ধুঁকছে হাওর, ভুগছে মানুষ

  • ২০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা নেওয়া হলেও প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ডে অমিত
  • সম্ভাবনার হাওর এখন অস্তিত্বসংকটেবি
  • পর্যয়ের মুখে হাওরকেন্দ্রিক অর্থনীতি
  • দেশের সাত হাওর অঞ্চলের ২ কোটিরও বেশি মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটছে না

অনলাইন ডেস্ক: প্রকৃতির এক অনন্য সম্পদ হাওর। সাধারণত বর্ষাকালে এসব জলাভূমি গভীর পানিতে তলিয়ে যায়। ধান চাষ, নানা প্রজাতির মাছ, পরিযায়ী পাখি, পর্যটন ও উদ্ভিদের অভায়শ্রমকে কেন্দ্র করে হাওর অর্থনীতির বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা, উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এবং প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ডে দেশের এই সম্পদ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। হাওরের পরিবেশ, প্রতিবেশ এখন হুমকির মুখে। দেশের সাতটি হাওর অঞ্চলের ২ কোটিরও বেশি মানুষের জীবনমানের তেমন উন্নয়ন ঘটছে না।

হাওরবাসী, প্রকৃতিপ্রেমী, মত্স্যবিজ্ঞানী, হাওর গবেষক ও পরিবেশবাদীরা বলছেন, হাওরকে হাওরের মতো থাকতে দিতে হবে। হাওরে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও উন্নয়ন হতে হবে পরিবেশ সম্মতভাবে। বন্ধ করতে হবে হাওরের লুটপাটতন্ত্র। একসময় হাওর নিয়ন্ত্রণ করতেন ‘ওয়াটার লর্ড’রা। এখন হাওর নিয়ন্ত্রণ হয় লুটপাটতন্ত্রে। ‘ওয়াটার লর্ডদে’র নানা সমালোচনা থাকলেও হাওর ও হাওরের সম্পদ রক্ষায় তারা ছিলেন জিরো টলারেন্সে। আর এখন মাছ, মাছের পোনা, গাছ ও জলজ উদ্ভিদ পর্যন্ত লুটে নিচ্ছে লুটপাটকারীরা। একশ্রেণির সরকারি দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাও এর সঙ্গে জড়িত।

সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মোহাম্মদ রেজাউন নবী ইত্তেফাককে বলেন, ‘প্রাকৃতিক সম্পদ হাওরে কখনো প্রকাশ্যে, কখনো গোপনে লুটপাট চলে। এই লুটপাট বন্ধ করতে না পারলে ইকো সিস্টেম টিকবে না। এ জন্য স্থানীয় জনসচেতনতা ও উদ্যোগ হাওর রক্ষায় সহায়ক হবে।’ তিনি বলেন, ধান-মাছসহ জলজ নানা উদ্ভিদ ও শীতে পরিযায়ী পাখি ইত্যাদি করণে হাওরের অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু হাওর তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে। জলধার সংকুচিত হচ্ছে। বিশাল হাকালুকি হাওরসহ অনেক হাওর ক্রমেই ভরাট হয়ে যাচ্ছে। হাওরে ‘অল ওয়েদার রোড’ বা অপরিকল্পিত স্থাপনা হাওর ধ্বংসের অন্যতম কারণ। তিনি বলেন ‘হাওর নিয়ে আমাদের নানা পরিকল্পনা রয়েছে। হাওরকে হাওরের মতো থাকতে না দিলে বিপর্যয়ের আশঙ্কা আছে।’

হাওরের প্রাকৃতিক গঠনশৈলী: হাওর হচ্ছে এক বিশেষ ধরনের জলাভূমি। উত্তরে ভারতের মেঘালয়, পূর্বে আসাম এবং দক্ষিণে ত্রিপুরা-মিজোরামের পার্বত্যাঞ্চলের ঢালে অবস্থিত এই হাওরাঞ্চল। দেশের অন্য সমতল অঞ্চলের চেয়ে সামান্য নিচুতে অবস্থিত এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এ অঞ্চল প্রায় চার-পাঁচ মিটার উঁচুতে। বর্ষায় আগাম বন্যায় হাওরগুলো প্লাবিত হয়ে কয়েক মাস এ অঞ্চল গভীর পানিতে নিমজ্জিত থাকে। তখন চারপাশে শুধু কূলকিনারহীন পানি আর পানি। এর মধ্যেই অনেক দূরে দূরে ছোট্ট দ্বীপের মতো ভেসে থাকে গ্রাম, হিজল-করচের বাগান গলা পর্যন্ত ডুবে দাঁড়িয়ে থাকে—সে এক অপরূপ ও বিরল দৃশ্য।

ছোট-বড় ১৮টি আন্তঃসীমান্ত নদী দিয়ে বৃষ্টির পানির একটি বড় অংশ সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া হাওর অঞ্চলের মধ্য দিয়ে ভৈরবের কাছে মেঘনা নদী হয়ে সমুদ্রে পতিত হয়। বৃষ্টির সময় জনপদ ও সব হাওর একাকার হয়ে বিশাল এক জলাভূমিতে পরিণত হয়। যাকে ‘সায়র’ও (সাগর) বলা হয়। বর্ষা শেষে হাওরে ভেসে ওঠে হিজল বন আর ফসলি জমি। কিছু জায়গায় সারা বছর পানি থাকে—এগুলোকে ‘বিল’ বলা হয়। হেমন্তের শেষে জেগে ওঠা জমিতে বোরো এ অঞ্চলের একমাত্র ফসল এবং এটি সারা বছরের খোরাকি। যদিও মাছের উত্পাদন কমে গেছে, তবুও বর্ষা শেষে সেগুলো হাওর বা বিলে এসে আশ্রয় নেয়।

কৃষি প্রকৌশলী ও সাংবাদিক ড. নিয়াজপাশা তার এক নিবন্ধে লিখেছেন, প্রায় ৮ হাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তনের হাওর এলাকায় প্রায় ১৯.৩৭ মিলিয়ন মানুষের বাস। এখানে রয়েছে মোট ৩৭৩টি হাওর। মোট চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ০.৭৩ মিলিয়ন হেক্টর, যাতে বছরে ধান উত্পাদন হয় ৫.২৩ মিলিয়ন টন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী হাওরে শস্য নিবিড়তা ১৪৭ শতাংশ, জাতীয়ভাবে যা ১৭৪ শতাংশ। জিডিপিতে হাওরের অবদান ০৩ শতাংশ এবং এর ২৫ শতাংশ আসে কৃষি থেকে। হাওরে ৩ শতাংশ লোক ভূমিহীন (জাতীয় ১৪ শতাংশ)। ৮১ শতাংশ অকৃষিজীবীর কোনো কৃষিজমি নেই। হাওরে বছরে কৃষিজমি কমছে ০.৩৩ শতাংশ হারে। জাতীয়ভাবে যা ৭৪ শতাংশ । হাওর এলাকায় ৩৪ শতাংশ পরিবার মার্জিনাল কৃষক, ৫ শতাংশ পরিবার জাতীয় লেভেলের নিচে এবং ৫১ শতাংশ পরিবার ছোট কৃষক (জাতীয় ৪৯.৫ শতাংশ)। ২৮ শতাংশ লোক অতি দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে।

হাওর এলাকার চিত্র দুই মৌসুমে দুই ধরনের। একেবারে বিপরীত চিত্র। বর্ষায় হাওরে ভয়ংকর হয়ে উঠে ‘আফাল’ (প্রবল ঢেউ)। বাড়িঘর জনপদ যেন তছনছ করে দিতে চায়। আর হেমন্তে এই হাওরের পানি শুকিয়ে সবুজ ফসলের মাঠ নয়ন জুড়ায়। হাওর এলাকার এই বিশাল বৈপরীত্য পরিবেশ ও প্রতিবেশ পুরোপুরি বুঝতে হলে এর দুটি রূপই ভালোভাবে জানতে হবে। হাওরের মধ্যে বিলের পাড়ে, নদীর ধারে গড়ে উঠেছে গ্রাম, জনবসতি। এগুলো সাধারণত ভূমি থেকে ১০-১২ ফুট উঁচু। বর্ষায় দ্বীপের মতো ভাসমান ও ভঙ্গুর। গ্রামগুলো অনেকটা দ্বীপের মতো। বর্ষায় নাও আর সুদিনে দু পাও এরকম অবস্থা হচ্ছে প্রত্যন্ত হাওর অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা।

অফুরন্ত সম্ভাবনার হাওর:শুধু ধান চাষ নয়—কৃষি বহুমুখীকরণ, সমন্বিত কৃষি, ফসলের নিবিড়তা বাড়ালে হাওরের মানুষের আয় বাড়বে। হাওরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদী, নালা, খাল, বিল, পুকুরগুলো খনন করা হলে হাওরের অধিকাংশ সমস্যার সমাধান হবে। জল, জলা ও চাষভূমি সুরক্ষায় হাওরে পরিকল্পিতভাবে নদী বা পুকুর খননের মাটি দিয়ে তৈরি গ্রাম সৃজন করতে হবে। ব্যাপক জীববৈচিত্র্য ধারণ এবং প্রাকৃতিক কারণে স্থায়ী ও পরিযায়ী পাখিদের আবাসস্থল হিসেবে হাওরগুলো সুপরিচিত। বিচিত্র ধরনের জলজ পাখিসহ অসংখ্য হাঁসের আবাসস্থল ও বহু বন্যপ্রাণীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল হাওর। এক সময় শীতে প্রতি বছর সাইবেরিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অন্তত ২০০ প্রজাতির হাজার হাজার পাখির আগমন ঘটত। কিন্তু এখন সেই পরিমাণ পাখি আসে না। বিশ্বের অনেক বিপন্নপ্রায় প্রজাতির পাখি শীতকালে অস্থায়ীভাবে আবাস গড়ে তোলে এ হাওরে।

টাঙ্গুয়া হাওরে বিরল প্রজাতির পাখির সন্ধান পাওয়া গেছে। এই জলাভূমির বনাঞ্চলে একসময় জলসহিষ্ণু উদ্ভিদ, যেমন—হিজল, করচ, বরুণ, ভুই ডুমুর, জলডুমুর, হোগলা, নল, খাগড়া, বনতুলসী, বলুয়া প্রভৃতি প্রচুর পরিমাণে জন্ম লাভ করত। যেগুলো প্রকৃতিবান্ধব। দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ মাছের জোগানও আসে হাওর-বাঁওড়-বিল জাতীয় জলাভূমি থেকে। পানির দূষণ এবং দ্রবীভূত পলি মুক্ত করতে, উদ্ভিদ জন্মাতে মিঠা পানির সরবরাহচক্রে জলাভূমির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব শামসুল আলম চৌধুরী হাওর প্রধান সুনামগঞ্জে দীর্ঘ বছর চাকরিকালীন অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘হাওরের বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে চাইলে এখনই স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘সুনামগঞ্জ ছিল মাছের সরোবর। সেটা এখন স্বপ্নের মতো। কারণ হাওর লুটপাটকারীদের দখলে। এ থেকে বের না হলে রক্ষা নেই।’

নষ্ট হচ্ছে ইকো সিস্টেম: কালের বিবর্তনে হাওর জনপদে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সর্বোপরি বৈশ্বিক উষ্ণতায় পরিবেশগত সংকট তীব্র হচ্ছে। হাওরভিত্তিক অর্থনীতি বিপর্যস্ত। জলবায়ু সংকট তীব্র। বর্ষায় উজান থেকে পলি, বালি নেমে নদী, খাল কৃষিজমি ভরাট হচ্ছে। মাছের অভয়াশ্রম ধ্বংস হচ্ছে। নদীভাঙন তীব্র হচ্ছে। অকাল বৃষ্টি, বন্যা, খরা ও পাহাড়ি ঢলে ফসলি জমি বিনষ্ট হচ্ছে। যদিও ইরি বাড়ছে, কিন্তু ঐতিহ্যবাহী আমন-আউশসহ বিভিন্ন জাতের ফসলের চাষ কমেছে। ঐতিহ্যের সুগন্ধি চালসহ বিভিন্ন জাতের চাল এখন পাওয়া যায় না। এলাকার মানুষের প্রধান অবলম্বন মাছ, ধানসহ প্রাকৃতিক সম্পদ সংকুচিত হয়ে আসছে। ফলে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে হাওর ও হাওর পাড়ের বাসিন্দারা। এমনকি হাওরের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে।

হাওরে জীববৈচিত্র্য ক্রমাগত নষ্ট হচ্ছে। চায়না দুয়ারি জালসহ নানা প্রকার জাল ব্যবহার করে মাছ ধরায় মাছের বংশ বিস্তার হচ্ছে না। এমনকি হাওরে উত্পাদিত বনসহ নানা জলজ উদ্ভিদ বিনষ্ট হয়ে গেছে। যা পানি ফিলটার এবং মাছের খাদ্য। ‘কোল মাইনিং’ এর করণে হাওর ও নদীতে মাছের আবাসস্থল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মত্স্য বিজ্ঞান অনুষদের প্রফেসর মৃত্যুঞ্জয় কুন্ড বলেন, ‘মাছ যেখানে জন্ম নেয়, সেখানেই ডিম ছাড়ে। কিন্তু ডিম ছাড়ার স্থল বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেচ দিয়ে পানি সিঞ্চন করে মাটিতে বিষ দিয়ে মাছ ধরার ফলে মাছের বংশ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘ইকো সিস্টেম ফিরে আসতেও দুই-চার বছর লাগে। হাওর-নদীর পানি দূষিত । তাই ছোট মাছ পাওয়াই যায় না। প্রসিদ্ধ যাদুকাটা নদীতে মাছশূন্যতার কারণ: কয়লা ও বালুতে ভরে আছে নদীর তলদেশে।’ প্রফেসর কুন্ড বলেন, ‘অভয়াশ্রমগুলোকে খনন করতে হবে। ভৈরবের কাছে মেঘনার মুখ কেটে দিলে দ্রুত সিলেটের নাব্য ফিরে এসে দূষিত পানি বেরিয়ে যাবে। এলাকা বন্যা মুক্ত থাকবে। হাওরের পরিবেশ প্রতিবেশ রক্ষার জন্য সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।’

হাওর না বাঁচলে দেশ বাঁচবে না: প্রায় বর্ষায় হাওরের ফসলি জমি আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে যুদ্ধ করে থাকে। অনেক সময় ডুবে যায় হাওরের ফসল। শীতকালে এই হাওর শুকিয়ে বিশাল পরিমাণে বোরো ধান ও রবিসশ্যসহ নানা ফসল উত্পাদন করে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখছে। কৃষকরা মৌসুমিভাবে মাছ ও ধান চাষ করে আয়ের উত্স তৈরি করেন। কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, শুধু বোরো ও আমন ধান উত্পাদন করে সিলেটে বিভাগে ১৫ লাখ ৬০ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকার চাল পাওয়া যায়। আউশ ও সবজি চাষের হিসাব যোগ হলে টাকার অঙ্ক আরো বেড়ে যাবে।

হাওর গবেষকরা ইত্তেফাককে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভাটি অঞ্চলে মানুষের অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি। জীবনের ঝুঁকি বাড়ছে। এজন্য দ্রুততম সময়ে নদী-হাওর সংরক্ষণ ও উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের বিকল্প নেই। ‘হাওর না বাঁচলে দেশ বাঁচবে না। তাই যে কোনো মূল্যে হাওরকে বাঁচাতে হবে,’—এই মন্তব্য করে বিশিষ্ট সমাজ কর্মী ও হাওর গবেষক জামিল চৌধূরী বলেন, প্রাকৃতি ও মনুষ্য সৃষ্ট নানা কারণে হাওরগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। পলি পড়ে, যত্রতত্র অপরিকল্পিত বাঁধ ও সড়ক নির্মাণের ফলে হাওর বিরানভূমি হচ্ছে। মাছের অভয়াশ্রম নষ্ট হচ্ছে এবং জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ হারিয়ে যাচ্ছে।’

শর্ত ভঙ্গ করে মাছ লুট: হাওরে ইজারাদাররা শর্ত ভঙ্গ করে মাছ লুটে খাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০ একরের ঊর্ধ্বের জলমহালকে বলা হয় ‘পাইল ফিশারি’। নিয়ম হচ্ছে, জলমহালের উন্নয়নে খনন, কাটা, বাঁশ লাগানো ইত্যাদি কার্যক্রম সম্পন্ন করা। পাইল ফিশারিগুলো ৩ বছর পরপর ফিশিং করার নিয়ম। কিন্তু তা পালন হয় না। ইজারাদাররা বলেন, ‘একটি জলমহাল ইজারা নিয়ে আমরা মামলা, হামলা ইত্যাদি নিয়ে দিন-রাত চাপে থাকি। লক্ষ্য থাকে কত দিনে পুঁজি উঠবে। ভয় থাকে কখন জলমহাল লুট হয়ে যায়।’ তবে গত বছর কোনো জলমহালে হাঙ্গামা বা লুট হয়নি—এ দাবি করে সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি মুশফেকুর রহমান ইত্তেফাককে বলেন, ধান কাটার মৌসুম ও মাছ ধরার মৌসুমে সিলেটে কোনো কোনো সময় নানা অঘটন ঘটে বটে। তবে সাম্প্রতিককালে পরিস্থিতি অনেক ভালো।’ তিনি বলেন, বিশাল হাওরাঞ্চলে ৩৯টি থানার পুলিশ আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে সচেষ্ট।

হাওর ভরাট করে বাড়িঘর, শিল্পপ্রতিষ্ঠান: সিলেটের চার জেলায় হাওর ভরাট করে বাড়িঘর, শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। ফলে বিশেষ করে প্রাকৃতিক মাছের অভয়াশ্রম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই মাছের দেশ সিলেটে এখন চাষের মাছ রাজত্ব করছে। হবিগঞ্জের বাহুবলে হাওরে শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে। এতে ধানিজমির দাম বহুগুণ বেড়ে গেছে। এলাকায় কেমিক্যাল বর্জ্যের কারণে এলাকার হাওর, নদী খালের পানি দূষিত হয়ে পড়েছে। ফলে মাছশূন্য হয়ে পড়েছে এসব জলাশয়। হবিগঞ্জের প্রসিদ্ধ গুঙ্গিয়াজুড়ি হাওরটির এখন করুণ দশা। এক সময় এই হাওর ছিল ভাটির জনপদের নৌচলাচলের মাধ্যম। এ পথ দিয়ে বড় বড় নৌকা ও লঞ্চ চলাচল করত। এটি ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ধান ও মাছ উত্পাদন হচ্ছে না আগের মতো। জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাশমির রেজা বলেন, ‘নানাভাবে হাওরের ওপর অত্যাচার চলছে। অপরিকল্পিত রাস্তা, অপ্রয়োজনীয় বাঁধ নির্মাণের কারণে হাওর স্বাভাবিকতা হারাচ্ছে। তিনি ‘হাওরকে হাওরের মতো থাকার’ পরিবেশ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়ে বলেন, হাওর আমাদের সম্পদ, একে যে কোনো মূল্যে রক্ষা করা সবার দায়িত্ব। আর বাঁধ নির্মাণের বিকল্প হতে পারে নদীকে গভীর করা।’

বিকল্প কর্মসংস্থান গড়ে উঠেনি হাওরবাসীর: দেশের ৪৮টি উপজেলার ২ কোটির বেশি মানুষের হাওরে বসবাস। এর মধ্যে ২০-২৫ লাখ একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাসিন্দা। বছরের ছয়-সাত মাসই হাওরের অধিকাংশ মানুষ পানিবন্দি থাকে। বিকল্প কর্মসংস্থান গড়ে উঠেনি বলে বিশাল এই জনগোষ্ঠী বছরের অধিকাংশ সময় বেকার থাকে। মাছ ও কৃষির ওপর নির্ভরশীল হাওরপারের মানুষের জন্য কোনো সরকারই কর্মসংস্থানের দিকে সেভাবে নজর দেয়নি। এলাকার ২৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ মানুষেরই জমি নেই। এর মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কৃষক প্রায় বছর ফসল ঘরে তুলতে পারেন না। হাওরবাসীর সুরক্ষার জন্য বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিকভাবে গজিয়ে উঠা হিজল-করচ বাগ ও চাইল্লা বন (বিশেষ ধরনের শক্ত লতার বন, যা প্রবল ঢেউ থেকে হাওরের ঘরবাড়ি রক্ষা করে)। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও ঝুঁকিতে পড়েছে মিঠাপানির মাছের বিশাল অভয়াশ্রমগুলো।

বেসরকারি সংস্থা ‘হাউস’-এর নির্বাহী পরিচালক সালেহিন চৌধুরী শুভ বলেন, হাওরগুলো দেশের মিঠাপানির মাছের বৃহত্ আধার। মূলত বিল থেকে আহরিত হলেও বর্ষায় সারা হাওরই মাছের প্রজনন ও বিচরণক্ষেত্র। ফসল রক্ষায় বেড়িবাঁধগুলো উঁচু থাকায় হাওরে অবাধ পানি প্রবেশে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। হাওর ও নদীর সংযোগকারী অনেক খাল বন্ধ। ফলে হাওরে স্রোত না হওয়ায় মাছের প্রজননে বিঘ্ন ঘটছে। এছাড়াও কীটনাশকের ব্যাপক ব্যবহার, অবৈধ উপকরণ দিয়ে মাছ ধরা, বিল শুকিয়ে ফেলা, ত্রুটিপূর্ণ ইজারা পদ্ধতি, জলাবন না থাকা প্রভৃতি কারণেও হাওরগুলো প্রায় মাছশূন্য।

তিনি বলেন, হাওরের কৃষি মূলত বোরো ধান চাষ, যা হাওরবাসীর প্রধান পেশা। দেশের অর্থনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও হাওরের বোরো ফসল কাটার মৌসুমে পানিতে তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। ফসল রক্ষায় ষাটের দশকে হাওরগুলোর চারদিকে বেড়িবাঁধ তৈরি করা হয়। বাঁধগুলো প্রতি বছর সংস্কার, মেরামত ও পুনর্নির্মাণ করা হয়। কয়েক বছর ধরে বাঁধগুলো উঁচু করা হচ্ছে। ফসল রক্ষায় সাময়িক সমাধান হিসেবে প্রয়োজন হলেও বেড়িবাঁধ হাওরে অনেক সংকট তৈরি করেছে। নদীর স্রোতের সঙ্গে উজান থেকে আসা পলিতে হাওরাঞ্চলের নদীগুলো ইতিমধ্যে অনেকটা ভরাট হয়ে গেছে। আবার বাঁধের মাটিতে প্রতি বছর নদীর তলদেশ ভরাট হচ্ছে। এতে অকাল বন্যার ঝুঁকি আরো বাড়ছে। তাই হাওরের বোরো ফসলকে স্থায়ীভাবে ঝুঁকিমুক্ত করতে নদী খননই একমাত্র সমাধান। মেঘনা, সুরমা, কুশিয়ারাসহ হাওরাঞ্চলের নদীগুলো খনন করতে হবে।

সালেহিন চৌধুরী শুভ আরো বলেন, প্রাণিসম্পদ বৃদ্ধির জন্য হাওরে জলজ ঘাস চাষ সম্প্রসারণ করতে হবে। আবাসন তথা বসবাসেও হাওর ব্যবহূত হয়। বড় প্রতিটি হাওরে অনেক গ্রাম রয়েছে। গ্রামগুলোতে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় হাওরের বুক চিরে সড়ক নির্মাণের ফলে এগুলো বৈশিষ্ট্য হারিয়ে প্রায় রুগ্ণ হয়ে যায়। জনসংখ্যার আধিক্য, বসতি সম্প্রসারণ, জনবসতির জন্য যোগাযোগ ও অন্যান্য নাগরিক সুবিধার প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করা হাওরের অস্তিত্বের জন্য বড় সংকট। এছাড়া হাওরে গত এক দশক ধরে বজ্রপাত আতঙ্ক হয়ে উঠেছে। হাওরগুলোতে বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপন করতে হবে।

পর্যটন ও স্থানীয় ব্যবসা: হাকালুকি, টাঙ্গুয়ার হাওরকে কেন্দ্র করে পর্যটন সঠিকভাবে গড়ে উঠলে স্থানীয়ভাবে বহু লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। শীতকালে ২০০ প্রজাতির পাখির দেখা পাওয়া যেত হাওরে। এমন দৃশ্য এখন ফিকে হয়ে আসছে। হাকালুকি হাওর দেশের বৃহত্তম হাওরগুলোর মধ্যে একটি। আনুমানিক ১৮১.১৫ বর্গকিলোমিটার জুড়ে এই হাওরে প্রায় ৫৫৮ প্রাণী ও পাখি প্রজাতি চিহ্নিত করা হয়েছে। সিলেট বিভাগের টাঙ্গুয়ার হাওর ও হাকালুকি হাওরের বৈশিষ্ট্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। এই দুটি হাওরে বিশ্বের বিরল প্রজাতির পাখি ও উদ্ভিদের সন্ধান রয়েছে।

হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ: প্রতি বছর সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও সিলেটে পানি উন্নয়ন বোর্ড বোরো ফসল রক্ষায় ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করে থাকে। এই ফসল রক্ষা বাঁধ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক লেগেই আছে। কর্মকর্তরা বলেন, বাঁধ নির্মাণ হয় পিআইসির (প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন কমিটি) মাধ্যমে। এই কমিটির প্রধান জেলা প্রশাসক। আমরা কারিগরি সহায়তা দিয়ে থাকি। বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ ধরা পড়লে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে সময় মতো পিআইসি গঠন ও কাজ শুরু করতে না পরলে বিপত্তি হয়। এগুলো আবার রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে বিবেচিত হয়ে থাকে। ফলে অনেক সময় কাজ শুরু করতে দেরি হয়। এত বাঁধ ভেঙে ফসল বিনষ্ট হয়। অন্যদিকে, আবার কেউ কেউ বলেন, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণে হাওরের স্বাভাবিকতা নষ্ট ও পরিবেশ প্রতিবেশ হুমকির মুখে। কারণ মাটির এই বাঁধ প্রতি বছর পানিতে ধুয়ে আবার নদী বা জলাভূমিতে পতিত হয়।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্তি প্রধান প্রকৌশলী কাইসার আলম ইত্তেফাককে বলেন, ‘হাওর রক্ষার ডুবন্ত বাঁধগুলো ভাটি এলাকার বোরো ফসল রক্ষা করে থাকে। এই বাঁধ ভরা বর্ষায় মাছের গতিবিধিতে তেমন বাধা সৃষ্টি করে না। তার পরও যদি অসুবিধা দেখা দেয় সবাই মিলে সমাধান করা যাবে। হাওর রক্ষা বাঁধ না হলে বর্ষায় ঢলের তোড়ে বিপুল পরিমাণ কাঁচা ধান তলিয়ে যাবে।’

হাওর উন্নয়নে পদক্ষেপসমূহ: স্বাধীনতার পর হাওর উন্নয়ন বোর্ড গঠনের বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করলেও রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে তা খুব একটা সুফল বয়ে আনেনি। পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালে কিশোরগঞ্জে বোর্ডের সদর দপ্তর স্থাপন করে অনেক উন্নয়ন কাজ করা হয়। কিন্তু সামরিক শাসক এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণ করে সবকিছু বন্ধ করে দেন। হাওরবাসী তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হন। ২০০১ সালে হাওর ও জলাশয় উন্নয়ন বোর্ড গঠন করা হলেও হাওরের কল্যাণে দৃশ্যমান কোনো উন্নয়ন হয়নি। পরবর্তী সময়ে হাওরবাসীর উন্নয়নে ২০ বছর মেয়াদি ১৭টি এরিয়ায় ১৫৩টি প্রকল্পে বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয় মোট ২৭ হাজার ৯৬৩ কোটি ৫ লাখ টাকা। পাঁচ, ১০ ও ২০ বছর (২০১২-২০৩২) মেয়াদি এসব প্রকল্প তিন ধাপে বাস্তবায়িত হবে।

বাংলাদেশে প্রায় ৪০০ হাওর: দেশে প্রায় ৪০০ হাওর রয়েছে। ভূতাত্ত্বিক অবস্থান বা এলাকার বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে এই হাওরকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়—১. পাহাড়ের পাদদেশে বা পাহাড়ের কাছাকাছি অবস্থিত হাওর, ২. প্লাবিত এলাকার হাওর ও ৩. গভীর পানিতে প্লাবিত এলাকার হাওর। তবে দেশে সবচেয়ে বেশি হাওর রয়েছে সিলেট বিভাগে।

হাওরবাসীর দাবি: হাওর এলাকার প্রতি গ্রামে কর্মসংস্থানের জন্য কুটির শিল্প, পোলট্রি ফার্ম, অ্যাগ্রোবেজড কর্মসূচি ব্যাপক ভিত্তিতে শুরু করা দরকার। তবে সবার আগে এলাকার ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এজন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চরাঞ্চলের মতো বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমানের অভিমত, প্রথমত, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া হাওর অঞ্চলের প্রধান আয়ের পথ হচ্ছে মাছ ধরা। ফলে এ ক্ষেত্রেও অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তি সহায়তা প্রদান করা দরকার। তিনি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেন অবকাঠামো উন্নয়ন, যোগাযোগব্যবস্থা এবং শিশুদের শিক্ষা গ্রহণের ওপরে। আর তখনি এখানকার মানুষের জীবনে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগবে।

‘জলবায়ু সহনশীল জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্প’ স্থগিত: দেশের আট জেলার হাওরাঞ্চলে ‘জলবায়ু সহনশীল জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্প (সিআরএলইপি)’ গত ২১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত একনেক সভায় স্থগিত করা হয়েছে। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা ছিল ১ হাজার ২৬৮ কোটি ৬০ লাখ। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ৩০৫ কোটি ছাড়াও ইফাদ, ডানিডাসহ বিভিন্ন সংস্থার অর্থায়ন রয়েছে। প্রকল্পটি সভায় উত্থাপন করা হলে বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, এই প্রকল্পটি জলবায়ু সহিষ্ণুতার নামে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখানে টেকসই জীবিকা উন্নয়ন উপেক্ষিত। গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বেশি অবকাঠামোর ওপর। তিনি বলেন, ‘হাওরে পরিবেশ নষ্ট করে অবকাঠামো নির্মাণ করা যাবে না।’ প্রকল্পটির অনুমোদন স্থগিত করে ডিপিপি সংশোধনের নির্দেশ দেন তিনি।

Related Articles

Back to top button