরাতে গতকাল বুধবার দুপুরে প্রধান উপদেষ্টার জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব ফয়েজ আহম্মদ এ তথ্য জানান। তিনি জানিয়েছেন, বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় বুধবার দুপুর পৌনে ১টা পর্যন্ত অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৯ জনে। এছাড়া জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন হাসপাতালে অগ্নিদগ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন ৬৯ জন।
পরিসংখ্যান বলছে, নিহত ২৯ জনের মধ্যে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ১১ জন, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ১৫ জন, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে একজন, লুবানা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড কার্ডিয়াক সেন্টারে একজন (পরিচয় জানা যায়নি) ও ইউনাইটেড হাসপাতালে একজন মারা গেছেন।
তথ্য অনুযায়ী, অগ্নিদগ্ধদের মধ্যে বর্তমানে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ৪৪ জন, সিএমএইচে ২১ জন, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে একজন, শহীদ মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে একজন, উত্তরা আধুনিক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে একজন ও হিউম্যান এইড রিসার্চ ল্যাব অ্যান্ড হাসপাতালে একজন চিকিৎসাধীন আছেন।
এর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকেও নিহতের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘আমার বিশ্বাস ও ধারণা, নিহতের সংখ্যা এর চেয়েও আরও বেশি হবে। হয়তো সত্য একদিন আমরা জানব ইনশাআল্লাহ। তারা তাদের মা-বাবার বুকের খাঁচা ভেঙে চলে গেছে। এ সন্তানরা তাদের মা-বাবার বুকে আর আসবে না। আমরা দোয়া করি তাদের যেন আল্লাহ জান্নাত দান করেন। যারা আহত হয়েছে তাদের শেফায়া কুল্লিয়া দান করুন।’
বিমান দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা নিয়ে জামায়াত ইসলামীর আমীরের এই বক্তব্যের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিহতের সংখ্যা নিয়ে সরকারের কঠোর সমালোচনা করা হয়। সন্দেহ করা হয় যে সরকার ঘটনাস্থল থেকে লাশ সরিয়ে ফেলেছে।
যেভাবে অভিযোগের সূত্রপাত:
সোমবার বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের খুঁজতে স্কুলে যান। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাস ঘটনাস্থল সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবের সদস্যরা উদ্ধার কার্যক্রমে অংশ নেয়। নিরাপত্তার স্বার্থে ঘটনাস্থলটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঘিরে ফেলায় উৎসুক জনতার মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। কেউ কেউ অভিযোগ করেন, স্কুলমাঠে হেলিকপটার নামিয়ে ঐ হেলিকপটারে করে লাশ সরিয়ে ফেলা হয়। এরকম অভিযোগ থেকেই ঘটনার দিন বিকালেই স্কুলমাঠে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সঙ্গে সেনাবাহিনীর সদস্যদের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। পরে অবশ্য উভয় পক্ষের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা বলা হচ্ছে:
দুর্ঘটনার দিন সোমবার বিকাল থেকেই ফেসবুক, এক্স (সাবেক টুইটার) ও ইউটিউবে একাধিক পোস্টে দাবি করা হচ্ছে যে, নিহতের সংখ্যা সরকারি হিসাবের চেয়ে বেশি এবং কয়েকটি লাশ ‘অজ্ঞাত কারণে’ গুম করা হয়েছে। একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী লেখেন, ‘সরকার নিহতের সংখ্যা লুকাতে চাইছে। কিছু লাশ সরিয়ে ফেলা হয়েছে।’
সাইবার সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞ মেহরাব হোসেন বলেন, ‘ছবির খণ্ডাংশ, অডিও ক্লিপ ও বানোয়াট পোস্ট ব্যবহার করে জনমনে গুজব ছড়ানো এখন খুব সহজ। দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
কলেজ শিক্ষক যা বলেন:
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক বিলকিস আরা আইরিন বলেন, লাশের সংখ্যা নিয়ে অবশ্যই ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। স্কুলে তো ক্লাস হয়। কোন কোন বাচ্চা ক্লাস করে, কয়টা বাচ্চা ছিল, সেটা তো বের করা খুব সহজ। সেটা আমরা বলতে পারি, এই কয়জন পাওয়া গেছে বা এই কয়জন নাই। এটা করা খুবই সহজ। আমরা চাইলেও কেই সেটাকে বন্ধ করার সিস্টেমই নাই। আর ওরা ছোট মানুষ। তাই ওরা বুঝতে পারেনি। কোনো বাচ্চাকে কি আমি বলতে পারব যে সে কোনদিনই স্কুলে ছিল না—সেটা কি সম্ভব?
বিভ্রান্তি নিরসনে সময় লাগবে:
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান জানিয়েছেন, বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহতদের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি নিরসন হতে আরও সময় লাগবে। তিনি জানান, ‘উত্তরা আধুনিক মেডিক্যাল থেকে একজনের মৃতদেহ সিএমএইচে পাঠানো হয়েছে। সেই সংখ্যাটি নিয়ে আমাদের তথ্যের পার্থক্য দেখা দিয়েছে। আমরা বলেছি ১৫ জন, সিএমএইচে ১৫ জনের মৃতদেহ আছে। যদিও আইএসপিআরের তথ্যে ১৬ জন বলা আছে। তথ্যের পার্থক্যগুলো দূর হতে সময় লাগবে।
প্রেস সচিব যা বলেন:
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ফেসবুকে এক পোস্টে বলেন, অনেক শিক্ষার্থী সরাসরি তাদের অভিজ্ঞতা আমাদের জানিয়েছে এবং মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে অসংগতির জন্য হতাশা প্রকাশ করেছে। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে বাংলাদেশে হতাহতের সংখ্যা গোপন করা কার্যত অসম্ভব। প্রাথমিকভাবে, কেউ নিখোঁজ থাকলে পরিবারগুলো সেটা রিপোর্ট করে। হাসপাতাল ও কর্তৃপক্ষের কাছে তথ্য জানায় এবং সেখান থেকে তারা তাদের প্রিয়জনদের খুঁজে পায়। এই ঘটনায় মাইলস্টোন কলেজ নিখোঁজদের শনাক্ত করার জন্য সেদিনের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির রেকর্ড ক্রস-রেফারেন্স করতে পারে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং যা বলছে:
মর্মান্তিক বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় বিভিন্ন মহল থেকে হতাহতের তথ্য গোপন করা হচ্ছে বলে যে দাবি করা হচ্ছে, সেটিকে ‘অপপ্রচার’ বলে উল্লেখ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ বিষয়ে বলা হয়, ‘আমরা অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে জানাতে চাই—এ দাবি সঠিক নয়।’
বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, মর্মান্তিক এ ঘটনায় আহত-নিহতদের সম্পূর্ণ ও নির্ভুল তালিকা প্রকাশের জন্য বাংলাদেশ সরকার, সেনাবাহিনী প্রশাসন, বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একযোগে কাজ করছে। এর পাশাপাশি, এখনো কেউ নিখোঁজ রয়েছে কিনা তা বিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রি খাতা ও অন্যান্য নথি থেকে যাচাই করে দেখা হচ্ছে।
স্কুল কর্তৃপক্ষের কমিটি গঠন:
হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় করে ঠিকানাসহ তালিকা প্রস্তুত করতে একটি কমিটি গঠন করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। কমিটিতে সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জিয়াউল আলম। এছাড়া সদস্য হিসেবে আছেন মো. মাসুদ আলম, উপাধ্যক্ষ (প্রশাসন) মিসেস খাদিজা আক্তার, প্রধান শিক্ষিকা মিসেস লুত্ফুন্নেসা লোপা, কো-অর্ডিনেটর মনিরুজ্জামান মোল্লা, অভিভাবক (শিক্ষার্থী: যাইমা জাহান, শ্রেণি: চতুর্থ, ক্লাস কোড: ২২৭৪) মারুফ বিন জিয়াউর রহমান ও শিক্ষার্থী তাসনিম ভূঁইয়া প্রতীক । এ কমিটি আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে তাদের কাজ সম্পন্ন করে প্রতিবেদন জমা দিবে।
ইসলামী আন্দোলনের দাবি:
বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় সৃষ্ট সন্দেহ দূর করতে তদন্ত কমিটি গঠন করে তাতে নাগরিকদের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। রাজনৈতিক দলটির মহাসচিব অধ্যক্ষ মাওলানা ইউনুস আহমাদ এক বিবৃতিতে বলেন, মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে অবিশ্বাস শুরু থেকেই তোলা হয়েছে। আহতদের সংখ্যা ও অবস্থা নিয়েও নানা গুঞ্জন বাতাসে ভাসমান। একই সঙ্গে বিধ্বস্ত বিমানের ফিটনেস, পাইলটের দক্ষতা ইত্যাদি নিয়ে নানা রকম সন্দেহ ও অবিশ্বাস ছড়িয়ে পড়েছে। এটা রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্কের জন্য ইতিবাচক বিষয় নয়। সেজন্য প্রকৃত আহত ও নিহতের সংখ্যা নির্ধারণ করার জন্য মাইলস্টোন স্কুলের শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হোক।