হাত বদলেই বাড়ে ডিমের দাম

  • পাঁচ থেকে সাত হাত ঘুরে ডিম আসে ভোক্তার কাছে
  • ডিমের সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠলে বাজার কখনো অস্থির হবে না: খামারিরা
  • ডিম উৎপাদনের মোট খরচের বড় অংশ জ্বালানি ও খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল ।
  • সয়াবিন মিল, ভুট্টা, প্রিমিক্স ইত্যাদি কাঁচামাল আমদানি করতে হওয়ায় খাদ্যের দাম বেড়ে যায়

অনলাইন ডেস্ক: কষ্ট করে ডিম উৎপাদন করলেও তার দর নির্ধারণে কোনো ভূমিকা নেই খামারিদের। উৎপাদিত ডিমের দাম কত হবে, তা তারা বিক্রির সময় জানতে পারেন না । এই দর জানতে তাকে ডিম বিক্রির পরের দিন সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। রাজধানীতে তেজগাঁও ও কাপ্তানবাজার ডিমের আড়তে আড়তদার, পরিবেশক আর বড় ক্রেতারা মিলে দাম নির্ধারণের পর তা ‘মিডিয়া” মোবাইলে মেসেজের মাধ্যমে খামারিকে ডিমের দাম জানিয়ে দেন। এই ‘মিডিয়া’ হলো মধ্যস্বত্বভোগী। ডিমের বাজারে ‘মিডিয়া’ একটি বহুল প্রচারিত শব্দ । এখানে মধ্যস্বত্বভোগীদের ‘মিডিয়া’ বলা হয়। খামারিদের কাছ থেকে ডিম সংগ্রহ শুরু করে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে পাঁচ থেকে সাতটি ‘মিডিয়া’ রয়েছে । আর এত হাতবদলের কারণেই ডিমের দাম বেড়ে যায়। সম্প্রতি সরেজমিনে অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে।

কৃষি অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, মূলত সরবরাহ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণেই ‘মিডিয়া’ গড়ে উঠেছে। খামার থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পাঁচ-সাত ধাপের মার্জিনই বাজারকে অস্থিতিশীল করে রাখছে । খামারিরা বলেছেন, “মিডিয়া’র কাছে ডিম বিক্রি না করে উপায় নেই। বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি খামারের খামারিরা পুরোপুরি এই ‘মিডিয়া’র কাছে জিম্মি । তারা সিন্ডিকেট করে ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। অসহায় এই খামারিরা বলেছেন, দেশের প্রতিটি জেলার পাশাপাশি রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় যদি ডিম বিক্রির জন্য কয়েকটি পাইকারি বাজার থাকত, তাহলে তারা সেখানে সরাসরি ডিম বিক্রি করতে পারতেন। এতে খামারিরা যেমন লাভবান হতেন । তেমনি ভোক্তারাও কম দামে ডিম পেতেন। শুধু তাই নয়, মাঝেমধ্যে ডিমের বাজারে যে অস্থিরতা দেখা যায়, সেটাও হতো না ।

বিশ্ব ডিম দিবস উপলক্ষ্যে সম্প্রতি রাজধানীতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেছেন, অনেক সময় অনিয়ম ও অপ্রয়োজনে মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতবদলের কারণে ডিমের দাম বৃদ্ধি পায় । তাই বাজার পর্যবেক্ষণ জোরদার করতে হবে। ডিমের মূল্য বাড়ানোর সঙ্গে জড়িত অনিয়ম ও অসাধু কাজের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক খামারি জানিয়েছেন, অনেক সময় ‘মিডিয়া’ ডিমের চাহিদা কম, তাই দাম কম বলে খামারিদের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত করে । এমনকি তিন- চার দিন ডিম আটকে রেখে দাম বাড়িয়ে নিজেরা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় । অথচ দোষ হয় খামারিদের । বর্তমানে রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে ফার্মের বাদামি রঙের প্রতি হালি ডিম ৫০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে । সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশও (টিসিবি) তাদের বাজারদরের প্রতিবেদনে প্রতি হালি ডিম ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছে । অথচ গতকাল শুক্রবার খামারি পর্যায়ে বাদামি রঙের একটি ডিম সর্বোচ্চ ১০ টাকা ১০ পয়সায় বিক্রি হয়েছে। একটু ছোট আকারের ডিমের দাম আরো কম ছিল। অর্থাৎ খামারি পর্যায়ে এক হালি ফার্মের বাদামি রঙের ডিম বিক্রি হয়েছে ৪০ টাকা ৪০ পয়সায়। এ হিসাবে খামার থেকে ভোক্তার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত একটি ডিমে সাড়ে ৯ টাকার বেশি বেড়েছে। মাত্র তিন দশক আগে দেশে মাথাপিছু ডিম খাওয়ার সংখ্যা ছিল বছরে গড়ে মাত্র ১০ থেকে ১৫টি । প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বর্তমানে এ সংখ্যা ১৩৭টি। ডিমকে বলা হয় ‘গরিবের প্রোটিন’। ফলে ডিমের দাম স্বল্প আয়ের মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকা খুবই জরুরি।

কীভাবে কাজ করে ‘মিডিয়া’?

সংশ্লিষ্টরা জানান, খামারিদের কাছে থেকে স্থানীয় সংগ্রাহকরা প্রথমে ডিম সংগ্রহ করেন। এরপর উপজেলার পাইকারদের কাছে তা যায়। সেখান থেকে যায় জেলা আড়তে। জেলা আড়ত থেকে আসে ঢাকার পাইকারি বাজারে । সেখান থেকে খুচরা বিক্রেতারা বিক্রির জন্য নিয়ে যান। এরপর তা আসে ভোক্তার কাছে। এভাবে প্রতিটি স্তরে পরিবহন, গুদাম ভাড়া ও কমিশনের নামে যুক্ত হয় নতুন মূল্য। গাজীপুরের আজিরন পোলট্রি ফার্মের স্বত্বাধিকারী মো. তফাজ্জ্বল হোসেন বলেন, যদি সরাসরি ঢাকায় খামারিরা ডিম বিক্রি করতে পারতেন তাহলে খামারিরা যেমন উপকৃত হতেন, তেমনি ভোক্তারাও তুলনামূলক কম দামে ডিম কিনতে পারতেন । এ ব্যাপারে আমরা অনেক বার প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেছি। তাদের বলেছি, ঢাকায় ১৪- ১৫টি স্থানে ডিমের পাইকারি বাজার করে দিতে কিন্তু হয়নি। তিনি বলেন, ডিমের সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠলে বাজার কখনো অস্থির হবে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশে ডিম সংরক্ষণের জন্য কোনো কোল্ড স্টোরেজ লাইসেন্স বা বৈধ অনুমোদন নেই, ফলে উৎপাদন মৌসুমে দাম কমে গেলে খামারিরা বাধ্য হয়ে কম দামে বিক্রি করেন।

সংরক্ষণের সুযোগ না থাকায় ডিমের বাজার মিডিয়া’র নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীর রহমান পোলট্রি ফার্মের স্বত্বাধিকারী মো. আব্দুর রহমান ইত্তেফাককে বলেন, খামারিরা ডিমের দাম নির্ধারণ করতে পারেন না । এটা তেজগাঁও, কাপ্তানবাজার ডিমের আড়ত থেকে নির্ধারণ হয় । তিনি বলেন, জেলা পর্যায়ে ডিমের কোনো পাইকারি বাজার না থাকায় খামারিরা স্থানীয় ‘মিডিয়া’র কাছে ডিম বিক্রি করতে বাধ্য হন । কারণ, ছোট খামারিদের ৫-১০ হাজার ডিম ঢাকায় নিয়ে বিক্রি করা সম্ভব নয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ডিম উৎপাদনের মোট খরচের বড় অংশ জ্বালানি ও খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল। সয়াবিন মিল, ভুট্টা, প্রিমিক্স ইত্যাদি মূল্যবান কাঁচামাল আমদানি করতে হওয়ায় খাদ্যের দাম বেড়ে যায় । এর সঙ্গে ডিজেল ও বিদ্যুতের খরচ যোগ হওয়ায় প্রতি ডিম উৎপাদনে খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। আব্দুর রহমান বলেন, বর্তমানে কর কাঠামো এমন যে, খামারিরা আয় না করলেও শুধু বিক্রয়ের ওপর ০.৬ শতাংশ থেকে ১ শতাংশ হারে টার্নওভার ট্যাক্স দিতে বাধ্য হন, যা উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষভাবে ক্ষতিকর । এই খাতে টিকে থাকা নিশ্চিত করতে হলে দরকার এমন বাজার ব্যবস্থা, যেখানে খামারিরা ন্যায্যমূল্য পান এবং ভোক্তারা সাশ্রয়ে পুষ্টিকর খাদ্য পেতে পারেন। তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আমানত উল্লাহ বলেন, ঢাকার বাইরে থেকে মধ্যস্বত্বভোগীর মাধ্যমে ডিম কিনতে হয়। সরাসরি ফার্ম থেকে কেনা যায় না। এই ক্রয়-বিক্রয়ে পাকা রসিদও পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, কয়েক হাত ঘুরে ক্রেতার কাছে পৌঁছে বলে ডিমের দাম বেড়ে যায় ।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক এবং বর্তমানে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সভাপতি এ এইচ এম শফিকুজ্জামান ইত্তেফাককে বলেন, ছোট খামারিরা তাদের উৎপাদিত ২-৩ হাজার ডিম কীভাবে ঢাকাতে পাঠাবেন? এজন্য সমবায় সমিতি করা দরকার। দেশে সমবায় বিভাগ নামে সরকারের একটি প্রতিষ্ঠান আছে। কিন্তু এই বিভাগ কী কাজ করছে? আবার প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর শুধু উৎপাদনের বিষয়টি দেখে, তারা বিপণনে কাজ করে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি ভোক্তার মহাপরিচালক থাকার সময় ডিমের বাজারের এই সিন্ডিকেট ভাঙতে চেষ্টা করেছি। তেজগাঁও ও কাপ্তানবাজারের এই সিন্ডিকেটটা ভাঙতে পারলে ডিমের বাজার স্বাভাবিক থাকবে ।

Related Articles

Back to top button