আজ বিশ্ব আদিবাসি দিবস

আদিবাসি নয়, জাতিগত পরিচয় আগে, এরপর আমরা বাংলাদেশী
অনলাইন ডেস্ক: পাহাড়ের রূপ সৌন্দর্য্যরে নীলাভূমি বান্দরবান। জেলা শহর থেকে পাহাড়ী পথে রুমা থানা শহরের দূরুত্ব ৪৩ কিলোমিটার। এই ৪৩ কিলোমিটার পথ পুরাটাই পাহাড়ী পথ। পাহাড়ের উঁচু-নিচু ঢাল বেয়ে সরু রাস্তা ধরে যেতে হয়। রাস্তার দুই পাশের দাঁড়িয়ে আছে উঁচু-নিচু পাহাড়ের ঘন জঙ্গল। বর্ষায় জঙ্গলের গাছপালা আরো সবুজ হয়ে গেছে। যেদিক চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ।
পাহাড়ের পাদদেশে ছিমছাম পরিবেশে রুমা বাজার দেশের পর্যটকদের রাত যাপনের জন্য একটি সুপরিচিত স্থান। সর্বোচ্চ পাহাড় তাজিংডং কিম্বা কেওকারাডং অথবা পাহাড়ের ওপর বগালেক দর্শন করতে হলে সবাইকে রুমা বাজার দিয়ে যেতে হয়। রুমা বাজারের আশেপাশে বেশ কয়েকটি বোম পরিবার অধ্যুষিত পাড়া রয়েছে। বম জনগোষ্ঠীর সবাই এখন খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত। রুমা উপজেলা শহরে বম অধ্যুষিত একটি পাড়ার নাম বেথেল পাড়া। রুমা উপজেলার সবচেয়ে বড় গির্জাটি বেথেল পাড়ায় গড়ে উঠেছে।
বিয়াক আল বম। বয়স আনুমানিক ৬০ বছর। রুমা সদর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের তিনি মেম্বার। বমদের জাতি গোষ্ঠীর পরিচয় সম্পর্কে জানতে চাইলে বিয়াক আল বম বলেন, বেথেল পাড়ায় ১৬০ টি পরিবার বসবাস করে। আমরা সবাই খ্রিষ্ট ধর্মের। আমাদের এখানে বম ভাষায় বাচ্চাদের পড়াশুনার জন্য একটা স্কুল ছিল। কিন্তু বছর দুই তিনেক আগে সেটি বন্ধ হয়ে গেছে।
আপনারা নিজেদেরকে কি হিসাবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন-জানতে চাইলে বিয়াক বলেন, আমরা তো জাতিতে বম। কিন্তু আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয় আমরা বাংলাদেশী। বাংলাদেশী পরিচয় দিতে আমরা চাই।
আদিবাসী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা উপজাতি-এসবের মধ্যে কোনটিকে আপনাদের পছন্দের-জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আদিবাসী বা উপজাতি কোনটিই নয়। আমরা বাংলাদেশী বলতে চাই। এটা তো বাংলাদেশ। বাংলাদেশী বলতে সমস্যা কোথায়?’
বেথেল পাড়ার বাসিন্দা লালরাম স্যাং বম বলেন, আমাদের জাতিগত পরিচয় বম জনগোষ্ঠী। কিন্তু দেশটা তো বাংলাদেশ। এই দেশে যারা থাকবেন, সবাই বাংলাদেশী। বাংলাদেশী বলতে সমস্যা কোথায়?
বান্দরবানের রুমা উপজেলার বগালেক এলাকার কারবারি রিয়েল মুন বলেন, আমরা আদিবাসি হতে যাব কেন? আমরা তো বম জনগোষ্ঠীর। আমরা এখন খ্রিষ্ট ধর্মের দীক্ষা গ্রহণ করেছি। আর যেহেতু এটা বাংলাদেশ, তাই আমরা বাংলাদেশী বলব। এখানে জাতির পরিচয় ঠিক থাকলেই হল।
পাহাড়ে কারা আদিবাসি জানতে চাইলে বলেন, ‘আমরা তো আগে এসেছি এখানে। বাঙালিরা পরে এসেছে। কিন্তু আমাদের দেশ তো একটাই। সেটা বাংলাদেশ। সবার জাতিগত পরিচয় আগে। যেমন ধরুন আপনি বাঙালি, আমি বম। এরপর তো আমরা সবাই বাংলাদেশী।’
আজ বিশ্ব আদিবাসি দিবস। জাতিসংঘ ১৯৯৪ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী পালন করে আসছে এই দিবসটি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে আদিবাসী শব্দ নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে আদিবাসী আছে বা নেই তা নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে বিতর্ক চলছে। এই বিতর্কের বয়স খুব বেশী নয়, মাত্র ১৬/১৭ বছর। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৫৪ বছর আগে। বাংলাদেশে বর্তমানে যারা নিজেদেরকে আদিবাসী হিসেবে দাবি করছেন তারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মলগ্নের আগে থেকেই এই অঞ্চলের অধিবাসী।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত ৬১তম অধিবেশনে ‘আদিবাসীদের অধিকার সম্পর্কিত জাতিসংঘের ঘোষণাপত্র’ উত্থাপন করা হয়। এই ঘোষনাপত্রটি বিশ্বের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য ব্যাপক সুবিধা সম্বলিত একটি আইনি কাঠামো। এর মাধ্যমে ঘোষনাপত্রে স্বাক্ষরকারী বা পক্ষে ভোট দানকারী রাষ্ট্রসমূহ তার দেশের আদিবাসীদের জন্য ঘোষনাপত্র অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা প্রদানে বাধ্য।
২০০৭ সালে এই ঘোষনাপত্র প্রকাশের পর হতেই কিছু সুবিধাবাদী উপজাতি নেতৃবৃন্দ নিজেদেরকে অযাচিতভাবে আদিবাসি হিসেবে দাবি করা শুরু করেন। প্রাথমিক পর্যায়ে অনেক উপজাতীয় নেতৃবৃন্দ এই আদিবাসী স্বীকৃতি দাবীর বিপক্ষে ছিলেন। এমনকি জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সভাপতি সন্তু লারমাও প্রাথমিক পর্যায়ে এই দাবির বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। তবে যখন তিনি উপলব্ধি করেন যে আদিবাসি স্বীকৃতি পেলে অনেক বেশী সুযোগ সুবিধা পাওয়া যাবে তখন তিনি তার পূর্বের অবস্থান থেকে সরে এসে আদিবাসি দাবির পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন।
আদিবাসি বিতর্ক: ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। শান্তিচুক্তির ‘ক’ খন্ডের ১ নম্বর ধারায় পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে বিবেচনার কথা বলা হয়েছে। চুক্তির ‘খ’ খন্ডের ১ নম্বর ধারায় পার্বত্য জেলা পরিষদের আইনে বিভিন্ন ধারায় ‘উপজাতি’ শব্দটি বলবৎ থাকবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এরকমভাবে পার্বত্য শান্তি চুক্তিতে মোট ১৭ বার উপজাতি শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।
২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ৬১তম অধিবেশনে আদিবাসী বিষয়ক ঘোষনাপত্র উপস্থাপন করা হলে বাংলাদেশ অন্যান্য কয়েকটি দেশের সঙ্গে ভোটদানে বিরত থাকে। বাংলাদেশে কোন আদিবাসি জনগোষ্ঠী না থাকার কারনেই বাংলাদেশ ভোট দানে বিরত থাকে। বাংলাদেশ সরকার পত্রের মাধ্যমে জাতিসংঘকে আদিবাসি বিষয়ে রাষ্ট্রের অবস্থান ব্যাখ্যা করে। পত্রে বাংলাদেশ তার অবস্থান পরিস্কার করে বলে, ‘দেশটিতে কিছু উপজাতি জনগোষ্ঠী রয়েছে এবং কোনও আদিবাসী জনগোষ্ঠী নেই।’ জাতিসংঘে প্রেরিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতামতের সঙ্গে একমত পোষণ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা একটি পত্রে বলা হয়, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাসরত জনগোষ্ঠী দুটি প্রধান ভাবে বিভক্ত যথা- (ক) উপজাতি ও (খ) অ-উপজাতি (বাঙালি)।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় হতে যখন এই পত্রটি প্রেরণ করা হয় তখন বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছিল। প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদায় স্পেশাল এ্যাসিটেন্ট হিসেবে চাকমা সার্কেল প্রধান ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান ছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে চাকমা সার্কেল প্রধান ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায় ও তার স্ত্রী ইয়েন ইয়েন আদিবাসি দাবির পক্ষে দেশে-বিদেশে প্রচারণা চালাতে দেখা গেছে। অথচ ২০০৮ সালে ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায় নিজেই ঘোষণা করেছিলেন যে, পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীরা উপজাতি এবং বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই। নতুন ভূখন্ড আবিষ্কার এবং সেখানে নতুন করে কোন জনগোষ্ঠী বসতি স্থাপন করা ছাড়া আদিবাসী হওয়ার সুযোগ নেই।
দেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সংখ্যা প্রায় ১৬ লক্ষ ৫০ হাজার ৪৭৮ জন। সমগ্র জনগোষ্ঠীর প্রায় এক শতাংশের মতো (০.৯৯%)। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী অধিকাংশ পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি এবং ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, সিলেট, রাজশাহী, রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলে বসবাস করে। এদের মধ্যে রয়েছে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, খেয়াং, চাক, খুমি, কুকি, বম, লুসাই, পাংখোয়া, সাঁওতাল, মনিপুরী, ওরাঁও, মুন্ডা, টিপরা, হাজং, খাসিয়া, মং, মুরং, রাজবংশী, কোচ, হদি, পাহাড়ী, মালপাহাড়ী, ভূমিজ, কোল ইত্যাদি।