সাপের কামড়ে মৃত্যু, স্বাস্থ্য খাতে এক নীরব সংকট

  • প্রতি বছর সাপের কামড়ের শিকার ৯৬ হাজার মানুষ 
  • বছরে সাড়ে ৭ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায় 
  • বাংলাদেশে ৯০ প্রজাতির সাপ রয়েছে 
  • দিনে মারা যায় ২০ জন

অনলাইন ডেস্ক: জনসংখ্যার আধিক্যের কারণে প্রকৃতিতে কমে আসছে বনাঞ্চল, কৃষিজমি। ফলে সাপের আশ্রয়স্থলগুলো ধ্বংস হচ্ছে দিনকে দিন। মানুষ ও সাপের মধ্যে বাড়ছে সংঘাত। সেই সংঘাতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মারা পড়ছে সাপ; কিছু ক্ষেত্রে সাপের ছোবলের শিকার হচ্ছে মানুষ। ধীরে ধীরে বিষধর সাপের সংখ্যা কমে এলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনো ছয় প্রজাতির বিষধর সাপের বসবাস আমাদের চারপাশে। সেসব বিষধর সাপের কামড়ের শিকার হন দেশের প্রায় সাড়ে ৯৬ হাজার মানুষ। যার মধ্যে মৃত্যু হয় বছরে সাড়ে ৭ হাজারের বেশি মানুষের। আর এক দিনে সাপের কামড়ে মারা যায় গড়ে ২০ জন।

বিশ্বে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ প্রজাতির সাপ রয়েছে। আর বাংলাদেশে আছে ৯০ প্রজাতির সাপ। এসবের মধ্যে ৫ শতাংশ বিষধর। এগুলোর মধ্যে অন্যতম রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া, কিং কোবরা বা শঙ্খচূড়, নায়া নায়া (কোবরা বা গোখরা প্রজাতির সাপ), কেউটে, ক্রেইট বা শঙ্খিনী ও নায়া কাউচিয়া। এর মধ্যে রাসেলস ভাইপার সবচেয়ে বিষাক্ত। এ সাপটি ১০০ বছর আগে বাংলাদেশ থেকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। গত ১০-১২ বছর আগে থেকে আবার এ সাপের দেখা মিলছে। বর্তমানে ২৭টি জেলায় এর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব, দেরিতে হাসপাতালে যাওয়া, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সরকারি হাসপাতালগুলোতে অ্যান্টিভেনম না থাকা এবং অ্যান্টিভেনম থাকলেও তা ব্যবহারে চিকিৎসকদের অনীহা, সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের অভাব—এসব কারণে সাপে কাটা রোগীর মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২৪ সালে হাসপাতালে সাপের ছোবল খেয়ে চিকিৎসা নিতে আসা ২৪ হাজার ৪৩২ জনের মধ্যে ১১৮ জন মারা গেছেন। পরিসংখ্যান আরও বলছে, সাপের ছোবলের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে বরিশালে, তবে মৃত্যুর হার বেশি পদ্মাপাড়ের বৃহত্তর ফরিদপুর ও রাজশাহীতে, যেখানে বিষধর সাপ বেশি দেখা যায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত বছর সাপের কামড়ে মারা যাওয়া রোগীদের অধিকাংশকেই প্রথমে ওঝা বা বৈদ্যর কাছে নেওয়া হয়েছিল। দ্রুত সময়ের মধ্যে আধুনিক চিকিৎসা নিলে এদের মধ্যে ৯০ শতাংশ রোগীকেই বাঁচানো যেত।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২০২১ সালের পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর ৪ লাখেরও বেশি মানুষ সাপের ছোবলের শিকার হন, যার মধ্যে প্রায় ৯৬ হাজার ৫০০টি বিষধর সাপের ছোবল। এই বিষধর সাপের ছোবলে বছরে সাড়ে ৭ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাপের ছোবলে এই ভয়াবহ মৃত্যুর হার দেশের স্বাস্থ্য খাতে এক নীরব সংকট তৈরি করেছে। তারা বলছেন, সাপের ছোবলে আক্রান্তদের ২০ থেকে ২২ শতাংশের মৃত্যুর প্রধান কারণ হলো সমন্বিত চিকিৎসার অভাব এবং সময়ক্ষেপণ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তি দ্রুত সময়ের মধ্যে হাসপাতালে না গিয়ে ওঝা বা বৈদ্যের শরণাপন্ন হন।

সাপ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন পরিবেশকর্মী আবদুস সবুর কাজল। তিনি ইত্তেফাককে বলেন, ফরিদপুরের রেড জোন হচ্ছে চরভদ্রাসন উপজেলা। এখানে ২০১৫ সাল থেকে রাসেলস ভাইপার দেখা যায়। এর দংশনে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়। তবে ২০১৮ সালের পর থেকে এই উপজেলায় অ্যান্টিভেনম পাওয়া যায়। কালাস, গোখরা এবং রাসেলস ভাইপারের কামড়ে অ্যান্টিভেনম নিতেই হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজ জানান, সাপের ছোবলের ঘটনা বেশি ঘটে বর্ষাকালে, অর্থাত্—জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে। আর সাপের প্রজনন মৌসুম ‘অক্টোবর’ মাসে। দেশে এই দুই সময়ে সাপের ছোবলের ঘটনা বেড়ে যায়। তিনি বলেন, আমাদের দেশে ব্যবহৃত অ্যান্টিভেনমগুলো শত বছরের পুরোনো প্রযুক্তিতে তৈরি এবং দক্ষিণ ভারতের চার ধরনের সাপ থেকে সংগৃহীত বিষে তৈরি হওয়ায় সব ধরনের সাপের বিষের বিরুদ্ধে এটি কার্যকর নয়। অ্যান্টিভেনম প্রয়োগের পরও ২০ থেকে ২২ শতাংশ রোগীর মৃত্যু হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার (এনসিডিসি) লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. সৈয়দ জাকির হোসেন বলেন, দেশে অ্যান্টিভেনমের কোনো সংকট নেই। বছরে ৭০ হাজার ডোজ অ্যান্টিভেনমের প্রয়োজন হলেও, বাস্তবে ২৫ হাজারের বেশি ব্যবহৃত হয় না, কারণ মানুষ চিকিৎসকের কাছে আসে না। তিনি জানান, সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকার ১০ হাজার ভায়াল অ্যান্টিভেনম কিনেছে, আর ১০ হাজার ভায়াল দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সর্বশেষ গত দুই মাসে আড়াই হাজার ভায়াল সরবরাহ করা হয়েছে সরকারি হাসপাতালে। বর্তমানে মজুত রয়েছে ৬৫০ ভায়াল।

চিকিৎসকরা জানান, বিষধর সাপের ছোবলের লক্ষণ হলো— দংশিত স্থান ফুলে যাওয়া, রক্তপাত, রোগী তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে যাওয়া, প্রস্রাব কমে যাওয়া বা কালো হওয়া। তারা বলেন, সাপে কাটা ব্যক্তিকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে এবং কোনো রকম ঝাড়ফুঁক বা কুসংস্কারের পেছনে সময় নষ্ট করা যাবে না।

Related Articles

Back to top button