১৪ মাসে পুলিশের ওপর ১৯৫ হামলা

মবের শিকার হচ্ছে পুলিশ, আইনশৃঙ্খলা নিয়ে উদ্বেগ
অনলাইন ডেস্ক: গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে গত এক বছরের বেশি সময়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সারা দেশে নানা রকম ‘মব’ হামলার ঘটনা ঘটেছে, যাতে শুধু সাধারণ মানুষই নয়, অনেক ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও হামলার শিকার হয়েছে। অনেক মব হামলার ঘটনা ঘটেছে পুলিশের সামনে, এমনকি অনেক ঘটনায় পুলিশকেও পালিয়ে যেতে দেখা গেছে। এর মধ্যেই গত এক সপ্তাহে পুলিশের ওপর এমন হামলা ও মবের ঘটনায় কয়েক জন আহত হলে নতুন করে আবার আইনশৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, পুলিশ ‘মবে’র শিকার হলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব? পুলিশ বাহিনীও পুরোপুরিভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। অভিযান চালানোর পরও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নতি হয়নি। বরং অভিযান চলার মধ্যেই একের পর এক ডাকাতি, প্রকাশ্যে অস্ত্র ঠেকিয়ে ছিনতাই, গণপিটুনি দিয়ে হত্যা, ধর্ষণ, ‘তৌহিদি জনতার’ ব্যানারে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাধা, মব সৃষ্টি করে বাড়িঘরে হামলা-লুটপাট, এমনকি পুলিশের ওপর হামলার মতো ঘটনাও এখনো অব্যাহত রয়েছে।
নরসিংদীতে সড়কে যানবাহন থেকে চাঁদা তোলার সময় গত শনিবার আটক ব্যক্তিদের ছিনিয়ে নিয়ে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় সেখানকার একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আহত হয়েছেন। এছাড়া, সিলেটে গত শুক্রবার পুলিশের ওপর হামলায় শাহপরান থানার ওসিসহ পাঁচ জন আহত হন। গত রবিবার ঐ বিভাগেরই কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ‘মব’ সৃষ্টি করে পুলিশের ওপর হামলায় পাঁচ জন আহত হয়েছেন। গত মঙ্গলবার ভোর ৫টার দিকে ফেনীর সোনাগাজী থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক সাইদুর রহমান ও মোফাজ্জল হোসেনের নেতৃত্বে ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি আহাম্মদপুর গ্রামের আবুল হাশেমের দুই ছেলে জাহেদুল ইসলাম রিপন ও রফিকুল ইসলাম আরিফকে গ্রেফতার করতে তাদের বাড়িতে অভিযান পরিচালনা করেন। এ সময় আসামি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে পুলিশের কাছ থেকে একটি ওয়াকিটকি ও একটি শটগান কেড়ে নিয়ে পালিয়ে যায় তারা। এই ঘটনায় ছয় পুলিশ সদস্যকে সাসপেন্ড করা হয়েছে।
একই দিন অর্থাত্ গত মঙ্গলবার চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকায় অবৈধ অটোরিকশা আটকের জেরে পুলিশের ওপর হামলা হয়েছে। ৫০ থেকে ৬০ জন লোক ট্রাফিক পুলিশ সদস্যের ওপর হামলা করে আটক করা অটোরিকশাটি ছিনিয়ে নেয়। হামলায় ট্রাফিক কনস্টেবল নজরুল ইসলাম আহত হন। হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে চোরাই মোবাইল ফোন উদ্ধার করতে গিয়ে চোর এবং তাদের পরিবারের লোকজনের হামলায় পুলিশের ছয় সদস্য আহত হয়েছে। গত মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে শহরের ফুলকলির পিছনে শিবপাশা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে চলতি বছরের ৯ অক্টোবর পর্যন্ত ১৪ মাসে পুলিশের ওপর হামলা বেড়েই চলেছে। ১৪ মাসে সারা দেশে হামলার এমন ১৯৫টি ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, মাদক অভিযান, অবৈধ দখল উচ্ছেদ কিংবা চাঁদাবাজি-ছিনতাই রোধের অভিযানে গিয়ে পুলিশ উলটো হামলার মুখোমুখি হচ্ছে। যদিও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মবের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে সারা দেশে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ছিল ৩১টি, তবে গত আগস্টে তা বেড়ে ৫১টি হয়েছে। অর্থাত্ একটি মাসের হামলার চিত্র তুলনা করলে দেখা যায়, তা বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে।
এসব হামলার সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের জড়িত থাকার অভিযোগ আসছে। সারা দেশে ৪৪টি হামলায় ৩৯ জন আসামিকে ছিনিয়ে নিয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। পুলিশ বিভিন্ন মাজারের হামলা ঠেকাতে গিয়েও হামলার শিকার হয়েছে। গাজীপুর, ফরিদপুর ও ময়মনসিংহে পুলিশ এসব ঘটনায় একাধিক বার আক্রান্ত হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে তৌহিদি জনতার ব্যানারে উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তিরা পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের পর মাঠপর্যায়ে অপারেশনের ধরন পরিবর্তন করেছে পুলিশ। বর্তমানে ‘আক্রমণাত্মক’ পুলিশিংয়ের পরিবর্তে আত্মসমর্পণমূলক পুলিশিং করছে। ফলে হামলা হচ্ছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘পুলিশের মাঠ পর্যায়ের সদস্যদের সঙ্গে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে চোখে পড়ার মতো সমন্বয়হীনতা আছে। এটা তারা কাটিয়ে উঠতে তো পারেইনি বরং তা আরো বাড়ছে। এর প্রভাব পড়ছে শৃঙ্খলা রক্ষায়। এমন পরিস্থিতির সুযোগ নেয় অপরাধীরা। তারা যখন বুঝতে পারে পুলিশের ভেতরে সমন্বয়হীনতা আছে, তাদের ওপর আক্রমণ করলে কিছু হবে না, পুলিশ নিজেই ভিন্ন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যাবে। সে কারণেই পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা বেড়েছে। এক বছরে পুলিশ নিজের অবস্থান পরিবর্তনে জোরালো কোনো ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত গ্রহণ করতে পারেনি বলেই এ অবস্থা।’
সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের ওপর হামলা হয়েছে উল্লেখ করে এসব ঘটনায় নিন্দা ও উদ্বেগ জানিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন ও পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন। গত মঙ্গলবার দুটি সংগঠনের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে এ উদ্বেগ জানানো হয়। পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, একটি কুচক্রী মহল সুপরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশ পুলিশের মনোবল দুর্বল করার নিমিত্তে ইউনিফর্মধারী পুলিশকে পেশাগত কাজে বাধা দেওয়া এবং শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার এসব ঘটনা ঘটিয়েছে। এসব বেআইনি কাজের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ পুলিশ সদা তত্পর রয়েছে এবং তারা পেশাদারিত্ব ও দক্ষতার সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের আদর্শ ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে নিরলস কাজ করে যাবে
এদিকে পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের বিবৃতিতে বলা হয়, সম্প্র্রতি দেশের বিভিন্ন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশ সদস্যদের ওপর একাধিক দুঃখজনক হামলার ঘটনা বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের নজরে এসেছে। এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ও বেআইনি ঘটনা শুধু পুলিশ বাহিনীর জন্য নয়, রাষ্ট্রের সার্বিক নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার জন্যও হুমকিস্বরূপ। পুলিশের বৈধ দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়া, হামলা বা লাঞ্ছনার ঘটনা অত্যন্ত উদ্বেগজনক, নিন্দনীয় ও দুঃখজনক।