জুলাই যোদ্ধা নারীরা নতুন যুদ্ধের মুখোমুখি

অনলাইন ডেস্ক: বাংলাদেশে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নারীরা গৌরবময় ভূমিকা রেখেছেন। তারা রাজপথে লড়াই করেছেন। মিছিলের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, জীবন দিয়েছেন। কিন্তু সেই নারীরা যে বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন তা এখন হতাশায় পরিণত হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই শহিদ হিসাবে যে ৮৪৪ জনের নাম গেজেটভুক্ত করেছে তাদের মধ্যে ১০ জন নারী। আর ওই ১০ জনের মধ্যে চারজনের বয়স ১৮ বছরের নিচে। জুলাই অভ্যুত্থানে যেসব নারী সামনে থেকে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা এখন নতুন যুদ্ধের মুখোমুখি হচ্ছেন। তাদের ঘরে আটকে রাখতে একটি উগ্রবাদী গোষ্ঠী দিন দিন শক্তিশালী হয়ে উঠছে বলে অভিযোগ তাদের। নারীর প্রতি সহিংসতা, অবমাননা বেড়েই চলেছে। ধর্ষণের বিচার চাইতে গিয়ে নারীই উল্টো আসামি হচ্ছেন। নারীর অবমাননাকারীদের ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা হচ্ছে।
জুলাই যোদ্ধা নারীরা এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। তাদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলা হচ্ছে। জুলাই নারী যোদ্ধাদের অভিযোগ, ক্ষমতায় টিকে থাকতে তাদের সহযোদ্ধারা এখন অশুভ শক্তি, উগ্রবাদীদের সঙ্গে আপোস করছে।
সরকারে জুলাই আন্দোলনের তিন তরুণ জায়গা পেলেও আন্দোলনে অংশ নেয়া তরুণিদের কোনো জায়গা হয়নি। ১১টি সংস্কার কমিশনের মধ্যে একটিতেই নারীরা আছেন। আরো দুই একটি কমিশনে এক-দুইজন নারী থাকলে নেতৃত্ব পুরুষদের দখলে। আর জাতীয় ঐকমত্য কশিমনে একজন মাত্র নারী সদস্য।
জুলাই আন্দোলনের নারীদের কথা
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সামনের সারিতে ছিলেন ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী তিলোত্তমা ইতি। তিনি গত বছরের স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘১৬ জুলাই ইডেন কলেজ থেকে সবচেয়ে বড় মিছিলটি বের করেছিলাম আমরা। তারপর পুলিশের হামলা, ছাত্রলীগের হামলা কোনো কিছুই পরোয়া করিনি। আমাদের এই আন্দোলনের ফলে স্বৈরাচারের পতন হয়। আর এখন সেই আমিই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হয়রানির শিকার হচ্ছি।’
তিনি জানান, জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে খালাসের প্রতিবাদে আমি একটি পোস্ট দিয়েছিলাম ফেসবুকে। তারপর থেকেই একটি গোষ্ঠী আমাকে হেয় করছে। আমি কোনো পোস্ট দিলেই দল বেঁধে অনেক খারাপ মন্তব্য করছে। তারা চায় আমি যাতে আমার মতামত প্রকাশ না করি। তারা আমার চরিত্র হননে নেমেছে। এই পরিস্থিতির শিকার আরো অনেকে। আমরা যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলাম সেটা তো দূর হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখছি না। উল্টো নারীরা আরো বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। একটি গোষ্ঠী তাদের মতো করে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে।
তিনি বলেন, গত মার্চে শাহবাগে আমরা যারা ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন করেছি। তারা সবাই তার আগে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনেও ছিলাম। কিন্তু ওই (ধর্ষণবিরোধী) আন্দোলনের কারণে আমাদের অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়। একজন নারীকে তো ব্যাপক ট্রোল করে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করা হয়। তার পরিবারকে নানাভাবে চাপে ফেলা হয়।
এই ঘটনার প্রত্যক্ষ শিকার আদ্রিতা রায়। তিনি জুলাই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। তিনি তখন উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী। এখন তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। আদ্রিতা বলেন, মার্চে ধর্ষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের হামলার শিকার হই। মামলা হয় আমাদের বিরুদ্ধে। আমি তিন নাম্বার আসমি। শুধু তাই নয় আমার ছবি দিয়ে, আমার পরিবারের সদস্যদের ছবি দিয়ে নানা অপপ্রচার করা হয়, বডি শেমিং করা হয়। ছবি বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়। তখন আমি বাইরে বের হতে পারতাম না। মাস্ক পরে বের হতে হতো। বাইরে কোথাও যেতে হলে মা সাথে যেতেন। আমি আর আমার পরিবার নিরপত্তাহীনতার মধ্যে পড়ে যাই। জুলাই আন্দোলনের পর ওটা ছিলো আমার জন্য সবচেয়ে খারাপ সময়।
তিনি আরও বলেন, আসলে আমরা একটা বৈষম্যহীন সমাজের জন্য মাঠে নেমেছিলাম। কিন্তু সেটা এখন ফিকে হয়ে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকার তেমন কিছুই করছে না। হেফাজত সমাবেশ ডেকে নারী কমিশনের সদস্যদের অশ্লীল ভাষায় গালি দিল, নারীদের অপমান করল, কিন্তু সরকার কোনো ব্যবস্থা নিলোনা তাদের বিরুদ্ধে। আর যাদের সাথে একসঙ্গে আন্দোলন করেছি তারা নতুন দল গঠন করল এনসিপি। সেই দলের নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ হেফাজতের ওই সমাবেশে গিয়ে বক্তৃতা দিলেন। ফলে তাদের ওপরও আশা করার কিছু নাই।
ফুলের মালা কার গলায়?
২৮শে মে বিকেলে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব এলাকায় নারীকে লাথি মারা আকাশ চৌধুরী আটক হলেও জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর তাকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা হয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে খালাস ও মুক্তির প্রতিবাদ কর্মসূচিতে আন্দোলনকারী এক নারীকে লাথি মারে সে। সে ছাত্রশিবিরের চট্টগ্রাম মহানগরের ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা। সমালোচনার পর অবশ্য তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
গত মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক নারীকে তার পোশাক নিয়ে হেনস্তা করার পর ভুক্তভোগী নারী শাহবাগ থানায় মামলা দায়ের করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী মোস্তফা আসিফ অর্ণবকে ওই মামলায় আটকের পর পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করলেও তৌহিদী জনতা থানা ঘেরাও করে। থানা থেকে আদালতে পাঠানোর পর তিনি জামিন পান। তার মুক্তির পর পাগড়ি, ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা হয়, ওই নারী মামলা প্রত্যাহারেও বাধ্য হন। এরপর ধর্ষণের শিকার নারীকে মারধর ও বিবস্ত্র করে ভিডিও করা এবং তা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে কুমিল্লায় ২৬ জুন।
গত মে মাসে ঢাকার লালমাটিয়ায় একটি চায়ের দোকানে দুই তরুণী ধূমপান করায় কথাকাটির পর তাদের মবের মুখে পড়তে হয়। পরে পুলিশ ওই দুই তরুণিকে থানার হেফাজতে নিয়ে যায়। তারপর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘পাবলিক প্লেসে ধূমপান নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য অপরাধ। কেউ যেন ওপেন প্লেসে ধূমপান না করেন।’
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের তালিকায় নেই নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের কোনো প্রস্তাব
নারী বিষয়ক সংস্কার কশিন প্রতিবেদন দেওয়ার পর ওই কমিশনই বাতিলের দাবি জানিয়েছে হেফাজতে ইসলামসহ কিছু ইসলামী দল। কমিশন প্রধান শিরীন হক রীতিমতো হুমকির মুখে পড়েন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তাদের তালিকায় নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের কোনো প্রস্তাব আলোচনার জন্য রাখেনি।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন এই ছয় মাসে ৪৪১ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, গড়ে প্রতিদিন দুইজনেরও বেশি। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২২ জনকে। ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ৫ জন নারী। ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছেন ১৬২ জন। ধর্ষণের ঘটনায় ৩৫৮টি মামলা হলেও ৭৮টি ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। ওই একই সময়ে ছয় মাসে যৌন হয়ারানির শিকার হয়েছেন ১৬৪ জন নারী।
নারীদের ঢাল বানানো হয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলের শিক্ষার্থী অর্ণি আনজুম বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে হলের শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করাদের একজন। ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ যে হামলা করে তিনি সেখানে হামলার শিকার হন। তার মধ্যেও এখন হতাশা কাজ করছে।
তিনি বলেন, ‘জুলাই আন্দোলণের সময় আমরা নারীরাই সামনে ছিলাম। আসলে নারীদের আন্দোলনের সময় সামনে দেয়া হয়। আসলে আমাদের ঢাল হিসাবে সামনে দেয়া হয়েছে। অনেক নারী আন্দোলনে ছিলেন একটি বৈষম্যহীন সমাজের আকাঙ্ক্ষায় আর নারীরা যখন নেমে আসে তখন স্বৈরাচার টিকতে পারে না। কিন্তু দেখা গেলো স্বৈরাচারের পতনের পরও নারীদের বিভিন্ন জায়গায় টোকেন হিসাবে রাখা হয়েছে। সবখানেই ব্যাটাগিরি দেখানো হয়েছে। তরুণদের যে দল হলো সেখানেও নারীদের টোকেন হিসাবে রাখা হয়েছে। আসলে কিছুই বদলায়নি। নারীরা এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তাদের ঘরের মধ্যে ঢোকানোর জন্য অপশক্তি আরো সক্রিয় হচ্ছে। নারীর এখন পোশাকে দোষ, চলনে দোষ, বলনে দোষ। শাহবাগে যখন আমরা নারীর নিরাপত্তা চাইলাম তখন আর্মি, পুলিশ নিরাপত্তা দিলো না। যৌক্তিক আন্দোলনে তারা সাড়া দেয় না। কিন্তু গোপালগঞ্জে গিয়ে ইন্টেরিমের পুলিশ, আর্মি ঠিকই গুলি করলো।’
নারীর অবস্থান কী?
জুলাই গণ অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া নারী ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী নাফিজা জান্নাত বলেন, আমরা এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছি। বিপুলভাবে নারীরা জুলাই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। আমরা পরিবর্তন চাইছি। কিন্তু রাষ্ট্রের চরিত্র বদলায়নি। একই আছে। ফলে বৈষম্য আগের জায়গায়ই আছে।
জুলাই আন্দোনে অংশ নেওয়া নারীদের কেউ কেউ নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিতে যোগ দিয়েছেন। তাদের একজন এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন মনে করেন, নারীরা এখানো নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছেন। নানা ধরনের ট্রোলের শিকার হচ্ছেন। আমাদের দলের নারীরাও নানা ধরনের ট্রোলের শিকার হচ্ছেন। আমাদের একজনের ছবি বিকৃত করে তো নানা ভাবে অপপ্রচার হচ্ছে। এখানে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন দরকার। এনসিপি সেটা চেষ্টা করছে। আমরা চাই নারীদের জন্য সংসদের আসনগুলোতে সরাসরি নির্বাচন হোক।
একই দলের আরেকজন যুগ্ম আহ্বায়ক তাজনুভা জাবীন বলেন, নারীকে দমিয়ে রাখতেই তাকে নিয়ে ট্রোল করা হয়। নানা ধরনের অপবাদ দেয়া হয়, অপপ্রচার করা হয়। এটা করা হলে তার পরিবার তাকে আটকে দেয়। জুলাই আন্দোলনের অনেক নারী তাই হেনস্তার শিকার।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, জুলাই আন্দোলনে যেভাবে মেয়েরা অংশ নিয়েছে সেভাবে তারা মর্যাদা পায়নি। এতগুলো সংস্কার কমিশন হলো তার মাত্র একটির চেয়ারম্যান নারী। আবার তারা (আন্দোলকারী তরুণরা) যে দল গঠন করেছে সেখানেও নারীরা হয়রানির শিকার হচ্ছে, প্রতিকার পাচ্ছে না। নারী বিদ্বেষী মনোভাব সব সময়ই ছিল, কিন্তু এখন সেটা আরো উগ্রভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। আর তারা যে দল গঠন করেছে সেই দলের মেয়েরাও এখন বলছে নারীর প্রতি বৈষম্যের কথা, নারীর প্রতি নানা আনাকাঙ্খিত আচরণের কথা।
মানবাধিকার কর্মী নূর খানের পর্যবেক্ষণ হলো জুলাই আন্দোনে নারীদের অংশগ্রহণ ছিলো বহুমাত্রিক। সবখান থেকে নারীরা এক যোগে হাতে হাত মিলিয়ে রাস্তায় নেমেছিলো। কিন্তু সেই অবস্থান এখন আর দেখছেন না তিনি। নারীদের অংশগ্রহণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আগের মতই কম বলে জানান তিনি। উল্টো এখন নারীবিরোধী একটি অপশক্তির আস্ফালন দেখছেন নূর খান।