দেশে নেদারল্যান্ডস মডেলে কৃষি উন্নয়ন চান প্রধান উপদেষ্টা: প্রেস সচিব

অনলাইন ডেস্ক: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূস স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন- বাংলাদেশকে নেদারল্যান্ডসের মত কৃষিতে প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন বাড়াতে হবে। নেদারল্যান্ডস ছোট দেশ হয়েও বছরে ১৩৩ বিলিয়ন ডলারের কৃষিপণ্য রপ্তানি করে। বাংলাদেশেরও সীমিত জমিতে উৎপাদন দ্বিগুণ–তিনগুণ বাড়ানো সম্ভব। তবে শুধু উৎপাদন বাড়লেই হবে না, ক্ষুদ্র কৃষকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও জরুরি।’

গতকাল শনিবার (২৯ নভেম্বর) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে বাংলাদেশ কৃষি সাংবাদিক ফোরাম (বিএজেএফ) আয়োজিত চার দিনব্যাপী কৃষি ও খাদ্যে রাজনৈতিক অঙ্গীকার সম্মেলনের ‘কৃষি ও খাদ্যে বিনিয়োগ: মানসম্পন্ন কৃষি উপকরণ, প্রক্রিয়াজাত পণ্য এবং কৃষির বাণিজ্যিকীকরণে ভ্যালুচেইন গঠন’ শীর্ষক অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি এসব কথা তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, ‘হঠাৎ বড় আকারে ফসল উঠলে দাম পড়ে যায় এবং কৃষক ন্যায্যমূল্য পান না। তাই প্রতিটি গ্রামে ছোট আকারে কোল্ড স্টোরেজ, আধুনিক সংরক্ষণব্যবস্থা, নতুন বাজার এবং রপ্তানির সুযোগ তৈরি করা প্রয়োজন। কৃষি, রাজনীতি ও বৈশ্বিক বাণিজ্য একে অন্যের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। যেমন- চীন–যুক্তরাষ্ট্রের সয়াবিন সংকটের সময়ে বাংলাদেশ সয়াবিন আমদানি করে যুক্তরাষ্ট্রের একটি শক্তিশালী ফার্ম লবিকে বাংলাদেশের অনুকূলে এনেছে। এটি নতুন ধরনের ফরেন পলিসি অ্যাপ্রোচ।’

প্রেস সচিব আরও বলেন, ‘পাট শিল্পে বৃহৎ পরিসরে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে চীন। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ও সম্ভাবনাময় এ খাতকে কেন্দ্র করে চীনা উদ্যোক্তারা কাঁচাপাট থেকে শুরু করে প্রস্তুত পাটপণ্যসহ সব ক্ষেত্রেই যৌথ উদ্যোগ, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও আধুনিক উৎপাদন সুবিধা গড়তে চাচ্ছেন। আমরা আশা করছি, এ আগ্রহ বাস্তবায়িত হলে দেশের পাট শিল্পে নতুন কর্মসংস্থান, রপ্তানি আয় এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য গতি আসবে।’

শফিকুল আলম বলেন, ‘জুট ডাইভারসিফিকেশন নিয়ে আমরা যতই কথা বলি না কেন বাস্তবে তেমন অগ্রগতি নেই। কারণ জুট রেটিং বা পচানো এখন আর কেউ করতে চান না। পুরনো কষ্টকর পদ্ধতি মানুষের আগ্রহ কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু চীনা বিনিয়োগকারীরা আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে বাংলাদেশে এক মিলিয়ন টন জুট প্রক্রিয়াকরণ, বায়োফার্টিলাইজার, এনার্জি ও সাশ্রয়ী প্লাস্টিকের বিকল্প তৈরি করতে আগ্রহী। সঠিক প্রযুক্তি যুক্ত হলে জুট আবারও বৃহৎ বৈশ্বিক বাজার দখল করতে পারবে। কারণ, বাংলাদেশের গতিপথ, ভবিষ্যৎ এবং রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের যাত্রা সবকিছুই বড় পরিমাণে নির্ধারণ করে কৃষি খাত। কৃষি শুধু খাদ্য নিরাপত্তা নয়, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, বৈদেশিক সম্পর্ক, এমনকি অর্থনৈতিক সক্ষমতাকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করে।’

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫৪ বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশের সবচেয়ে ভয়াবহ বছর ছিল ১৯৭৪।’

ড. নাওমি হোসেনের সাম্প্রতিক গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘গবেষকের হিসাবে সেই দুর্ভিক্ষে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল।’

তিনি বলেন, ‘তৎকালীন সরকারের অদক্ষতা, দুর্বল রিজার্ভ, বৈশ্বিক কৃষিপণ্যের রাজনীতি এবং বাজারব্যবস্থার ব্যর্থতা দুর্ভিক্ষকে তীব্রতর করেছিল। একই সঙ্গে খাদ্য মজুতদারি ও অস্থিতিশীল বাজার পরিস্থিতি সংকটকে আরও বাড়িয়ে দেয়। ১৯৭৪ সালের সেই অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের পরবর্তী প্রতিটি সরকারের নীতিনির্ধারণে গভীর প্রভাব ফেলেছে। তাছাড়া খাদ্য আমদানি নির্ভর দেশগুলোর জন্য যে কোনো বৈশ্বিক টানাপোড়েনে পরিস্থিতি দ্রুত সংকটে গড়াতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে ৬–৮ মিলিয়ন টন খাদ্য ঘাটতি পূরণে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল। অথচ ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা বা কোনো দেশের হঠাৎ রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা এসবের কারণে খাদ্য আমদানি কঠিন হয়ে ওঠে। তাই খাদ্য নিরাপত্তার জন্য শক্তিশালী রিজার্ভ, পর্যাপ্ত স্টক এবং দ্রুত আমদানির সক্ষমতা অপরিহার্য।’

স্টোরেজ সক্ষমতা বাড়ানোর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ২০ লাখ টন শস্য সংরক্ষণ করা হয়। এটি বাড়িয়ে ৫০ লাখ টনে নেওয়া উচিত। যাতে বৈশ্বিক সংকটের সময়ে বাজার স্থিতিশীল রাখা যায়।’ একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততার বিস্তার, জমির ব্যবহার কমে আসা ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে নতুন জাত, প্রযুক্তি ও খাতভিত্তিক গবেষণা জোরদার করার আহ্বান জানান তিনি।

আবাসন–বিস্তার করে কৃষিজমি নষ্ট করার প্রবণতার সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘গ্রামের বাড়ি–ঘর ফাঁকা পড়ে থাকা, কিন্তু কৃষিজমি ক্রমাগত কমে যাওয়া- এ বাস্তবতা মোকাবিলায় পরিকল্পিত গ্রাম–উন্নয়ন জরুরি।’

ভবিষ্যৎ উন্নয়ন নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের ভবিষ্যৎ কৃষির বাইরে নয়। যে সরকার আসবে, যারাই নীতিনির্ধারক হোক, সবারই লক্ষ্য হওয়া উচিত খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, উদ্বৃত্ত উৎপাদন এবং কৃষিজমি ও কৃষককে সুরক্ষা দেওয়া।’

তিনি আরও মন্তব্য করেন, ‘আমরা হয়তো নেদারল্যান্ড হব না কিন্তু লক্ষ্য রেখে ১০ বছর কাজ করলে অনেকটাই এগোনো সম্ভব।’

সম্মেলনে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পার্টনার প্রোগ্রামের এজেন্সি প্রোগ্রাম ডিরেক্টর ও উপসচিব ড. মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল ফারুক বলেন, ‘বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়লেও বাজারসংযোগ দুর্বল এবং বিপণন ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে কৃষক ন্যায্যমূল্য পান না। পার্টনার প্রজেক্টের ১০টি ডিএলআই বাস্তবায়নে সাতটি সরকারি সংস্থা যুক্ত হলেও সমন্বয় ঘাটতি রয়েছে।’

বাংলাদেশ কৃষি সাংবাদিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আবু খালিদের সঞ্চালনায় সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি সাহানোয়ার সাইদ শাহীন।

বাংলাদেশ কৃষি সাংবাদিক ফোরামের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ঢাকা ট্রিবিউনের সম্পাদক ও বিএজেএফের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য রিয়াজ আহমেদ, কৃষি–গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব রেজাউল করিম সিদ্দিক, বিএজেএফের সাবেক সভাপতি ও ঢাকা স্ট্রিমের প্রধান সম্পাদক–প্রকাশক গোলাম ইফতেখার মাহমুদ এবং বর্তমান সভাপতি সাহানোয়ার সাঈদ শাহীনের হাতে সম্মাননা তুলে দেওয়া হয়।

Related Articles

Back to top button