গুরুগ্রামে বাংলাভাষীদের যাচাই অভিযান, ভয়ে বস্তি ছাড়ার হিড়িক 

অনলাইন ডেস্ক: ভারতের দিল্লির লাগোয়া গুরুগ্রামে চলছে দেশটির পুলিশের বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা চিহ্নিতকরণ অভিযান। এতে বাংলাভাষীদের মনে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। খবর ডয়চে ভেলের।

৩৯ বছর বয়সি ছবি বিবির স্বামী খেতে বসেছিলেন। তাকে সেই অবস্থায় পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ। ছবি বিবি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেছেন, দুই দিন আগে তিনি তার স্বামীকে এক ঝলক দেখেছিলেন। তার স্বামীকে এবং তার মতো অনেককে পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। বলা হচ্ছে, বেআইনি বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করার অভিযান চলছে।

গুরুগ্রামের সেক্টর ৪০-এর কমিউনিটি সেন্টার এখন হোল্ডিং সেন্টারে রূপান্তরিত হয়েছে। সেই কমিউনিটি সেন্টারের সামনে পুলিশ প্রহরা রয়েছে। এক পুলিশ অফিসার বলেছেন, রুটিন চেক চলছে। ভিতরে সব ব্যবস্থা আছে। খাবার, পানি, আশ্রয় সব। চেকিং শেষ হয়ে গেলেই তাদের ছেড়ে দেয়া হবে।

ছবি বিবির দাবি, তার স্বামীর কাছ থেকে একবার ফোন পেয়েছিলেন তিনি। স্বামী জানিয়েছেন, প্রথমে তাকে বাদশাপুর, তারপর সোহনা, সুভাষচক হয়ে কমিউনিটি সেন্টারে নিয়ে আসা হয়েছে। তার কাছে দুইটি আধার কার্ড আছে বলে ধরা হয়েছে।

ছবি বিবি জানিয়েছেন, দুইটি আধার কার্ড থাকার কারণ হলো পুরনো কার্ডে ঠিকানা আপডেট করা হয়েছে। গুরুগ্রামে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নতুন ঠিকানা জুড়তে হয়েছে।

ছবি বিবি কয়েকটি বাড়িতে রান্নার কাজ করেন। তার স্বামী কুকুরকে নিয়ে ঘোরানোসহ নানা ধরনের কাজ করেন। ছবির দাবি, তারা পশ্চিমবঙ্গের মালদহের বাসিন্দা। তাদের দুই মেয়ে আছে। তাদের গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধানের সঙ্গে পুলিশ যোগাযোগ করেছিল। এই নথিপত্র জাল কিনা তা জানতে চেয়েছিল।

বাড়ছে অভিযানের বিস্তার

ছবি বিবির ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। গুরুগ্রামের একের পর এক জায়গায় পরিযায়ী শ্রমিক বস্তিগুলিতে বাংলাভাষীদের মধ্যে আতঙ্কের ছবি। ৫০ নম্বর সেক্টরে ডিপিএস ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের পিছনের বস্তিতে থাকা দক্ষিণ দিনাজপুরের মেহতা আলী বলেছেন, ওই বস্তিতে থাকা ১৫০ জন ফিরে গেছেন। তিনিও ট্রেনের টিকিট কেটেছেন। পুলিশ একবার এসে ঘুরে গেছে। কাউটে আটক করেনি। কিন্তু মানুষ আতঙ্কে গুরুগ্রাম ছাড়ছেন।

২৮ নম্বর সেক্টরের যাদব চৌপাল এলাকার আদম আলীকে রোববার রাতে পুলিশ আটক করে। বুধবার তাকে ছাড়ে। তার কাছে আধার কার্ড থাকা সত্ত্বেও তিন দিন ধরে জেরা করে জানতে চাওয়া হয় তিনি বাংলাদেশি কিনা।

সেক্টর ৪৯-এ বেঙ্গলি মার্কেটের পুরুষ পরিযায়ী শ্রমিকরা মূলত নিকাশীর কাজের সঙ্গে যুক্ত। তাদের স্ত্রীরা কাছের হাউসিং সোসাইটিতে গৃহ পরিচারিকার কাজ করেন। সেখান থেকেও দলে দলে মানুষ পশ্চিমবঙ্গে ফিরছেন। স্থানীয় মানুষের হিসাব, চার হাজার বাংলাভাষী গুরুগ্রাম ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে ফিরে গেছেন।

অভিযোগ, এখান থেকে সাদা পোশাকের পুলিশ এসে প্রচুর মানুষকে আটক করে। গত ২৫ বছর ধরে ড্রাইভারের কাজ করা জুলফিকার আলী বলেছেন, ”আমরা কাজ করার জন্য এসেছিলাম। বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। আমরা চাষবাস জানি না। ফিরে গিয়ে কী করবো জানি না।”

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে নানা ধরনের ভিডিওতে। পুলিশের বিরুদ্ধে অত্যাচারের অভিযোগ উঠেছে। মারধরের অভিযোগ উঠছে।

কোচবিহারের বাইরে না যাওয়া মানুষকে বাংলাদেশি আখ্যা দিয়ে নোটিশ

পুলিশ যা বলছে

গুরুগ্রাম পুলিশের মুখপাত্র জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে নির্দেশ এসেছে, বিদেশিরা বেআইনিভাবে এখানে বসবাস করছে। তাদের ভেরিফিকেশন এক্সারসাইজ বা যাচাই প্রক্রিয়া চালাতে হবে। তাদের নথিপত্র ও পরিচয় স্থানীয় জেলাশাসকদের কার্যালয় থেকে যাচাই করা হচ্ছে। ভারতীয় নাগরিকদের ভয় পাওয়ার বা পালিয়ে য়াওয়ার দরকার নেই, তাদের আতঙ্কিত হওয়ারও কোনো প্রয়োজন নেই।

তার দাবি, কারো উপর সহিংসতা করা হয়নি। হোল্ডিং সেন্টার ও স্টেশনে সিসিটিভি আছে। যাদের আটক করা হয়েছে, তাদের পরিবারের কাছ থেকে কোনো অভিযোগ পাইনি।

তিনি জানিয়েছেন, মোট আটজন বাংলাদেশিকে চিহ্নিত করা হয়েছে।

গুরুগ্রামের ডিসিপি (সদরদপ্তর) অর্পিত জৈন বলেছেন, যথাযথভাবে নিয়ম পালন করা হচ্ছে। সারা ভারত জুড়ে এই কর্মসূচি চলছে। দ্রুত পরিচয় যাচাই করে অনেককেই ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

গুরুগ্রামের বিজেপি বিধায়ক মুকেশ শর্মা বলেছেন, রোহিঙ্গারা আইন ও শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে বিপদের কারণ। তারা ঝুগ্গি গড়ে তোলে। তার সংখ্যা বাড়তে থাকে। তারা নথিপত্র বানায়, তার একটা সিস্টেম আছে।

এর ফলে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা ভারতীয়দের কী করে আটক করা হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, নির্দেশটা এসেছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে। আমাদের এটাকে সমর্থন করতে হবে। চেকিংয়ের কাজটা বিস্তারিতভাবে করতে হবে।

সিরাজুল মণ্ডলের কাহিনী

গত দুই বছর ধরে মুম্বাইয়ের মীরা রোডে থাকেন সিরাজুল মণ্ডল। ডিডাব্লিউকে তিনি ফোনে বলেছেন, মাসখানেক আগে রাত দেড়টা নাগাদ আমাদের মহল্লায় পুলিশ আসে। ওখানে ৫০ জনের মতো বাংলাভাষী থাকতেন। ১২ জনকে আলাদা করে পুলিশ নথি দেখতে চায়।

সিরাজুল বলেছেন, আমি প্যান, আধার, হাবড়ায় আমার জমির দলিল, পুলিশ ভ্যারিফিকেশন রিপোর্ট, স্কুলের সার্টিফিকেট দেখাই। দেখাবার পর পুলিশ বলে, সব নকল। তারা জাতীয় সংগীত গাইতে বলে। আমি জাতীয় সংগীত গেয়ে শোনাবার পর পুলিশকে জিজ্ঞাসা করি, এটা কে লিখেছেন বলুন তো? পুলিশ তার জবাব না দিয়ে প্রশ্ন করে, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর নাম কী। আমি বলি, নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি। আমি তাদের বলি, আপনারা মোদির আগে যারা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তাদের নাম বলুন। পুলিশ বলে না। কিন্তু আমাকে ছেড়ে দেয়।

সিরাজুলের দাবি, দুজনকে পুলিশ ছাড়ে না। হাসান মণ্ডল ও এক নারীকে। হাসান তার পাসপোর্টও দেখিয়েছিল। কিন্তু পুনে হয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় দক্ষিণ দিনাজপুরের হিলিতে। সেখান দিয়ে পুশব্যাক করা হয়। বাড়ির লোক তাদের ফেরত নিয়ে আসে। অবৈধভাবে আনা হয়েছে। আমি এটা সমর্থন করি না। বৈধভাবে করলে পুলিশকে সাজা দেয়া যেতো৷

সিরাজুল আবার কাজ করতে মুম্বাই যাচ্ছেন। পেটের দায়ে। তিনি বলেছেন, পুলিশ আমায় বলেছিল, মুম্বাই মে রহনে কা টাইম ওভার। তোমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছ। ওখান থেকে শেখ হাসিনাকে ভাগিয়ে দিয়েছ। আমার প্রশ্ন, পুলিশ কোন অধিকারে এসব কথা বলবে?

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যা বললেন

সোমবার বীরভূমে বাংলাভাষীাদের বিরুদ্ধে অত্যাচারের প্রতিবাদে মিছিল করে তৃণমূল কংগ্রেস। তারপর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেখানে বলেন, আমরা দেশে ঐক্য চাই। আমি কোনোদিন হিন্দিভাষীদের বলিনি, বাংলা ছেড়ে চলে যাও। কিন্তু বাংলা ভাষা বলার জন্য দিল্লিতে, রাজস্থানে, উত্তর প্রদেশে, মধ্যপ্রদেশে, আসামে অত্যাচার হলে কি আপনাদের ভালো লাগে? আপনারাও সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকে এই অত্যাচার বন্ধের আওয়াজ তুলুন। আমরা যদি সকলকে আশ্রয় দিতে পারি, তোমরা কেন পারো না? দরকার হলে জীবন দেবো। আমাদের ভাষা কেড়ে নিতে দেবো না।

মমতা আরও বলেন, দিল্লিতে বাংলাভাষীদের বলা হয়েছে, একমাসের মধ্যে দিল্লি ছাড়ো। পুলিশ বাচ্চাদের মারছে। এক থানা থেকে অন্য থানায় নিয়ে যাচ্ছে. কবে মিসিং করে দেবে কে জানে।

মমতা বলেছেন, আমরা কুড়মালি, হিন্দি, রাজস্থানী কামতাপুরী, রাজবংশী ভাষাকে স্বীকৃতি দিয়েছি। এশিয়াতে বাংলাভাষীরা দুই নম্বরে। বাংলায় কথা বলছে বলে, ওরা যাকে-তাকে রোহিঙ্গা বলছে, বাংলাদেশি বলে পুশ ব্যাক করে দিচ্ছে। কেন গরিবদের উপর অত্যাচার হবে? আলিপুরদুয়ারে শীল পরিবারকে চিঠি পাঠানো হয়েছে, মতুয়াদের উপর অত্যাচার করা হচ্ছে। সংখ্যালঘুদের অত্যাচার করেছে। লজ্জা হয় না ওদের।

কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?

ভাষাবিদ, লেখক, শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার ডিডাব্লিউকে বলছেন, এটা বাংলাভাষার উপর আক্রমণ নয়। এর সঙ্গে অর্থনৈাতিক কারণ আছে। তা হলো, অন্য রাজ্য থেকে মানুষ এসে কাজ কেড়ে নিচ্ছে। তারা কাজ পাবে না। এছাড়া সাম্প্রদায়িক কারণ আছে। বাংলাভাষা দিয়ে মুসলিমদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। এটা হলো সামগ্রিকভাবে হিন্দুত্ব তৈরির কাজ।

পবিত্র সরকার মনে করেন, এটাকে শুধুমাত্র বাঙালি-বিদ্বেষ বলা যায় না। ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, অধ্যাপক বাংলায় কথা বললে আক্রমণ হচ্ছে না। একটা শ্রেণির মানুষরা বাংলা বলতে ভয় পাবেন। এই সমস্যাটা অর্থনৈতিক, সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সমস্যা নয়।

মানবাদিকার কর্মী ও মাসুম-এর প্রতিষ্ঠাকা কিরীটি রায় ডাব্লিউকে বলেছেন, দেশে যদি বিদেশি নাগরিকরা থাকেন, তাহলে তারা বেআইনিভাবে থাকলেও ফেরত পাঠানোর পদ্ধতি আছে। এটা পুরোপুরি বিচারবিভাগের বিষয়। পুলিশের মাধ্যমে তাদের ফেরত পাঠানো হয়।

তিনি জানিয়েছেন, পহেলগামের পর বিজেপি-শাসিত রাজ্যে বাংলাভাষী মুসলিমদের ডাইনি খোঁজার মতো করে খোঁজা হচ্ছে। এদের মধ্যে কেউ রোহিঙ্গা বা কেউ বাংলাদেশি থাকতে পারেন, কিন্তু আমাদের দেশের পরিযায়ী শ্রমিকদের জোর করে অনেক ক্ষেত্রে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিচার ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে তা করা হচ্ছে। পুলিশই অভিযোগ করছে, তারাই বিচার করছে, শাস্তি দিচ্ছে। বিএসএফের সাহায্য নিয়ে পুশ ব্যাক হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে মিলিটারি প্লেন ব্যবহার করে এই কাজ করা হচ্ছে। এটা একটা অদ্ভূত পরিস্থিতি। এই কাজ অসাংবিধানিক।

Related Articles

Back to top button