গ্যাস সরবরাহের ৩৫ শতাংশ আসে আমদানি থেকে

গ্যাসের দৈনিক ৪৫০ কোটি ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে গড়ে ২৮৫ কোটি সরবরাহ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ১০০ কোটি ঘনফুটের বেশি সরবরাহ করা হচ্ছে আমদানিকৃত এলএনজি

অনলাইন ডেস্ক: দেশে গ্যাসের চাহিদা বৃদ্ধির বিপরীতে স্থানীয় উৎপাদন কমছে গত প্রায় দেড় দশক ধরে। চাহিদার সমান্তরালে গ্যাস অনুসন্ধান ও স্থানীয় উৎপাদন বাড়াতে পারেনি গত বছরের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। সরবরাহ বাড়াতে ২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক) আমদানি শুরু করা হয়। বর্তমানে এ আমদানি মোট গ্যাস সরবরাহের প্রায় ৩৫ শতাংশ দখল করেছে। জ্বালানি পরিস্থিতির যে প্রবণতা রয়েছে তাতে আগামী দিনে এটি আরও বাড়বে। ফলে দেশীয় উৎপাদন ও রপ্তানি খরচ নিশ্চিতভাবে বাড়বে বলে মনে করছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা।

দেশে একসময় শতভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন করত সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। নিরবচ্ছিন্ন, মানসম্পন্ন ও সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতের লক্ষ্য জানিয়ে বেসরকারি খাতে কেন্দ্র নির্মাণ বাড়ে এবং আমদানি শুরু হয়। বর্তমানে সরকারির চেয়ে বেসরকারি খাত ও আমদানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেশি। কিন্তু নির্ভরযোগ্য ও সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ এখনো নিশ্চিত হয়নি। বরং বিদ্যুতের দাম বেড়েই চলছে। গ্যাস পরিস্থিতি একই পথে হাঁটছে কি না তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে। প্রয়োজনীয় গ্যাস সরবরাহ করা হবে জানিয়ে বিগত বছরগুলোতে কয়েক বার দাম বাড়ানো হলেও পরিস্থিতি উন্নত হওয়ার চেয়ে আরও অবনতি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, স্থানীয় গ্যাস উৎপাদনের পাইপলাইনে শিগগিরই বড় উন্নতি হওয়ার আশা নেই। ফলে সরবরাহ বাড়াতে হলে আমদানি বাড়াতে হবে।

পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দৈনিক প্রায় ৪৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। ৩৬০-৭০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা গেলেও শিল্প, বিদ্যুৎ, বাণিজ্য, সার উৎপাদন ও আবাসিক চাহিদা মোটামুটি সামাল দেওয়া যায়। গত জুলাই মাসে দৈনিক গড়ে প্রায় ২৮৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এর মধ্যে দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুটের বেশি গ্যাস আসে আমদানিকৃত এলএনজি থেকে। সর্বশেষ গত সোমবার ২৭৮ কোটি ঘনফুট গ্যাস বিতরণ করা হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোর ধারা বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, বছরে প্রায় ১৮০ কোটি ঘনফুট স্থানীয় গ্যাস উৎপাদন কমছে।

সম্প্রতি বিভিন্ন দেশের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ‘পালটা শুল্ক’ কাঠামোতে প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক অবস্থানে থাকায় তৈরিপোশাকসহ রপ্তানিমুখী পণ্য উৎপাদনের চাহিদা বাড়বে বলে পূর্বাভাস রয়েছে। কিন্তু উৎপাদনের প্রধান জ্বালানি গ্যাস পর্যাপ্ত না পেলে এ সুবিধা খুব বেশি ব্যবহার করতে পারবে না বাংলাদেশ। তাই স্বল্প মেয়াদে গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে বিবিয়ানাসহ কয়েকটি গ্যাসক্ষেত্রে যতটুকু সম্ভব উৎপাদন বৃদ্ধি এবং এলএনজি আমদানি বৃদ্ধির পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। পাশাপাশি মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি রূপরেখাও তৈরি হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান গতকাল মঙ্গলবার ইত্তেফাককে বলেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্থানীয় উৎপাদন যতটুকু সম্ভব বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু স্বল্প মেয়াদে এটি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় সম্ভব নয়। স্বল্প মেয়াদে এলএনজি আমদানি বাড়ানোর যতটুকু সুযোগ রয়েছে ততটুকু ব্যবহারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, ২০২২-২৩ সালে ৬৭টি, ২০২৩-২৪ সালে ৮৩ কার্গো এলএনজি আমদানি করা হয়েছে। ২০২৪-২৫ সালে এটি আরও বেড়ে ৯৪টি হয়েছে। চলতি ২০২৫-২৬ সালে সেটি ১০৮ কার্গোতে বৃদ্ধির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, দেশে বর্তমানে দুইটি এলএনজি টার্মিনালের যে ধারণক্ষমতা আছে তা দিয়ে বছরে ১১৫ কার্গো এলএনজি আমদানি করা যাবে। সামর্থ্যের সবটুকু প্রয়োগ করা হবে। তিনি জানান, দুইটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন ও পরিকল্পনাধীন। এছাড়া স্থানীয় অনুসন্ধান, সংস্কার ও উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে যাতে কয়েক বছর সময় লাগবে। অর্থাৎ এ প্রকল্পগুলোর সুফল পেতে কয়েক বছর অপেক্ষা করা লাগবে।

সাত বছরে এলএনজি আমদানি, যত ব্যয় ও ভর্তুকি

২০১৮ সাল থেকে এলএনজি আমদানি শুরুর পর গত জুলাই পর্যন্ত ২ লাখ ৫ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা খরচ করেছে পেট্রোবাংলা। এর মধ্যে ৩৬ হাজার ৭১২ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে সরকার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে ১১ হাজার ৮১২ কোটি ৫২ লাখ টাকার এলএনজি আমদানি করা হয়। এই অর্থবছরে ভর্তুকি দেওয়া হয় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৭ হাজার ৫০২ কোটি ৯৮ লাখ টাকার এলএনজি আমদানি হয়, ভর্তুকি দেওয়া হয় ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৬ হাজার ৫০৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকার এলএনজি আমদানি করা হয়, ভর্তুকি দেওয়া হয় ৩ হাজার ৪৯৭ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪০ হাজার ৫৬২ কোটি ৭৭ লাখ টাকার এলএনজি আমদানি হয়, ভর্তুকি দেওয়া হয় ৬ হাজার কোটি টাকা।

২০২২-২৩ অর্থবছরে এলএনজি আমদানি করা হয় ৩৫ হাজার ২৭৪ কোটি পাঁচ লাখ টাকার, ভর্তুকি দেওয়া হয় ৬ হাজার ৩৩২ কোটি ৩ লাখ টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪২ হাজার ৮৪৪ কোটি টাকার এলএনজি আমদানি করা হয়, ভর্তুকি দেওয়া হয় ৬ হাজার ৩৫ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এলএনজি আমদানি করা হয় ৪০ হাজার ৭৫১ কোটি ৫৮ লাখ টাকার। মোট ভর্তুকি দেওয়া হয় ৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।

Related Articles

Back to top button