মৌসুমেও বাড়ছে চালের দাম

চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে ভয়-বাধাহীন বাজার ব্যবস্থাপনার তাগিদ সংশ্লিষ্টদের
অনলাইন ডেস্ক: বাজারের চাহিদার অনুপাতে সরবরাহে অনিশ্চয়তা প্রায়শই চালের দামের অস্থিরতা তৈরি করছে। যা চালের মূল ধারার ব্যবসায়ীদের বিশেষ করে মিলারদের লক্ষ্য করে অবাঞ্ছিত সমালোচনার জন্ম দেয় বলে মন্তব্য করেছেন বাজার বিশ্লেষকরা। সাম্প্রতিক বছরগুলোর উদাহরণ তুলে ধরে তারা জানান, সরবরাহ বাড়ার কারণে দাম কমার সাধারণ প্রবণতার বিপরীতে আমন ও বোরো ফসল কাটার শীর্ষ মৌসুমেও ধানের দাম বেশি ছিল। কারণ নতুন ব্যবসায়ীরা বাজারে ধান সংগ্রহ করতে যখন মরিয়া হয়ে ওঠেন তখন অনেক কৃষক ভবিষ্যতে আরও উচ্চমূল্যের আশায় ধান মজুত করে রাখেন।
প্রসঙ্গত, গত এক বছরে বাজারে চালের দাম অনেক বেড়েছে। টিসিবির তথ্যমতে, এক বছর আগে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি নাজিরশাইল চাল বিক্রি হয়েছে ৬০ থেকে ৭৮ টাকা, বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ৭৫ থেকে ৮৫ টাকার মধ্যে। পাইজাম চাল এক বছর আগে বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৫৪ থেকে ৫৮ টাকা। বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭৫ টাকা। ইরি চাল এক বছর আগে প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ৫০ থেকে ৫৪ টাকায়। বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়।
বাজার বিশ্লেষকরা বলেন, মিলারদের ওপর ধান সংগ্রহ এবং মজুত করার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধের ফলে বর্তমান এবং ভবিষ্যতের বাজারের চাহিদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করার ক্ষেত্রে ধান চাল সংরক্ষণ ও সরবরাহের সক্ষমতা কমে যায়। চালের দাম নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেট গঠনের অভিযোগ উঠলে ব্যবসায়ীরা উদ্বিগ্ন হন। এর ফলে সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তারা পর্যাপ্ত পরিমাণে ধান চাল সংরক্ষণ করতে পারেন না বলেও মাঠ পর্যায়ে প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা গেছে। ধান উৎপাদনে দেশের উত্তরাঞ্চলের অন্যমত জেলা দিনাজপুরের শেতাবগঞ্জ মুরালিপুরের তালুকদার আটো রাইস মিলের ব্যবস্থাপক ফরিদুল ইসলাম ফারুক ইত্তেফাককে জানান, অর্থ ও সরবরাহ সংকটে অনেক মিল ধারণক্ষমতা অনুযায়ী মৌসুমে প্রয়োজনীয় ধান সংগ্রহ করতে পারছে না। ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের চাপে এলাকার অনেক রাইস মিল বন্ধ হয়ে গেছে। তার মতে, ছোট ও মাঝারি ক্ষমতার অটো রাইস মিলগুলো বর্তমান বাজার প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। কিছু মিল চলছে দৈনিক ভাড়া ভিত্তিতে। ধান চাল বিক্রি করে নয়, খুদ-কুঁড়া বিক্রি করে কিছু ব্যবসায়ী এখনো এ ব্যবসায় টিকে রয়েছেন। ফরিদুল ইসলাম জানান, খুচরা পর্যায়ে চালের দাম বাড়ার মূল কারণ অনুন্নত সরবরাহ ব্যবস্থা। কৃষক থেকে খুচরা ক্রেতা—এর মধ্যে অন্তত সাত হাত বদল হয়। আর প্রতি হাত বদলের সঙ্গে রয়েছে পরিবহন ও শ্রমিক খরচ এবং লাভের হিসাব।
শেতাবগঞ্জে চাল উৎপাদনকারী অন্যমত বৃহৎ প্রতিষ্ঠান উত্তার অটো রাইস মিলের মালিক আকতারুল ইসলাম জানান, বাজারে সরু চালের দামে বেশি তারতম্য ঘটে। বাজার চাহিদা অনুযায়ী সরু চাল সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে গিয়ে অনেকে ধান মজুত করে রাখেন। এক মৌসুমের কেনা ধান থেকে পরবর্তী মৌসুম পর্যন্ত চাহিদা মেটাতে প্রতি বস্তা ধানের মজুত ব্যয় বাড়ে (ব্যাংক সুদ, ওজন হারানো, গুদাম ভাড়া ও শ্রমিক মজুরি) অন্তত ৫০০ টাকা। এই খরচ যখন চালের দামে যুক্ত হয় তখনই দাম বেড়ে যায়।
এই ব্যবসায়ীর মতে, যেসব কারণে ধান-চালের দাম বাড়ে কমে তার মধ্যে রয়েছে—মৌসুমের শুরুতে অঢেল টাকার জোগান থাকলেও মৌসুম শেষে ধানের সরবরাহ কমে গেলে ধানের দাম বেড়ে যায়। আবার সরকারের ভর্তুকিমূল্যে চাল বিক্রির ঘোষণা এবং ভারতসহ অন্যান্য দেশ থেকে চালের আমদানি শুল্ক হ্রাস এবং চাল আমদানি উন্মুক্ত করে দেওয়ার ঘোষণায় ধান-চালের দামে বড় তারতম্য ঘটে। এক প্রশ্নের জবাবে অকতারুল ইসলাম বলেন, যেখানে ব্যবসায় আপন ভাইয়ে ভাইয়ে এক থাকা যায় না, সেখানে ১৩ হাজার অটো রাইস মিল মালিকদের মধ্যে সিন্ডিকেটে কীভাবে সম্ভব? তার মতে, লাখ লাখ কৃষক আর হাজার হাজার ব্যবসায়ী সম্পৃক্ত পণ্যগুলোতে কখনো সিন্ডিকেট করা সম্ভব নয়। এ ধরনের অভিযোগ বাস্তবতাবিবর্জিত।
বেচাগঞ্জের রামচন্দ্র গুপ্তর প্রতিষ্ঠান এসপি অটোরাইস মিলস লিমিটেড। পাঁচ দশকের পারিবারিক ব্যবসা। হাসকিন মিল থেকে অটো রাইস মিল করেছেন। তিনি জানান, ধান-চালের ব্যবসায় কোনো যোগসাজশ বা সিন্ডিকেটের সুযোগ নেই। তবে ধানের উৎপাদন না বাড়া সত্ত্বেও এ ব্যবসায় যখনই ক্রেতা-বিক্রেতার সংখ্যা এবং টাকার সরবরাহ বেড়ে যায় তখনই ধান চালের দামও বাড়ে। তার মতে, প্রচলিত মজুত আইনের কারণেও বাজারে চাল সরবরাহে ভাটা পড়ে। কারণ সচ্ছল মিলগুলোও বর্তমান আইনি বিধিনিষেধের কারণে মিলগুলো সরু চালের ধান ১৮০ দিন এবং মোটা ধান ৪৫ দিনের অতিরিক্ত সংরক্ষণ করতে পারে না। যার ফলে মিলগুলোর সক্ষমতা অনুযায়ী ধানের মজুত শেষ হলে পরবর্তী সময়ে বাড়তি দরে ধান কিনে চাল উৎপাদন করতে হয় এবং বাজারে এর প্রভাব পড়ে। অতীতের তুলনায় সামর্থ্য বাড়ায় অন্তত ৩০ শতাংশ কৃষক তাদের উৎপাদিত ধান বেশি দরে বিক্রির জন্য সংরক্ষণ করে।
শেতাবগঞ্জের বাতাসন এলাকার ধান ও ভুট্টার ব্যবসায়ী আজিজুল হক। তানজিল ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী দেড় দশকের এই ব্যবসায়ীর মতে, সরকারের হঠাৎ হঠাৎ নীতি পরিবর্তন ও সিদ্ধান্তের কারণে ধান চালের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। এতে সাধারণ ক্রেতার মতো প্রান্তিক ব্যবসায়ীরাও বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ে। সরকার চাল আমদানিতে শুল্ক আরোপ করলে কিংবা আমদানি নিষিদ্ধ করলে ধানে বস্তা (৮০ কেজি) প্রতি ১ থেকে ২০০ টাকা লাভ করা যায়। আবার শুল্ক প্রত্যাহার বা আমদানি উন্মুক্ত করে দিলে একইভাবে লোকসান গুনতে হয়।
আজিজুলের বক্তব্যের সত্যতা মিলেছে বেচাগঞ্জের আটগাঁওয়ের কৃষক মো. রইসুল আলমের বর্ণনায়। তিনি তার চার একর জমিতে উৎপাদিত ৩৬০ মন ধানের পুরোটাই শুকিয়ে রাখার তথ্য দিয়ে বলেন, মৌসুমের শুরুতে প্রতি বস্তা ধান (বিআর ২৯) ১ হাজার ৮০০ টাকায় বিক্রি করা যেত। এক বস্তাও বিক্রি করিনি। শুকিয়ে সংরক্ষণ করায় প্রতি বস্তার ব্যয় পৌঁছাবে ২ হাজার ১০০ টাকায়। মিলারদের টান বাড়লে প্রতি বস্তা ২ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা দরে বিক্রি করা যাবে। তিনি জানান, আগে কৃষকদের সচ্ছলতা ছিল না, ধার দেনা, সুদ এমনকি দাদন নিয়ে ধান চাষ করতে হতো। তাছাড়া আগের তুলনায় ধানের উৎপাদনও প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। ফলে এখন অনেকে কৃষকই খরচ তুলতে মৗসুমের শুরুতে কিছু ধান বিক্রি করে বাকি ধান বেশি দামে বেচার জন্য রেখে দেন।
ধান ও চালের উচ্চমূল্য নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. রুশাদ ফরিদী বলেন, যদি অনেক কৃষক আগামী মাসগুলোতে ভালো দামের আশায় ফসল কাটার মৌসুমে ধান মজুত করে রাখেন, তা বাজারের স্থিতিশীলতার জন্য ভালো। কারণ ধান বা চালের ঘাটতি বা সংকট দেখা দিলে কৃষকরা তাদের মজুতকৃত ধান সরবরাহ করতে পারেন। সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সুবিধার জন্য প্রতিযোগিতামূলক বাজারের গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে এই বাজার বিশেষজ্ঞ সুপারিশ করেন যে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র মজুত সম্পর্কিত বর্তমান আইন ও নিয়মগুলো সংশোধন বা আপডেট করা উচিত। যাতে বাজারের সংশ্লিষ্টদের ভুল কারণে শাস্তি না দেওয়া হয় এবং বাজার প্রতিযোগিতামূলকভাবে কাজ করতে পারে।