বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

চীন থেকে কেন যুদ্ধবিমান কিনছে অন্তর্বর্তী সরকার?
অনলাইন ডেস্ক: চীনের তৈরি ২০টি জে-১০ সিই মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান কেনার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ লক্ষ্যে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের ফেসবুক প্রোফাইলে এক স্ট্যাটাসেও সম্প্রতি এ বিষয়ে জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, চীনের তৈরি ২০টি জে -১০ সিই মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান কেনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। চলতি ২০২৫-২৬ এবং ২০২৬-২৭ অর্থবছরে এই চুক্তিটি বাস্তবায়নের আশা করা হচ্ছে বলেও এই স্ট্যাটাসে উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে নির্বাচনকে সামনে রেখে অন্তর্বর্তী সরকারের এমন বড় ধরনের প্রতিরক্ষা চুক্তি নেওয়া কতটা যৌক্তিক, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষকরা।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আ.ন.ম মুনীরুজ্জামান বলেন, ‘এই সরকারের মেয়াদ প্রায় শেষের দিকে। এত বড় কেনাকাটা পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের জন্য দায় হয়ে দাঁড়াতে পারে।’
অন্তর্বর্তী সরকার কেন যুদ্ধবিমান কিনছে?
স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের ফেসবুক প্রোফাইলে দেওয়া স্ট্যাটাসে অবশ্য যুদ্ধবিমান কেনার কারণ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটি লাইন উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর আধুনিকায়ন এবং জাতীয় আকাশ প্রতিরক্ষাকে শক্তিশালী করতেই সরকার ২০টি যুদ্ধবিমান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে সরাসরি কেনা হবে, নাকি জিটুজি পদ্ধতিতে যুদ্ধবিমান ক্রয়ের চুক্তি হবে- সেটি পরিষ্কার করা হয়নি।
গত বছর অগাস্টে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে গত মার্চে চীন সফর করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও চীন সফর করেছেন।
এরই মধ্যে আগামী বছর ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ঘোষণা অনুযায়ী ভোটের আগে এই সরকারের হাতে আছে চার মাসের মতো। ফলে নির্বাচনের পূর্বমুহূর্তে প্রতিরক্ষা খাতে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার ক্রয়চুক্তি করা এই সরকারের জন্য কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে সন্দিহান সামরিক খাতের বিশেষজ্ঞরা।
তবে প্রতিরক্ষা সক্ষমতা ও যুদ্ধের প্রস্তুতি সংক্রান্ত নিরাপত্তা সক্ষমতা (ডেফারেন্স) বজায় রাখতে বাংলাদেশের যুদ্ধবিমান কেনা প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, বাংলাদেশের বর্তমানে যেসব যুদ্ধবিমান রয়েছে সেগুলো বেশ পুরোনো মডেলের।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) আ.ন.ম মুনীরুজ্জামান বলেন, যে কোনো দেশকে হুমকি মোকাবিলায় প্রতিরক্ষার জন্য যুদ্ধবিমানসহ সব ধরনের প্রস্তুতি রাখতে হয়।
তবে তিনি মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকার নয়, বরং নির্বাচিত সরকারের ওপর এই ক্রয় সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়া উচিত।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, ‘কোনো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যারা সাময়িকভাবে দেশের শাসনভার নিয়েছেন এবং তারা তাদের তাদের মেয়াদের শেষ প্রান্তে চলে আসছেন, বলতে গেলে ইলেকশনের থেকে খুব কাছাকাছি সময় এরকম বড় ধরনের কোনো কেনাকাটার দিকে সেই সরকারের হস্তক্ষেপ করা উচিত না বলে আমি মনে করি।’
এর কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, এই যুদ্ধবিমানগুলো কিনতে প্রায় দুই দশমিক দুই বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে, অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা লাগবে।
‘কাজেই এতো বড় একটা ক্রয় যেটা তারা করার সিদ্ধান্ত নেয়, সেটা পরবর্তী যে নির্বাচিত সরকার আসবে তাদের ঘাড়ে গিয়ে পড়বে। কাজেই এই ধরনের সিদ্ধান্তটা সাধারণত এই শেষ মুহূর্তে এসে কোনো সরকারের নেওয়া উচিত হবে না,’ বলেন এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
তিনি মনে করেন, যেহেতু একটা নির্বাচিত সরকারের দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ, সেক্ষেত্রে তাদের ওপরই এই সিদ্ধান্তের ভার দেওয়া উচিত।
অতীতেও আলোচনা ছিল
এর আগে শেখ হাসিনার সরকারের আমলেও যুদ্ধবিমান কেনার নানা পরিকল্পনা ছিল। ফ্রান্সের রাফাল, ইউরো ফাইটার টাইফুন এবং এফ-১৬ নিয়ে আলোচনা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
২০২৩ সালে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ঢাকায় এলে আবার রাফাল নিয়ে আলোচনা হয়। তবে করোনাকালে অর্থনৈতিক সংকটে এসব আলোচনা থেমে যায়। বর্তমান সরকার আবার সেই প্রক্রিয়া সামনে এনেছে।
চীন থেকে যুদ্ধবিমান কিনছে বাংলাদেশ

‘জে-১০ সিই’ সম্পর্কে যা জানা গেছে
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, আধুনিক যুদ্ধবিমান সাধারণত দুই ধরনের কাজে ব্যবহৃত হয়—প্রতিরক্ষামূলক (ডিফেনসিভ) ও আক্রমণাত্মক (অফেনসিভ)। একটি দেশ আক্রান্ত হলে তা মোকাবিলায় যেমন এই বিমান ব্যবহৃত হয়, তেমনি শত্রুপক্ষকে লক্ষ্য করে অভিযান পরিচালনাতেও তা কার্যকর।
বাংলাদেশের বিদ্যমান যুদ্ধবিমানের বেশিরভাগই প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত। তবে নতুন করে যে চীনা ‘জে-১০ সিই’ মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা উভয় ধরনের কার্যক্রমে সক্ষম বলে জানিয়েছেন সামরিক বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্লেষকরা জানান, এই যুদ্ধবিমানের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো অল্প জায়গায় দ্রুত উড্ডয়ন (টেক-অফ) করার সক্ষমতা। শত্রুপক্ষ রানওয়ে লক্ষ্য করে হামলা চালালেও, বাকি অংশ ব্যবহার করে বিমান উড্ডয়ন করতে পারে।
এছাড়া এটি সিঙ্গেল ইঞ্জিন ফাইটার, যার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো উচ্চতায় দ্রুত ওঠার ক্ষমতা এবং টার্নিং মুভমেন্ট। ফলে আকাশে ‘ডগ ফাইট’ বা মুখোমুখি যুদ্ধে এটি কার্যকর।
এয়ার-টু-এয়ার ও সারফেস-টু-এয়ার উভয় ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রকে এড়াতে এই বিমানের অ্যারোডায়নামিক ডিজাইন সহায়তা করে। এর গতি ঘণ্টায় প্রায় ২,৪১৫ কিলোমিটার, যা শব্দের গতির চেয়ে দ্বিগুণ।
চীনের জে-১০ সিরিজ মূলত তাদের অ্যারোবেটিক টিমের মাধ্যমে ব্যবহৃত হলেও, পাকিস্তানও এই বিমান ব্যবহার করছে। ২০২৪ সালের মে মাসে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার সময় এই যুদ্ধবিমানের ব্যবহার নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে আলোচনার সৃষ্টি হয়।
চীনের তৈরি এই বিমানটি প্রথম ‘জে-১০এ’ ও ‘জে-১০এস’ নামে পরিচিত ছিল। পরে উন্নত সংস্করণ ‘জে-১০সি’ বাজারে আনা হয়, যার রাডার সক্ষমতা আগের চেয়ে উন্নত। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাফালের তুলনায় এই বিমান রাডার সিস্টেমে কিছুটা এগিয়ে থাকতে পারে।
এই যুদ্ধবিমান সমুদ্রগামী রণতরী ও স্থল ঘাঁটি উভয় থেকেই পরিচালনা করা যায় বলেও জানিয়েছেন সামরিক বিশ্লেষকরা।