জুলাই সনদ কবে

ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ বাড়ল ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত
অনলাইন ডেস্ক: চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বহুল আলোচিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ প্রণয়ন হচ্ছে কবে? ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অঙ্গনে এটা এখন অন্যতম বড় এক প্রশ্ন।
জুলাই সনদ প্রণয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন শুরু থেকেই বলেছিল, তারা জুলাইয়ের মধ্যেই কাজ শেষ করতে চায়। জুলাই পেরিয়ে এখন আগস্টের মাঝামাঝি। তবে, সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন পদ্ধতির প্রশ্নে দলগুলোর মতের বড় ফারাক দেখা দিয়েছে। চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি গঠিত হওয়া ছয় মাস মেয়াদি ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল গতকাল মঙ্গলবার। গতকালই কমিশনের মেয়াদ আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ফলে ধারণা করা হচ্ছে, চলতি আগস্টও জুলাই সনদ প্রণীত হওয়ার সম্ভাবনা কম।
ঐকমত্য কমিশন ইতিমধ্যে জুলাই সনদের একটি খসড়া দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোকে। দলগুলো এর ওপর মতামতও দিয়েছে। তবে, জামায়াত, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ কয়েকটি দল বলেছে—জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি থাকতে হবে এবং আগামী সংসদ নির্বাচন হতে হবে জুলাই সনদের ভিত্তিতে। দলগুলোর কেউ কেউ এমনও বলেছেন, আইনি ভিত্তি না থাকলে তারা জুলাই সনদে সই করবে না। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম গতকাল ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘জুলাই ঘোষণাপত্রে ছাড় দেওয়া হলেও জুলাই সনদে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না’। সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর ব্যাপক মতভিন্নতার কারণে পুরো প্রক্রিয়াটিই এক ধরনের জটিলতার মধ্যে পড়েছে।
জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি এবং এর বাস্তবায়নের পদ্ধতি খুঁজছে ঐকমত্য কমিশনও। পদ্ধতির খোঁজে কমিশন নিজেদের গৃহীত পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী রবিবার থেকে আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতামত নিতে শুরু করেছে। রবিবার ঐকমত্য কমিশন আলোচনা করেছে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন, বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন মোহাম্মদ ইকরামুল হক, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট ড. শরিফ ভূঁইয়া, ব্যারিস্টার তানিম হোসেইন শাওন ও ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিকের সঙ্গে।
জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে অনুষ্ঠিত এই আলোচনা শেষে কমিশন জানিয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদের আইনি বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা এবং বাস্তবায়নের পদ্ধতি কী হবে—সেটির উপায় খুঁজে বের করার লক্ষ্যে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কমিশন এই আলোচনা শুরু করেছে। কমিশন এ-ও জানিয়েছে, তারা আরও বিশেষজ্ঞের মতামত নেবে। তাদের মতামতসমূহ ঐকমত্য কমিশনের চেয়ারম্যান ও প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে উপস্থাপন করা হবে। এছাড়া, মতামতগুলো রাজনৈতিক দলগুলোকেও পাঠাবে কমিশন। এরপর কমিশন দলগুলোর কাছে জুলাই সনদের সংশোধিত খসড়া পাঠাবে বলে জানা গেছে।
জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়া এবং বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোতে সৃষ্ট মিশ্র প্রতিক্রিয়ার মধ্যে গত শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, জুলাই সনদের বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা ও বাস্তবায়নের পদ্ধতি নির্ধারণের জন্য আবারও আলোচনা শুরু করছে কমিশন। প্রথমে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা হবে। যার ধারাবাহিকতায় রবিবার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসেছে কমিশন। ঐ আলোচনার আলোকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তৃতীয় পর্বের আলোচনায় বসবে কমিশন। জানা গেছে, তৃতীয় পর্বের এই আলোচনা শেষে সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর সই নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে কমিশনের। এর মধ্য দিয়ে কমিশন পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে চায় জুলাই জাতীয় সনদের।
কমিশন সূত্রে জানা গেছে, রবিবার আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়নের উপায় সম্পর্কে একাধিক বিকল্প পরামর্শ এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে— গণভোটের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়ন, অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বাস্তবায়ন কিংবা আইনি ভিত্তি দেওয়ার পদ্ধতি সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের মতামত বা রেফারেন্স গ্রহণ। তবে, অধ্যাদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানা সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরে বিশেষজ্ঞরা এটাও বলেছেন—সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও নতুন করে বড় অনৈক্য দেখা দিতে পারে।
ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে জানানো হয়েছে, প্রথম পর্বের আলোচনায় ১৬৫টি প্রস্তাবের মধ্যে ৬২টিতে রাজনৈতিক ঐকমত্য অর্জিত হয়েছে। যার কিছু কিছু সরকার এরই মধ্যে বাস্তবায়ন করেছে (অধ্যাদেশ, নীতি ও নির্বাহী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে)। দ্বিতীয় পর্বের সংলাপে গুরুত্বপূর্ণ ২০টি সাংবিধানিক বিষয়ে আলোচনা হয়। সেখানে ১১টি বিষয়ে সব দলের সমর্থনে জাতীয় ঐকমত্য এবং বাকি ৯টি বিষয়ে নোট অব ডিসেন্টসহ (ভিন্নমত) সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে, তাতে কোন কোন দলের ভিন্নমত রয়েছে তা উল্লেখ থাকবে। অন্যদিকে, প্রথম পর্যায়ের আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যাপক মতভিন্নতার কারণে ২৫টি বিষয়ে আলোচনা হয়নি।
উল্লেখ্য, গত বছরের অক্টোবর সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, প্রশাসন ও পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। গত ফেব্রুয়ারিতে কমিশনগুলো প্রতিবেদন দেয়। পরে সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। এরপর ছয়টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো দুই ভাগে ভাগ করা হয়। একটি হলো—‘আশু বাস্তবায়নযোগ্য’ সুপারিশ, সেগুলো বাস্তবায়নে কাজ চলছে। অন্যটি হলো ১৬৬টি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ। এগুলো নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেছে ঐকমত্য কমিশন। প্রথম পর্বে ৩৩টি দলের সঙ্গে (২০ মার্চ-১৯ মে) আলাদাভাবে আলোচনা হয়। গত ৩ জুন থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত দ্বিতীয় পর্বে ৩০টি দলের সঙ্গে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করে ঐকমত্য কমিশন।
পাঁচ সংস্কার কমিশনের মেয়াদ শেষ, সুপারিশের জন্য ধন্যবাদ দিল সরকার
এদিকে, পাঁচটি সংস্কার কমিশনের কার্যক্রম শেষে ধন্যবাদ জানিয়েছে সরকার। এর মধ্যে চারটি সংস্কার কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ৩০ এপ্রিল এবং একটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ৩১ মে। গতকাল মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে এই ধন্যবাদ জানানো হয়। গত ৩০ এপ্রিল কার্যক্রম শেষ হওয়া ৪ সংস্কার কমিশনগুলো হচ্ছে—শ্রম সংস্কার কমিশন, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন এবং স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন। এছাড়া নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ৩১ মে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সংস্কারের জন্য সুপারিশ প্রদানের মহান দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করায় সরকার কমিশনগুলোকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করল।