শিশুকে প্রাপ্তবয়স্ক দেখিয়ে ভুল আদালতে বিচার চলেছে ১০ বছর!

অনলাইন ডেস্ক: মামলা প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে। সেই মামলায় প্রাপ্তবয়স্ক দেখিয়ে দেওয়া হয় চার্জশিট। গ্রেফতারের সময় জন্মনিবন্ধন সনদ, এসএসসির সার্টিফিকেট দেওয়া হলেও তা আমলে নেয়নি পুলিশ। সেই মামলায় অভিযোগ গঠনের পর শুরু হয় বিচার। এরই মাঝে আড়াই বছর জেলও খেটে ফেলেন আসামি।
বিচারের মাঝপথে এসে আবারও দাখিল করা হয় এসএসসির সার্টিফিকেট, জন্মনিবন্ধন সনদ ও পাসপোর্টের কপি। বিচারিক আদালত তা আমলে না নিয়ে বিচার চালিয়ে যান। সেই আদেশের বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে দাখিল করা হয় রিভিশন আবেদন। নথিপত্র পর্যালোচনা করে আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয় প্রাপ্তবয়স্ক আসামিদের সঙ্গে যার বিচার করা হচ্ছে তিনি শিশু। আদেশ দেওয়া হয় মামলাটি বিচারের জন্য যাবে শিশু আদালতে। কিন্তু এরই মধ্যে কেটে গেছে দশটি বছর। এই দীর্ঘ সময়ে শিশুটিকে গ্রেফতারের পর নেওয়া হয় রিমান্ডে। করা হয় নির্যাতন। হারান মানসিক ভারসাম্য। ইতিমধ্যে চিকিত্সা করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন।
কিন্তু শিশুটির জীবনে যা ঘটে গেছে তার দায় নেবে কে—এমন প্রশ্ন আইনজীবী ব্যারিস্টার সোলায়মান তুষারের। শিশুটির আইনজীবী শুক্রবার ইত্তেফাককে বলেন, ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক। গ্রেফতারের পর শিশুটিকে কয়েক দফা রিমান্ডে নিয়ে জোর করে আদায় করা হয় জবানবন্দি। তিনি বলেন, শুরুতে যেসব কাগজপত্র দাখিল করা হয়েছিল সেগুলো পুলিশ আমলে নিলে শিশুটিকে এমন ভোগান্তিতে পড়তে হতো না। কারণ তখন শিশুটির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া চলত শিশু আইনে। ব্যারিস্টার তুষার বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হয়তো কৌশলে তাকে প্রাপ্তবয়স্ক দেখিয়ে এজাহারে নাম লিপিবদ্ধ করে। তবে বিচারের শেষ পর্যায়ে এসে আমরা আদালতকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি যে, এই আদালতে যার বিচার হচ্ছে সে শিশু। অতএব আইনানুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচার করার সুযোগ নেই।
প্রসঙ্গত, এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে ২০১৫ সালের ১৫ জুলাই এক শিশুকে গ্রেফতার করে পুলিশ। শিশুটিও ছিল এইচএসসি পরীক্ষার্থী। পরদিন তাকে এক নম্বর আসামি করে ডেমরা থানায় মামলা করা হয়।
গ্রেফতারের সময় শিশুটির অভিভাবকরা তার জন্মনিবন্ধন ও শিক্ষাসনদসহ সব কাগজপত্র দেয়। সেগুলো পুলিশ নিলেও তাকে প্রাপ্তবয়স্ক দেখিয়ে এজাহারে আসামি করে। বয়স উল্লেখ করা হয় ১৯ বছর। আদালতে হাজির করে নেওয়া হয় দুই দফা রিমান্ডে। করা হয় নির্যাতনও। এক বছর পর অন্য আসামিদের সঙ্গে প্রাপ্তবয়স্ক দেখিয়ে তদন্ত রিপোর্ট দেয় পুলিশ।
পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনে অভিযোগ গঠনের পর বিচার চলে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। সাক্ষ্যগ্রহণের মাঝপথে শিশুটির আইনজীবী পরিবর্তন হয়। তার পক্ষে আবারও এসএসসি, জন্মসনদ ও পাসপোর্টের কপি দাখিল করেন আইনজীবী সোলায়মান তুষার। তিনি আদালতকে জানান, এসব কাগজপত্র প্রমাণ করে অপরাধ সংঘটনের সময় শিশুটির বয়স ছিল ১৮ বছরের নিচে। পুলিশ অসত্ উদ্দেশ্যে তাকে প্রাপ্তবয়স্ক দেখিয়ে চার্জশিট দিয়েছে। সেজন্য শিশুর বয়স নির্ধারণ ও বিচারের জন্য সংশ্লিষ্ট শিশু আদালতে প্রেরণের জন্য ঢাকার মহানগর হাকিম আদালতে ২০২৩ সালের ৯ নভেম্বর আবেদন করা হয়। আবেদনটি সংশ্লিষ্ট শিশু আদালতে না পাঠিয়ে নথিজাত করার আদেশ দেয় জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। এই আদেশের বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে রিভিশন মামলা করা হয়। মহানগর দায়রা জজ আদালত রিভিশনটি গ্রহণ করে শুনানির জন্য ঢাকার ১০ম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠায়। গত ৪ আগস্ট শুনানি শেষে আবেদনটি মঞ্জুর করে শিশুর বিষয়টি বিচারের জন্য পাঠানো হয় শিশু আদালতে।
ব্যারিস্টার সোলায়মান তুষার বলেন, এখন নতুন করে শিশু আদালতে ঐ শিশুর বিচার শুরু হবে। তবে ইতিমধ্যে অতিবাহিত হয়েছে ১০ বছর ২০ দিন। যদি পুলিশ সঠিক আইনে রিপোর্ট দিতো তাহলে এই ভোগান্তি পোহাতে হতো না শিশুটিকে।
শিশু আইনে বলা হয়েছে, ফৌজদারি কার্যবিধি বা আপাতত বলবত্ অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, কোনো অপরাধ সংঘটনে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ও শিশু জড়িত থাকলে, পুলিশ রিপোর্ট (জি.আর মামলার ক্ষেত্রে) ক্ষেত্রমতো, অনুসন্ধান প্রতিবেদন (সি.আর মামলার ক্ষেত্রে) বা তদন্ত প্রতিবেদন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ও শিশুর জন্য পৃথকভাবে প্রস্তুত করে দাখিল করতে হবে। এছাড়া একত্রে সংঘটতি কোনো অপরাধ আমলে গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের অপরাধ পৃথকভাবে আমলে গ্রহণ করতে হবে।
আইনে আরো বলা হয়েছে, আপাতত বলবত্ অন্য কোনো আইন, আদালতের রায় বা আদেশে ভিন্নরূপ যা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের উদ্দেশ্যপূরণকল্পে, অপরাধ সংঘটনের তারিখই হবে শিশুর বয়স নির্ধারণের জন্য প্রাসঙ্গিক তারিখ। আইনজ্ঞরা বলছেন, শিশু আইনের সঠিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের একাধিক রায় রয়েছে। এসব রায়ে শিশুর জামিন বিবেচনা না করে কারাগারে পাঠানো, রিমান্ড ও দণ্ড দেওয়ার ক্ষেত্রে বিচারকদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। যাতে কোনোভাবেই শিশু আইনের লঙ্ঘন না হয়।