দুর্ঘটনার স্মৃতি হাতড়ে ফিরছেন বাবা-মা-স্বজনরা

বার্ন ইনস্টিটিউটের সামনে এখনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় স্বজনরা
অনলাইন ডেস্ক: জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের গেটের কাছে ভিড়। হাসপাতালের প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে থাকা সেনাবাহিনীর সদস্যরা জনসাধারণের প্রবেশ রোধে কাজ করছেন। ৩য় দিনেও ভেতরে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। যে সকল বিভাগে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী আছে, সেসকল বিভাগের সামনে উদ্বিগ্ন মুখে অপেক্ষমাণ মা-বাবা-স্বজনেরা। কেউ কেউ দুর্ঘটনার দিনের স্মৃতি হাতড়ে ফিরছেন। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের একটা বড় অংশ আনা হয় জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। এ সময় হতাহতদের স্বজনদের কাউকে কান্না করতে দেখা যায়। কাউকে উদ্বিগ্ন আবার কাউকে আবেগহীন দেখা যায়। পঞ্চম তলায় ৫২০ নম্বর কক্ষের সামনে আহতদের স্বজনদের সঙ্গে কথা হয়-এই প্রতিনিধির
কোচিংয়ের জন্য অপেক্ষা করে আহত হয় ৪র্থ শ্রেণির কাফি আহমেদ: ৫২০ নম্বর রুমের সামনেই অপেক্ষা করছেন কাফি আহমেদের বোন লামিয়া তাসনিম। জানান তার ভাইয়ের হাতে রক্ত চলাচল বন্ধ আছে। সেদিন কাফিকে নিতে যখন মা কামরুণ নাহার কামেনি স্কুলে চলে এসেছেন তখন ছেলের ক্লাস শেষ। কিন্তু কাফি এসে মাকে জানাল তার এখন কোচিং ক্লাস হবে, সে ক্লাস করেই আসছে। এরই মধ্যে বিমান বিধ্বস্ত হয়। মা কামেনি তখন দিশেহারা হয়ে একে ওকে অনুরোধ করছে ছেলে ও ছেলের সহপাঠীদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে। রক্তাক্ত শিশুরাও তখন এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে বাঁচার আশায়। কামেনি রিকশাওয়ালা, সিএনজিওয়ালাকে নিজের ছেলেসহ ছেলের আহত সহপাঠীদের হাসপাতালে নিয়েযেতে অনুরোধ করছিলেন। কিন্তু সেভাবে কেউ এগিয়ে আসেনি।
লামিয়া বলেন, রিকশা নিয়ে স্কুলে গিয়ে যা দেখেন তাতে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। হাতে পায়ে রক্ত নিয়ে শিশুরা ছোটাছুটি করছে। সেখানে তার মামি তিন জন দর্শনার্থীদের বলেন, আমি তোমাদের হাতে-পায়ে ধরি আমার বাচ্চাদের একটু হাসপাতালে নিতে সাহায্য কর। এই অনুরোধ করলে তারা কামেনিকে সহযোহিতা করেন। প্রথম কাফিসহ আহত শিশুদের উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নেয়া হয়, সেখান থেকে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট নিয়ে যাওয়া হয়। কাফি আহমেদের পুরো মুখমণ্ডল, দুই হাত ও শরীরের কিছু অংশ পুড়ে গেছে, রক্ত চলাছল হচ্ছে না। লামিয়া বলেন, ডান হাতের অবস্থা খুবই খারাপ, চামরা পুড়ে একেবারে হাড়ের সঙ্গে লেগে গেছে। কোথাও কোথাও হাড়ের মধ্যে ঢুকে গেছে।
কয়েক ঘণ্টা পর মেয়ে তাসলিমা খন্দকারকে খুঁজে পান মা আতিয়ার: মা আতিয়ার জানান, তার তিন মেয়েই পড়ে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। বড় মেয়ে ১০ম শ্রেণিতে পড়ে। সেদিন তার পরীক্ষা ছিল, পরীক্ষা শেষে সে বাসায় চলে আসে। দুই মেয়ে তখনো স্কুলে। আর আমি মেয়েদের আনতে স্কুলের পথে। বড় মেয়ের বান্ধবীর মার মাধ্যমে দেড়টার দিকে দুর্ঘটনার কথা জানতে পারি, তারা দেখে এসেছেন। আমি তখন রাস্তায় ছিলাম। আমার মেজো মেয়ে তাসলিমা খন্দকার আহত হয়। আমি তাসলিমার শিক্ষককে ফোন দেই। তাকে ফোনে পাইনি। কারণ তিনিও ক্ষতিগ্রস্ত ছিলেন। ছোট-মেয়ের শিক্ষককে ফোন দিয়ে জানতে পারি মেজো মেয়ে আহত হয়। ওর হাত-পা আগুনে পুড়ে গেছে। পোড়া অবস্থায়ই তাসলিমা ছোট বোনকে দেখতে তার ক্লাসে আসে। ছোট বোন মেজো বোনের আহত অবস্থায় দেখে খুব ভয় পেয়ে যায়। তাসলিমা নিজেই কলের পানি দিয়ে ক্ষতস্থানের রক্ত পরিষ্কার করে। কিন্তু আমি স্কুলে গিয়ে আর তাকে খুঁজে পাইনি। ওদের বাবা বড় মেয়েকে নিয়ে স্কুলে যান। এরই মধ্যে তাসলিমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু মেয়েকে তো খুঁজে পাচ্ছিলাম না। পরে জানতে পারি ওকে বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। আমি আমার স্বামী ও আত্মীয়স্বজনরা বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজে গিয়েও মেজো মেয়েকে খুঁজে পাইনি।
সোলাইমান অপেক্ষা করছিলেন জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট ৬ষ্ঠ তলার করিডোরে। জানান তার ভাই মো. সাইমন হোসেন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের উচ্চমাধ্যমিক বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। শুরু থেকে উদ্ধার কাজে ছিলেন সাইমন। না খাওয়া অবস্থায় ধোঁয়া ও আগুনের তাপে সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। বাবার সঙ্গে দেড়টার দিকে কথা হয় সাইমনের। জানান কোনো অসুবিধা নেই, উদ্ধার কাজে আছেন। কিন্তু বিকাল ৪টার দিকে ফোন আসে ছেলে সাইমন জ্ঞান হারিয়েছেন। তাকে প্রথম উত্তরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পরে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আনা হয়। এখনো তার অবস্থা স্বাভাবিক নয়। ভাই সোলাইমান জানান দীর্ঘ সময় ধোঁয়া ও গ্যাসের মধ্যে থাকার কারণে তার অক্সিজেনের অভাব হয়। সে না খাওয়া অবস্থায় ছিল বলে এর প্রভাবও বেশি পড়ে।