এবার বিশ্বকাপে যাওয়ার সুযোগ ভারতীয় নারী ফুটবল দলের

অনলাইন ডেস্ক: ভারতের পুরুষ ফুটবল দলের ফর্ম যখন তলানিতে, তখন নতুন করে স্বপ্ন দেখাচ্ছে নারী ফুটবল দল। এশিয়ান কাপ বাছাই পর্বে ভারতের মেয়েদের যাত্রা শুরু হয়েছিল মঙ্গোলিয়াকে ১৩-০ গোলে হারিয়ে। গ্রুপের সব ম্যাচ জিতে মূল পর্বে যাওয়া নিশ্চিত করতে বেগ পেতে হয়নি ভারতীয় নারী ফুটবলারদের।
ভারতের পুরুষ ফুটবল দলের ফর্ম যখন তলানিতে, তখন বিশ্বের ফুটবল মানচিত্রে নতুন করে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন পেয়ারি ঝাঝা, সঙ্গীতা বাসফোরে, প্রিয়দর্শিনী সেল্লাদুরাইরা। জীবনের অদৃশ্য কাচের ছাদ ভেঙেএখন বিশ্বকাপেও কোয়ালিফাই করার স্বপ্ন দেখছেন ক্রিস্পিন ছেত্রীর বাঘিনীরা।
সঙ্গীতার জোড়া গোলে থাইল্যান্ডের মতো শক্তিশালী দলকে হারিয়ে প্রতিযোগিতার মূল পর্বে উঠেছে ভারত। কল্যাণীর তারকা ফুটবলার স্বভাবতই খুশি। ডিডাব্লিউকে তিনি বলেন, আনন্দ হচ্ছে। মানুষ আমাদের নিয়ে কথা বলছেন। আমাদের চিনতে পারছেন, এটা একটা দারুণ ব্যাপার। কাগজে ছবিও বেরোচ্ছে। তবে দায়িত্ব বেড়েছে অনেক। আমরা সবটুকু দিয়ে জিততে চেষ্টা করব।
একই বক্তব্য ডিফেন্ডার হেমাম সিল্কি দেবীর। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেছেন, সামনে এখন একটা বিরাট সুযোগ অপেক্ষা করছে। এই মাসের গোড়ায় বাছাই পর্বের খেলা শেষ করে ফুটবলাররা এখন ছুটিতে। খুব তাড়াতাড়ি শুরু হবে ইন্ডিয়ান উইমেনস লিগ। সঙ্গে থাকবে ক্লাবের অন্যান্য খেলা। জাতীয় দলের ক্যাম্প শুরু হতে আরো একটু দেরি। তার মধ্যেই চলছে হালকা প্রশিক্ষণ, চোট সারিয়ে নেয়ার কাজ।
সিল্কি বলেন, কোচ (ক্রিস্পিন ছেত্রি) বলেছেন এখন ফিজিও এবং স্ট্রেন্থ আর কন্ডিশনিং কোচের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে। শারীরিক ফিটনেসের সঙ্গে সঙ্গে আমরা মানসিক ফিটনেসের দিকেও খেয়াল রাখছি। দলীয় ঐক্যের দিকে মন দিচ্ছি।
তবে সামনের এশিয়ান কাপের আগে চলবে দীর্ঘ প্রস্তুতি পর্ব। অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশন বা এআইএফএফ জানিয়েছে, তারা প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। প্রতিযোগিতা এবং ম্যাচের মধ্যে থাকার জন্য ইন্ডিয়ান উইমেনস লিগকে এগিয়ে আনা হয়েছে।
এআইএফএফ-এর সহকারী সাধারণ সম্পাদক এম সত্যনারায়ণ ডিডাব্লিউকে বলেন, জানুয়ারি এবং ফেরুয়ারিতে আমরা ৫০ দিনের ট্রেনিং করার সময় পাব। এশিয়ান কাপের গ্রুপ নির্ধারণ হবে এই মাসের শেষে। ওই ৫০ দিনে কীভাবে প্রশিক্ষণ চলবে তা ঠিক হবে ড্র-এর পরে। এই দলে অনেক অল্পবয়সী ফুটবলার আছেন। তাদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে খেয়ালও রাখছি আমরা। যেহেতু বয়স কম, এদের জন্য মেন্টর রাখা যায় কিনা ভাবা হচ্ছে। যদি সব ঠিকঠাক থাকে, আমাদের সামনে বিশ্বকাপে খেলার দরজাও খুলে যেতে পারে।
বিশ্বকাপে বাছাই হওয়ার হাতছানি
২০২৬-এ অস্ট্রেলিয়াতে অনুষ্ঠিত হবে নারীদের ফুটবল এশিয়ান কাপ। তিনটি গ্রুপে বিভক্ত ১২টি দেশ মূলপর্বে খেলবে। কোয়ার্টার ফাইনালের চারটি জয়ী দল সরাসরি ২০২৭-এর ব্রাজিল বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাবে। এখানেই শেষ নয়। কোয়ার্টার ফাইনালের হেরে যাওয়া দেশগুলির মধ্যে দুটি দল প্লে-অফের মাধ্যমে বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাবে। প্লে-অফে হেরে যাওয়া দুটি দল ইন্টার-কনফেডারেশন প্লে-অফ-এ জিতে বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাবে। নারী ফুটবলের সঙ্গে যুক্ত অনেকের মতে, পেয়ারি, সঙ্গীতারা কেবলমাত্র এশিয়ান কাপে ভালো ফল করার স্বপ্নই দেখাচ্ছেন না। বিশ্বকাপের মূলপর্বে খেলার স্বপ্নও দেখাচ্ছেন।
ম্যাচ কমিশানার সুদেষ্ণা মুখোপাধ্যায় ডিডাব্লিউকে বলেন, অনেক বাধা কাটিয়ে নারী ফুটবল দল পারফর্ম করে। সমাজ, পরিজন সবাই বাঁকা চোখে তাকায়। তাই তাদের সামান্য সাফল্যও আমাদের আপ্লুত করে। তবে এবারের পারফর্মেন্স দেখে আমি, এবং আমার মতো অনেকেই এই দলটিকে বিশ্বকাপে খেলতে দেখার স্বপ্নই দেখছে। এবার এশিয়ান কাপ টুর্নামেন্ট ঠেকে অনেক বেশি দল বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলবে। ফলে আমাদের চান্স আছে।
আশাবাদী কোচ ক্রিস্পিনও। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেছেন, অবশ্যই আমি আশাবাদী। তবে একই সঙ্গে বাস্তববাদীও হওয়া দরকার। আমাদের গ্রুপে যদি অস্ট্রেলিয়া, চীন, জাপান বা সাউথ কোরিয়ার মতো দেশ থাকে তাহলে লড়াইটা খুব কঠিন হবে। অন্যদিকে, যদি জর্ডান, ভিয়েতনাম বা তাইপেই-এর মতো প্রতিপক্ষ হয়, তাহলে খানিকটা সহজ হবে। তবে আমরা নিঃসন্দেহে ডার্ক হর্স।
বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই
বিশ্ব ফুটবলের মানচিত্রে অনেকক্ষেত্রেই এগিয়ে থেকেছে ভারতীয় নারী ফুটবল দল। এই মুহূর্তে ছয় ধাপ নেমে গিয়ে ভারতীয় পুরুষ ফুটবল দলের ফিফা র্যাঙ্কিং যখন ১৩৩, নারী দলের র্যাঙ্কিং তখন ৭০। তবে নারী পুরুষের বৈষম্য কিন্তু প্রবল। সুদেষ্ণা বলেন, এমন একটা সময় ছিল যখন নারী দল ছিল তালিকায় ৪৮ নম্বরে। পুরুষদের র্যাঙ্কিং তখন ১০২। তারপরেও নারী ফুটবলের পরিকাঠামো কখনোই পুরুষ দলের সমতুল্য হয়নি।
স্পন্সরশিপ হোক বা পরিকাঠামো, নারী এবং পুরুষ দলের আয়োজনের মধ্যে আজও আসমান-জমিন ফারাক। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এআইএফএফ-এর এক আধিকারিকের মতে পুরুষ এবং নারী ফুটবলারদের আয়ের ব্যবধান প্রায় ৯০ শতাংশ। তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই একজন পুরুষ ফুটবলারের একমাসের আয় একজন নারী ফুটবলারের সারা বছরের আয়ের সমান।
কোচ ক্রিস্পিন এর আগে পুরুষ দলে খেলেছেন। তিনি বলেন, আমি পুরুষ দলে খেলে এসে এখানে কোচিং করাচ্ছি। আমি নিজেই বৈষম্য দেখেছি। পুরুষ দল যদি প্লেনে যাতায়াতের সুযোগ পান তাহলে নারী ফুটবলাররাও সেই সুযোগ পাবেন না কেন? হোটেল বিচারে কেন বৈষম্য থাকবে? এর পরে আছে সামাজিক বৈষম্য। আমি প্রায়ই দেখি, একজন নারী ফুটবলার অসম্ভব প্রতিভাশালী হলেও তার বাড়ি থেকে বিয়ে দেয়ার জন্য তাকে নিয়ে চলে যান তার পরিজনরা। অথবা অন্য কোথাও চাকরি করতে জোর করেন। খুব হতাশ লাগে তখন। আমি বারবার বলি, ন্যূনতম বৈষম্যগুলো কাটাতে হবে। ছেলেদের দলের তুলনায় নারী দল এগিয়ে থাকে কেন জানেন? তারা সর্বস্ব উজাড় করে খেলেন। এক একটা ম্যাচ খেলার জন্য তাদের যে অবিশ্বাস্য লড়াই লড়তে হয় তা আমরা ভাবতেও পারি না।
সিল্কি বলেন, পুরুষ দল আমাদের থেকে অনেক বেশি ম্যাচ খেলার সুবিধা পায়। আমাদের ক্লাব ফুটবল আর উইমেনস লিগ। ওরা কত ম্যাচ খেলে। ডুরান্ড কাপ, আরো নানান ট্রফি।
এই ফারাকের কথা মেনে নেন আধিকারিকরাও। পশ্চিমবঙ্গের ইন্ডিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেট অজিত বন্দ্যোপাধ্যায় ডিডাব্লিউকে বলেন, “এই দূরত্ব মেটানোর জন্য আমরা কন্যাশ্রী কাপ তৈরি করেছি। অনেক নারী ফুটবলাররা এখানে যোগ দেন। আমি ব্যক্তিগত ভাবে এই ফারাক মোছার চেষ্টা করি। আমাদের ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের নারী ফুটবল দল খুব শক্তিশালী। আমাদের অনেক প্ল্যান আছে। কাজে লাগানো প্রয়োজন।”
একই সঙ্গে অনেক কম নারী ফুটবলের দৃশ্যমানতা।সত্যনারায়ণ জানান, নারী ফুটবলে স্পন্সরশিপ কম। সরকারের পক্ষ থেকেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। আন্ডার ১৫, আন্ডার ১৯ টুর্নামেন্ট করানো হচ্ছে। ম্যাচের সংখ্যা বেড়েছে। বিশ্বকাপে যোগ্যতা অর্জন করতে পারলে এই পরিস্থিতি রাতারাতি পরিবর্তন হবে, আমরা জানি। ভালো ফলের বিকল্প নেই। এই টুর্নামেন্টে ভালো ফল করলেও আমরা অনেককে জবাব দিতে পারব।