মন্ত্রী টিউলিপের ‘বিকল্প’ নিয়ে ভাবা হচ্ছে

অনলাইন ডেস্ক: যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের স্থলে কাকে দায়িত্ব দেওয়া যায় তা নিয়ে ‘বিকল্প’ ভাবছে দেশটির সরকার। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট সম্ভাব্য কয়েকজন প্রার্থীর নাম বিবেচনায় নিয়ে কাজ করছে। বৃহস্পতিবার যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম দ্য টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।

টিউলিপের পদে যারা আসতে পারেন-তাদের মধ্যে আছেন অর্থমন্ত্রী র‌্যাচেল রিভসের দুই সহযোগী অ্যালিস্টার স্ট্র্যাথার্ন ও ইমোজেন ওয়াকার, প্রযুক্তিবিষয়কমন্ত্রীর পার্লামেন্টারি প্রাইভেট সেক্রেটারি (পিপিএস) ক্যালাম অ্যান্ডারসন, পরিবেশবিষয়কমন্ত্রীর পিপিএস কনিস্ক নারায়ণ, বিচারবিষয়ক মন্ত্রীর পিপিএস জশ সিমন্স ও রাচেল ব্লেক। এছাড়া বিবেচনায় আসতে পারেন অ্যাটর্নি জেনারেল লুসি রিগবি ও অর্থনীতিবিদ টরস্টেন বেল। বেল দেশটির একজন মন্ত্রীর সহকারীও।

বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক বর্তমানে যুক্তরাজ্যের অর্থ মন্ত্রণালয়ের (ট্রেজারি) অর্থনীতিবিষয়কমন্ত্রী (ইকোনমিক সেক্রেটারি)। মন্ত্রী হিসাবে দেশটির আর্থিক খাতের অপরাধ-দুর্নীতি বন্ধের দায়িত্ব তার। হাসিনা সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের জেরে তিনি যদি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন, সে ক্ষেত্রে তার পদে কাকে দায়িত্ব দেওয়া যায়, এজন্য সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম বিবেচনা করছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমারের জ্যেষ্ঠ সহযোগীরা। কয়েকজনের নাম বাছাই করা হয়েছে বলে জানা গেছে। ডাউনিং স্ট্রিটের একটি সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ লোকজনের মধ্য থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে হলেও কেউ টিউলিপের স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন। তবে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, টিউলিপের পদে বিকল্প ব্যক্তিদের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করেছে বলে যে কথা বলা হচ্ছে, তা ‘পুরোপুরি অসত্য’। এর আগে প্রধানমন্ত্রী স্টারমার বলেছিলেন, টিউলিপের ওপর তার আস্থা রয়েছে।

শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকজন ব্যক্তির সম্পত্তি টিউলিপের ব্যবহার করা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ প্রেক্ষাপটে টিউলিপ তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তে সোমবার যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর নীতিনৈতিকতা সম্পর্কিত কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা (ইন্ডিপেনডেন্ট অ্যাডভাইজার অন মিনিস্ট্রিয়াল স্ট্যান্ডার্ডস) লাউরি ম্যাগনাসের কাছে তিনি চিঠি (রেফারেল) লিখেছেন। মন্ত্রীদের আচার-আচরণ, নীতিনৈতিকতা বিষয়ে ম্যাগনাস যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীকে উপদেশ দিয়ে থাকেন।

ম্যাগনাসকে দেওয়া রেফারেলে টিউলিপ বলেছেন, এ বিষয়ে তার অবস্থান স্পষ্ট, তিনি অন্যায় কিছু করেননি। তবে সন্দেহ এড়ানোর জন্য তিনি চান, ম্যাগনাস স্বাধীনভাবে এসব বিষয়-সম্পর্কিত সঠিক তথ্য উদ্ঘাটন করুন। এ কাজের জন্য প্রয়োজনীয় সব তথ্য তিনি অবশ্যই দেবেন। অন্য একটি বিষয়েও প্রশ্নের মুখে টিউলিপ। ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির একটি সূত্র জানায়, অভিযোগ তদন্তের ব্যাপারে টিউলিপের আহ্বান (রেফারেল) ইঙ্গিত দেয় যে তিনি দায় নিয়ে পদত্যাগ করতে ইচ্ছুক। তিনি এ পথে রয়েছেন।

আওয়ামী লীগের একজন সমর্থক টিউলিপকে লন্ডনে ৭ লাখ পাউন্ডের একটি ফ্ল্যাট দিয়েছেন। আরেকজন টিউলিপের বোনকে ৬ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ডের ফ্ল্যাট দিয়েছেন। এসব তথ্য সামনে আসার পর টিউলিপ ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে পড়েন। টিউলিপের একজন মুখপাত্র বলেছেন, সম্পত্তিগুলো আওয়ামী লীগের প্রতি তার সমর্থনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল-এমনটা ধারণা দেওয়াটা ‘স্পষ্টতই ভুল’।

দুর্নীতির অভিযোগে মাল্টার নাগরিকত্ব চেয়েও পাননি চাচি ও চাচাতো বোন : ইউরোপের দেশ মাল্টার নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেছিলেন টিউলিপ সিদ্দিকের চাচা তারিক আহমেদ সিদ্দিকের স্ত্রী শাহীন সিদ্দিক ও তাদের মেয়ে বুশরা সিদ্দিক। ২০১৩ ও ২০১৫ সালে শাহীন সিদ্দিক দুদফায় আবেদন করেন। তবে অর্থ পাচার, দুর্নীতি, প্রতারণা ও ঘুসের অভিযোগ থাকায় তার দুটি আবেদনই প্রত্যাখ্যান করা হয়। তার মেয়ে বুশরা সিদ্দিকের নাগরিকত্বের আবেদনও খারিজ করে মাল্টা কর্তৃপক্ষ। ফাঁস হওয়া নথিপত্রের ভিত্তিতে শুক্রবার যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সংবাদপত্র দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী-মাল্টার নাগরিকত্বের জন্য শাহীন সিদ্দিকের আবেদন নাকচ করে দেয় হেনলি অ্যান্ড পার্টনারস নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ওই সময় মাল্টায় বিনিয়োগের মাধ্যমে বিদেশিদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কর্মসূচি দেখভালের বিশেষ দায়িত্বে ছিল প্রতিষ্ঠানটি। বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে রাজধানী ঢাকায় বিভিন্ন সরকারি জমি অবৈধভাবে দখলের অভিযোগ উঠেছিল একটি প্রতিষ্ঠানের (প্রচ্ছায়া) বিরুদ্ধে। ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শাহীন সিদ্দিকের সংশ্লিষ্টতা থাকায় তার মাল্টার পাসপোর্টের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়। শাহীন প্রচ্ছায়ার চেয়ারপারসন ছিলেন। এছাড়া ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালে শেখ হাসিনার পতনের আগ পর্যন্ত তার সামরিক উপদেষ্টা ছিলেন তারিক সিদ্দিক।

অভিযোগ, প্রচ্ছায়ার জন্য জমি দখল করতে বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীকে কাজে লাগিয়েছিলেন তারিক। ২০১৬ সালে ওই জমি বিক্রি করে দেয় প্রচ্ছায়া। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ঢাকা ও গাজীপুরে সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি দখল ও ভূমিদস্যুতার অভিযোগ রয়েছে। ২০১৫ সালের মার্চে মেয়ে বুশরা সিদ্দিকের সঙ্গে যৌথভাবে মাল্টার নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেন শাহীন সিদ্দিক। সেবার নাগরিকত্বের জন্য শাহীনকে খরচ করতে হতো ৬ লাখ ৫০ হাজার ইউরো। আর বুশরার খরচ পড়ত ২৫ হাজার ইউরো। এছাড়া ফি বাবদ হেনলি অ্যান্ড পার্টনারসকে দিতে হতো ৭০ হাজার ইউরো। আবেদনের জন্য মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরের একটি ব্যাংক হিসাবের লেনদেনের তথ্য (স্টেটমেন্ট) দেখান শাহীন। তাতে ২৭ লাখ ৬০ হাজার ৪০৯ ডলার জমা দেখানো হয়। আগের দুই মাসে ১১টি লেনদেনের মাধ্যমে ওই অর্থ হিসাবটিতে জমা দেওয়া হয়েছিল। তবে সেই অর্থের কোনো উৎসের কথা নথিতে জানানো হয়নি। বুশরা যুক্তরাজ্যের লন্ডনে শিক্ষার্থী ভিসায় অবস্থানের সময় নিজের ঠিকানা দিয়েছিলেন মধ্য লন্ডনের সেন্ট প্যানক্রাস স্টেশনের কাছের একটি বাড়ির। ওই বাড়ি থেকে কয়েক মিনিটের হাঁটা দূরত্বে কিংস ক্রস এলাকায় টিউলিপ সিদ্দিকের ফ্ল্যাট রয়েছে।

ওই সময় হেনলি অ্যান্ড পার্টনারসের এক কর্মকর্তা অভ্যন্তরীণ এক ইমেইলে লিখেছিলেন, যদিও দ্য আর্ট প্রেস প্রাইভেট লিমিটেড সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক তথ্য পাওয়া যায়নি। তারপরও মাল্টার কর্তৃপক্ষের এই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আরও তথ্য প্রয়োজন। ওই ইমেইলের জবাবে আরেক কর্মকর্তা লিখেছিলেন, ১৯২৩ সালে এই ব্যবসা শুরু করেছিলেন শাহীন সিদ্দিকের দাদা। সে সময় ‘ছাপানোর’ কাজ ছিল প্রতিষ্ঠানটির মূল ব্যবসা। প্রতিষ্ঠানটিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে রয়েছেন শাহীন (২০১৩ সাল থেকে)। গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তারিক সিদ্দিক ও শাহীন সিদ্দিকের ব্যাংক হিসাব জব্দ করে বাংলাদেশে কর্তৃপক্ষ। এছাড়া গুমের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে সম্প্রতি তারিক সিদ্দিকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। পড়াশোনা শেষে বুশরা সিদ্দিক যুক্তরাজ্যে থেকে যান। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন থেকে স্নাতকের পর তিনি জেপিমরগান ব্যাংকে চাকরি শুরু করেন। পরে সেই চাকরিও ছেড়ে দেন। ২০১৮ সালে উত্তর লন্ডনে গোল্ডারস গ্রিন এলাকায় স্বামীর সঙ্গে যৌথভাবে ১৯ লাখ পাউন্ডের একটি বাড়ি কেনেন বুশরা। তার ও শাহীন সিদ্দিকের সঙ্গে মাল্টার নাগরিকত্বের আবেদনের বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করেছিল ফিন্যান্সিয়াল টাইমস। তবে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

Related Articles

Back to top button