মোটরবাইকে মানহীন হেলমেট বাড়ছে মৃত্যুঝুঁকি

অনলাইন ডেস্ক: সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এর ৪৯-চ ধারায় বলা হয়েছে, চালক ও আরোহীকে যথাযথভাবে হেলমেট ব্যবহার করতে হবে। যদি কোনো ব্যক্তি এই বিধান লঙ্ঘন করেন, তাহলে সেটি হবে অপরাধ। এজন্য তিনি অনধিক তিন মাসের কারাদণ্ড, বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসেবে দোষসূচক এক পয়েন্ট কাটা যাবে।

২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইনের ‘কারাদণ্ড’ ও ‘জরিমানা’ এড়াতে দুই-তিন বছর ধরে পালটে গেছে সেই চিত্র। চালক ও আরোহীদের অধিকাংশই এখন হেলমেট পরছেন; কিন্তু হেলমেট পরার হার বাড়লেও কমেনি দুর্ঘটনায় মৃত্যু। আইনে হেলমেট পরিধানের কথা বলা থাকলেও হেলমেটের মান নির্ধারণ করা নেই। এই সুযোগে আইন থেকে বাঁচতে মানহীন হেলমেটের ছড়াছড়ি সারা দেশে। এতে বাইক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ও স্থায়ী পঙ্গুত্ব বরণের হারও বাড়ছে। এর কারণ হিসেবে দায়ী করা হচ্ছে নিম্নমানের হেলমেটকে। মূলত মামলার ভয়ে হেলমেট পরেন চালক ও আরোহীরা। তবে তা বেশির ভাগই নিম্নমানের। এগুলোকে নামমাত্র হেলমেট বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মোটরসাইকেল চালক ও আরোহীদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান হারে মানহীন হেলমেট ব্যবহারের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। নির্মাণশ্রমিকদের জন্য ব্যবহূত প্লাস্টিকের হেলমেট সাধারণত মাথায় ইটপাথর বা হালকা কোনো বস্তু পড়া থেকে সুরক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বানানো হয়। এগুলোতে কোনো শক-অ্যাবজর্বার (ঝাঁকুনি সহনীয় করা) ও ফোম প্যাডিং বা ইমপ্যাক্ট রেজিস্ট্যান্স প্রযুক্তি থাকে না।

অন্যদিকে, মানসম্মত হেলমেট আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী একাধিক স্তর, শক্তিশালী ফাইবারগ্লাস/পলিকার্বোনেট ও অভ্যন্তরীণ ফোম সুরক্ষার মাধ্যমে মাথায় আঘাত শোষণ করে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব হেলমেট আসলে দুর্ঘটনার সময় কোনো ধরনের সুরক্ষা দিতে সক্ষম নয়, বরং চালক ও যাত্রীর জীবনকে আরো ঝুঁকিতে ফেলে। প্লাস্টিকের হেলমেট মাথায় দিয়ে মোটরসাইকেল চালালে সামান্য সংঘর্ষেও সেটি ভেঙে যায় এবং মাথার কোনো সুরক্ষা দিতে পারে না। এই দুর্ঘটনার কারণে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, ফ্র্যাকচার এমনকি মৃত্যুও ঘটে অহরহ।

দুর্ঘটনায় নিহতের পরিসংখ্যান :বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের পরিসংখ্যান মতে, ২০২৪ সালে দেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৭০৬ জন মারা গেছেন, যা মোট সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ৩১ দশমিক ১৩ শতাংশ। বাংলাদেশ রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, গত বছর মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২ হাজার ৬০৯ জন।

বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, রাজধানীসহ সারা দেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৮৮ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়েছে হেলমেট না পরার কারণে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে হেলমেট থাকা সত্ত্বেও দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। এর একমাত্র কারণ নিম্নমানের হেলমেটের ব্যবহার। বেশির ভাগ মোটরসাইকেল চালক ও আরোহীরা যে হেলমেট ব্যবহার করেন তা নিম্নমানের। খুব কমসংখ্যকই মানসম্মত হেলমেট ব্যবহার করেন।

রাইড শেয়ারিংয়ে ব্যবহার হচ্ছে মানহীন হেলমেট : রাজধানীসহ সারা দেশে মোটর রাইড শেয়ারিং পেশা ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আইনি জটিলতা এড়াতে হেলমেট ব্যবহারেও তারা বেশ তত্পর। অথচ সে হেলমেট একেবারেই হালকা ও নিম্নমানের।

রাইড শেয়ারিংয়ের বাইক-চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোম্পানির পক্ষ থেকে যে হেলমেট দেওয়া হচ্ছে, সেগুলোও নিম্নমানের। এগুলোকে চালকরা বলে থাকেন প্লাস্টিকের বাটি। রাইড শেয়ারিং কোনো কোম্পানিই ভালো মানের হেলমেট চালকদের সরবরাহ করছে না। মাত্র ২ থেকে ৫ শতাংশ চালক ভালো হেলমেট ব্যবহার করছেন, সেটাও নিজ উদ্যোগে।

মোটরসাইকেল-চালকদের হেলমেটের মান নির্ধারণে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআরটিএ) সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া হলেও এর কোনো অগ্রগতি নেই। আইন অনুযায়ী মোটরসাইকেল চালক ও আরোহীকে বিআরটিএ অনুমোদিত স্ট্যান্ডার্ড হেলমেট ব্যবহার করতে হবে। বাস্তবে দেখা যায়, পুরো দেশ মানহীন হেলমেটে সয়লাব। এতে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা প্রতিনিয়ত বাড়ছে।

মানহীন হেলমেট মৃত্যুঝুঁকি বাড়ায় : বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাথায় একটি ভালো মানের হেলমেট থাকলে বড় ধরনের আঘাত থেকে বেঁচে যান চালক বা আরোহী। সে ক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় আহত হলেও প্রাণহানির ঝুঁকি থাকে কম। কিন্তু নিম্নমানের হেলমেটগুলো আঘাত পাওয়া মাত্রই ভেঙে দুমড়েমুচড়ে যায়। ভাঙা প্লাস্টিক মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে ঢুকে মারাত্মক আঘাতের সৃষ্টি করে। এতে মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে। অনেকে আবার স্থায়ী পঙ্গুত্বের শিকার হন।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অর্থপেডিকস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশিদ বলেন, মাথার সুরক্ষার জন্য প্লাস্টিকের শ্রমিক হেলমেট ব্যবহার করা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এগুলো মোটেও দুর্ঘটনার ধাক্কা সামলাতে পারে না। বরং যাত্রীকে ভুয়া নিরাপত্তার ভ্রমে ফেলে। মোটরবাইক দুর্ঘটনায় মাথায় গুরুতর জখমপ্রাপ্ত এ রকম রোগীর হাত-পা ভেঙে যায়। এ রকম রোগীর প্রথমে অর্থপেডিকস বিভাগে চিকিত্সা দেওয়া হয়।

ঐসব রোগীর সঙ্গে কথা বলে ডা. হারুন অর রশিদ বলেন, ‘আহত রোগীদের বেশির ভাগই প্লাস্টিক টাইপের হেলমেট পরিহিত ছিলেন। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে হেলমেট মাথায় পরিধান না করে মোটরসাইকেলের সামনে ঝুলিয়েও রেখেছিলেন।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, যথাযথভাবে হেলমেট ব্যবহারে দুর্ঘটনা মৃত্যুঝুঁকি ৪০ শতাংশ কমে যায়। আর জখম থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায় ৭০ শতাংশ।

হেলমেটের মান নিয়ন্ত্রণে টেস্টিং ল্যাব : বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনে (বিএসটিআই) গত ১৪ জুলাই হেলমেট টেস্টিং ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে সব ধরনের হেলমেটের মান যাচাই করা হচ্ছে। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে বিএসটিআইর লোগো সংযুক্ত করা যাবে সংশ্লিষ্ট হেলমেটে। এই লোগোযুক্ত হেলমেটই ব্যবহার করতে হবে মোটরসাইকেল চালানোর সময়। শিল্পকারখানায় কাজ করার সময় শ্রমিকদেরও বিএসটিআইর স্বীকৃত হেলমেট ব্যবহার করতে হবে। হেলমেটের মান যাচাইয়ের ল্যাবটি পরিচালনা করছে বিএসটিআইয়ের পদার্থ পরীক্ষণ শাখা। এই শাখা সূত্রে জানা গেছে, দেশে আমদানি করা হেলমেটের সিংহভাগ আসে চট্টগ্রামের সমুদ্রবন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে। বিএসটিআই থেকে ঐ দুই বন্দরকে এ বিষয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। বিএসটিআইয়ের ছাড়পত্র ছাড়া এখন থেকে কোনো ধরনের হেলমেট খালাস হবে না।

Related Articles

Back to top button