অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর

এখনো কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি পুলিশ

৫ আগস্টের আগের ও পরের দুই ধরনের আনুগত্যের বিভাজনের মধ্য দিয়ে পুলিশ কাজ করছে: আইজিপি

অনলাইন ডেস্ক: আজ থেকে ৩৭০ দিন আগে পুলিশ বাহিনী বিধ্বস্ত হয়ে মাঠ ছেড়ে চলে গিয়েছিল। ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করতে গিয়ে নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। এতে নারী-শিশুসহ নিহত হয় দেড় হাজারের বেশি ছাত্র-জনতা। গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর তীব্র গণরোষে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে পুরো পুলিশ বাহিনী, ভেঙে পড়ে শৃঙ্খলা। বাহিনীতে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক-অস্থিরতা। এরপর কেটে গেছে একটি বছর। দীর্ঘ এ সময়ও আইনশৃঙ্খলা প্রত্যাশা অনুযায়ী উন্নতি করতে পারেনি বলে জানিয়েছেন সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, গণঅভ্যুত্থানের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যেভাবে পুলিশের ঘুরে দাঁড়ানো প্রয়োজনীয়তা ছিল, তা হয়নি। ফলে জনমনে স্বস্তি ফিরছে না, পুলিশ নিজেও স্বস্তি পাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে অপরাধ সংঘটিত স্থলে পুলিশের সহযোগিতা চেয়েও পাওয়া যায় না। কারণ মানসিকভাবে ভেঙে পড়া পুলিশ সদস্যদের মধ্যে জনতার প্রতিশোধমূলক ‘মব ভায়োলেন্স’-এর ভয় এখনো কাজ করছে। যে কারণে পুলিশ এখনো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শক্ত হাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করতে পারছে না। তবে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে পুলিশ বাহিনী।

পুড়ে যাওয়া থানা সংস্কার হয়েছে। আনা হয়েছে কিছু গাড়িও। ধীরে ধীরে সক্রিয় হয়ে মাঠে কাজ শুরু করেছে পুলিশ। আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ অবস্থায় নির্বাচন উপলক্ষে পুলিশ কতটুকু প্রস্তুত? এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, ‘গত ১৫ বছরে দলীয় আনুগত্যের ওপর পুলিশে নিয়োগ হয়েছে। তারা তো লাইম লাইটে ছিল। তারা এখনো পুলিশে রয়েছে। আবার বিগত ১৫ বছরে ফ্যাসিস্ট সরকারের নিপীড়ন নির্যাতনে পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন, তারাও এই এক বছরে পদোন্নতি পেয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। তারাও এক ধরনের আনুগত্যের মধ্য দিয়ে পুলিশে রয়েছেন। এই দুই ধরনের আনুগত্যের বিভাজনের মধ্য দিয়ে পুলিশ বাহিনীকে এক বছরের মধ্যে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এজন্য আরও সময়ের দরকার। তবে সামনে যেহেতু একটি জাতীয় নির্বাচন রয়েছে, সেই নির্বাচনটিকে আমরা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য মাঠে কাজ করছি। আমাদের প্রধান লক্ষ্য নির্বাচনকে সুষ্ঠু করা।’

পুলিশের মনোবল কতখানি ফিরেছে?— জানতে চাইলে পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম বলেন, ‘গত ১৫ বছরে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দিয়ে পুলিশ নামের যে ইনস্টিটিউশন ছিল, সেটাকে ধ্বংস করা হয়েছে। সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে পুলিশকে টেনে তুলতে আরও সময় লাগবে। এই বাহিনীর সদস্যদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের কারণে তাদের মনোবল তলানিতে চলে গিয়েছিল। সেখান থেকে ধীরে ধীরে এখন একটা জায়গায় পৌঁছেছে। আমি বলব না যে, পুলিশ পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে গেছে। কিন্তু অনেকটাই গোছালো জায়গায় এসেছে। এখন আমরা নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করব।’

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পুলিশ সদর দপ্তরের একাধিক সূত্র বলছে, গত বছরের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে পুলিশের দমন-পীড়নসহ নানা কার্যক্রম নিয়ে জনমনে প্রশ্ন ওঠে। পুলিশ সম্পর্কে ব্যাপক নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। পরবর্তীকালে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার পর ঢাকাসহ দেশের অন্তত ৪৫০টি থানায় হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। পুলিশ সদর দপ্তর, বিভিন্ন জেলা পুলিশের কার্যালয়, ট্রাফিক পুলিশ বক্সসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা ও ভাঙচুর হয়। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় অনেক থানা ভবনে। লুট করা হয় অস্ত্র, গোলাবারুদ ও সরঞ্জাম। অনেক পুলিশ সদস্য ইউনিফর্ম খুলে গা ঢাকা দেন। কেউ কেউ দেশ ত্যাগ করে পালিয়ে যান। এ ঘটনায় প্রবল ঝুঁকির মধ্যে সারা দেশের থানাগুলো কার্যত পুলিশশূন্য হয়ে পড়ে। দেশের সবচেয়ে বড় এই বাহিনীর সদস্যদের কর্মস্থল ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া ছিল ইতিহাসে নজিরবিহীন একটি ঘটনা। নিরাপত্তাশঙ্কায় দীর্ঘদিন দেশের থানাগুলোতে পাহারায় থাকেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা।

এ সময় পুলিশকে কাজে ফেরানো এবং সক্রিয় করাই ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে পুলিশকে কাজে ফেরানো হয়। সচল করা হয় ভেঙে পড়া প্রশাসনিক ব্যবস্থা। এরপর সামনে আসে অপরাধ দমন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জ। এছাড়া ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে যেসব পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্য গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন, গুলি চালিয়েছিলেন, তাদের আইনের আওতায় আনার কাজও চলমান। এর সঙ্গে পুলিশের অভ্যন্তরীণ সংস্কারকাজ ও বাহিনীটিকে ঢেলে সাজানোর জন্য কাজ শুরু করে অন্তর্বর্তী সরকার।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এরই অংশ হিসেবে রদবদলের মাধ্যমে সারা দেশে ৫০ সহস্রাধিক পুলিশের রদবদল করা হয়। গ্রেফতার করা হয় ৬৩ পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যকে। এছাড়া বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয় ৫৫ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে।

পুলিশ সদর দপ্তরের এক অপরাধ পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত গত এক বছরে খুনের মামলা হয়েছে ৩ হাজার ৮৩২টি। এর মধ্যে গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত খুনের মামলা হয় ১ হাজার ৯৩৩টি। আর আগের ছয় মাসে এ সংক্রান্ত মামলা হয় ১ হাজার ৮৯৯টি। অন্যদিকে ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে ২০২৪-এর জুন পর্যন্ত ১১ মাসে সারা দেশে খুনের মামলা হয়েছে ২ হাজার ৭৪২টি।

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আরিফুর রহমান তুহিন বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত ছিল সবার আগে পুলিশকে পুনর্গঠন করা। কিন্তু এক বছর পরে এসেও পুলিশ তার আগের অবস্থানেই আছে। প্রস্তাবিত পুলিশ কমিশন বাস্তবায়ন করে বাহিনীকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, ৫ আগস্টের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পুলিশের যেভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রয়োজনীয়তা ছিল, তা হয়নি। এর অন্যতম কারণ গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে অনেক পুলিশ সদস্য নৈতিক ও মনোবলসংকটে পড়েছে। তাদের কর্মকাণ্ড সমালোচিত ও বিতর্কিত হয়েছে। তাই এই পরিস্থিতি এত দ্রুত স্বাভাবিক হবে না। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে ভালো কাজের মাধ্যমে পুলিশকেই তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ ও বিতর্কের অবসান ঘটাতে হবে।

Related Articles

Back to top button