১৮ মাসে ঢুকেছে দেড় লাখ, অপেক্ষায় আরও অর্ধলক্ষ

  • ডব্লিউএফপির সহযোগিতা অব্যাহত রাখার চেষ্টা 
  • গত চার বছরে আট গ্রুপের সংঘর্ষে ২০২ খুন
  • রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে আজ কক্সবাজারে শুরু হচ্ছে আন্তর্জাতিক সংলাপ, কাল যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা

অনলাইন ডেস্ক: গত ১৮ মাসে বাংলাদেশে ঢুকেছে দেড় লাখ রোহিঙ্গা। সীমান্তে প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে আরও ৫০ হাজার অর্থাৎ অর্ধলাখ। এদিকে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) থেকে কক্সবাজার উখিয়া ও টেকনাফের আশ্রয়শিবিরে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মাথাপিছু মাসিক খাদ্যসহায়তা ১২ মার্কিন ডলার এবং নোয়াখালীর ভাসানচর আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গাদের জন্য ১৩ ডলার করে বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বহাল থাকবে। ১ সেপ্টেম্বর থেকে বরাদ্দ নতুন করে নির্ধারণ করার কথা রয়েছে। ফলে এই বরাদ্দ যাতে না কমে সেই চেষ্টাও চলছে। এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানের পথ খুঁজছে সরকার।

রোহিঙ্গা-সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও টেকসই সমাধানের পথ খুঁজতে কক্সবাজারে আজ রোববার বসছে স্টেকহোল্ডারস ডায়ালগ। রোহিঙ্গা ইস্যু বিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভের দপ্তর ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ২৪ থেকে ২৬ আগস্ট এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। ‘স্টেকহোল্ডারস ডায়ালগ :টেকঅ্যাওয়ে টু দ্য হাই-লেভেল কনফারেন্স অন দ্য রোহিঙ্গা সিচুয়েশন’ শীর্ষক এ আয়োজনকে বলা হচ্ছে আসন্ন নিউ ইয়র্ক সম্মেলনের প্রস্তুতিমূলক সংলাপ। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সাইডলাইনে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে উচ্চপর্যায়ের ঐ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। আরও একটি আন্তর্জাতিক সংলাপ এ বছরের শেষে দোহায় অনুষ্ঠিত হবে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তিন দিনব্যাপী এই আয়োজনে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ, কূটনীতিক, আন্তর্জাতিক সংস্থা, শিক্ষাবিদ এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা অংশ নেবেন। রোহিঙ্গা পুরুষ, নারী ও যুবকদের অভিজ্ঞতা ও মতামত সংলাপে বিশেষভাবে তুলে ধরা হবে, যাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সরাসরি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রত্যাশা সম্পর্কে জানতে পারে। সংলাপের দ্বিতীয় দিনে অর্থাৎ সোমবার অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ২৬ আগস্ট সংলাপের অংশ হিসেবে অংশগ্রহণকারীরা সরাসরি কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করবেন। সংলাপ থেকে প্রাপ্ত সুপারিশগুলোই আগামী সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠেয় উচ্চপর্যায়ের সম্মেলনে প্রস্তাবনা হিসেবে উপস্থাপন করা হবে।

রাখাইনে এখনো চলছে সংঘাত :মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি ক্রমশই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। রাখাইন রাজ্যের দখলদার সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। নতুন করে সংঘর্ষ শুরু হওয়ায় ঐসব এলাকার রোহিঙ্গারা ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। অনেকে নৌকায় নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করছেন। সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, গত শুক্রবার রাত ১০টার দিকে টেকনাফের হোয়াইক্যং সীমান্তে নাফ নদীর ওপারে রাখাইন রাজ্যের কয়েকটি গ্রামে গোলাগুলি শুরু হয়। থেমে থেমে সেই গোলাগুলি গতকাল শনিবার ভোর ৫টা পর্যন্ত চলতে থাকে। ওপারের গুলির শব্দ এপারের (হোয়াইক্যং) লোকজন শুনতে পেয়েছে।

এর আগে ১৯ আগস্ট রাতে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে রাখাইন রাজ্যের ‘নারকেল বাগিচা’ এলাকায় সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। আরাকান আর্মির দখলে থাকা দুটি সীমান্তচৌকির দখলে নিতে অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠী এ হামলা চালায় বলে জানা গেছে। সর্বশেষ গত শুক্রবার টেকনাফ বিজিবি নাফ নদীতে ৬২ জন রোহিঙ্গাকে প্রতিহত করেছে জানিয়ে টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আশিকুর রহমান বলেন, ওপারে হাজারো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় আছে বলে খবর পাওয়া গেছে। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নাফ নদী ও স্থলসীমান্তে বিজিবি তৎপর রয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মালয়েশিয়া সফরের সময় সে দেশের জাতীয় সংবাদ সংস্থা বারনামার সঙ্গে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে বলেছেন, গত ১৮ মাসেই দেড় লাখ নতুন রোহিঙ্গা দেশে এসেছেন। এরই মধ্যে দেশে থাকা ১২ লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন তারা। এ সমস্যা ক্রমেই আরও জটিল হচ্ছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা, যুক্তরাষ্ট্র তাদের (রোহিঙ্গা শরণার্থী) দেখভালের সব তহবিল বন্ধ করে দিয়েছে। তাই এটি আমাদের জন্য একটি বড় সমস্যা। দীর্ঘস্থায়ী এ মানবিক সংকট শুধু বাংলাদেশকেই প্রভাবিত করছে না, বরং মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়াসহ বেশ কয়েকটি আসিয়ান সদস্য দেশকে প্রভাবিত করছে।

সূত্রগুলো জানিয়েছে, রাখাইনে পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশ সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান নিয়েছে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে তারা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে। সম্প্রতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত রোহিঙ্গাবিষয়ক জাতীয় টাস্কফোর্সের (এনটিএফ) এক সভায় বিষয়টি জানানো হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন পররাষ্ট্রসচিব আসাদ আলম সিয়াম।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, জাতিসংঘ খাদ্য তহবিলের (ডব্লিউএফপি) তথ্য অনুযায়ী, আগামী নভেম্বরের পর ক্যাম্পে খাবারের জোগান দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের ব্যবস্থা এখনো হয়নি। আগামী সেপ্টেম্বরের পর ক্যাম্পবাসীদের তরলীকৃত গ্যাস (এলপিজি) সিলিন্ডার সরবরাহের জন্যও প্রয়োজনীয় তহবিল নেই, যা গাছপালা কাটার আশঙ্কা বাড়িয়ে দিচ্ছে। অন্য একজন কর্মকর্তা জানান, রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনার জন্য বিভিন্ন দেশ যে আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয়, এর প্রায় অর্ধেকই তারা পূরণ করে না।

সেপ্টেম্বর থেকে বরাদ্দ কমে যাওয়ার আশঙ্কা: কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরে বসবাসকারী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মাসিক খাবারের বরাদ্দ (রেশন) পহেলা সেপ্টেম্বর থেকে নতুন করে নির্ধারণ করা হবে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) গত মার্চে জানিয়েছে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত তারা আগের বরাদ্দই অব্যাহত রাখছে। কক্সবাজার উখিয়া ও টেকনাফের আশ্রয়শিবিরে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মাথাপিছু মাসিক খাদ্যসহায়তা ১২ মার্কিন ডলার এবং নোয়াখালীর ভাসানচর আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গাদের জন্য ১৩ ডলার করে বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

এর আগে খাদ্যসহায়তা সাড়ে ১২ ডলার থেকে ছয় ডলারে কমিয়ে আনার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) ও অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ডব্লিউএফপি তাকে চিঠি দিয়ে বলেছে, আগস্ট মাস পর্যন্ত একই ধরনের সহায়তা প্রদান করা হবে।

বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৩ লাখের বেশি। এর মধ্যে ভাসানচরের আশ্রয়শিবিরে স্থানান্তর করা হয় ৬০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা। ১৩ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে ৮ লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। গত আট বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।

গত চার বছরের আট গ্রুপের সংঘর্ষে ২০২ খুন : রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো অপরাধের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। সেখানে চলছে অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা। আর এ নিয়েই হচ্ছে খুনোখুনি। গত চার বছরে বিদ্যমান আট গ্রুপের সংঘর্ষে ২০২ জন খুন হয়েছে।

গ্রুপগুলো হলো, আরসা (আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি), আরএসও (রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন), আরাকান রোহিঙ্গা আর্মি (এআরএ), নবি হোসেন গ্রুপ (গ্রুপ প্রধান নিহত), মাস্টার মুন্না গ্রুপ, দীল মোহাম্মদ ওরফে মার্স গ্রুপ, ডাকাত সালমান গ্রুপ ও ডাকাত সাদ্দাম গ্রুপ। এসব গ্রুপের তৎপরতায় ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ২০২টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। কেবল আরসা, আরএসও এবং এআরএ-এর মধ্যে গ্রুপিংয়ের কারণেই ৬৭ ভাগ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় অবস্থিত ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আধিপত্যের লড়াই যেন ‘স্থায়ী সংস্কৃতিতে’ পরিণত হয়েছে। অস্ত্র ও মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করেই মূলত এ দ্বন্দ্বের সৃষ্টি, যা এখনো অব্যাহত। গত চার বছরের বিভিন্ন সময়ে আটটি গ্রুপের মধ্যে সংঘটিত এসব ঘটনায় অন্তত ২০২ জন খুন হয়েছেন। আহত হয়েছেন অসংখ্য।

দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর প্রতিমাসেই গড়ে একটি করে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। গত ১০টি ঘটনা ঘটেছে। গত ৮ মার্চ উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দুই পক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে একজন নিহত হন। ঐ দিন রাত সাড়ে ৯টার দিকে উখিয়া উপজেলার বালুখালী ৮-ইস্ট নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সশস্ত্র সংগঠন আরসা ও আরএসও সদস্যরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। দুই পক্ষের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে ঐ রোহিঙ্গা যুবক মোহাম্মদ রফিক (৩৩) গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।

Related Articles

Back to top button