এনবিআরে আন্দোলনে রাজস্ব আদায়ে বড় ক্ষতি

  • গতবারের চেয়ে এবার জুনে ১০ হাজার কোটি টাকা কম রাজস্ব আদায় 
  • অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন 
  • বদলির আদেশ ছিঁড়ে বরখাস্ত হলেন আরও সাত কর্মকর্তা-কর্মচারী 
  • গোপন দলিল প্রকাশ করায় দ্বিতীয় সচিব, চেয়ারম্যানকে নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে মন্তব্য করায় নিরাপত্তা প্রহরী বরখাস্ত

অনলাইন ডেস্ক: সদ্যবিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আদায় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা কমেছে। এনবিআরের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৪৩ হাজার ৯২ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের জুনে আদায়কৃত ৫৩ হাজার ৪৭ কোটি টাকার চেয়ে ৯ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা কম। সাধারণত অর্থবছরের শেষ মাসে রাজস্ব আদায় তুলনামূলক বেশ হয়ে থাকে। কিন্তু এনবিআর বিলুপ্তির প্রতিবাদে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দেড় মাসের আন্দোলনের প্রভাবে রাজস্ব আহরণে বড় ধরনের বিঘ্ন ঘটে। এর ফলে আমদানি-রপ্তানি ও অন্য অর্থনৈতিক কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দেয়, যার সরাসরি প্রভাব পড়ে রাজস্ব সংগ্রহে। আন্দোলনের শেষ দিকে সব ধরনের রাজস্ব আদায় কার্যক্রম দুই দিন বন্ধ রাখা হয়। ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি থেকে বাদ যায়নি চট্টগ্রাম বন্দরও।

চলতি অর্থবছরের বাজেটে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা, যা পরে সংশোধন করে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। জুনে রাজস্ব আদায় কম হলেও গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট রাজস্ব আদায়ে ২ দশমিক ২৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে বলে এনবিআর সূত্রে জানা গেছে। এনবিআরের এক কর্মকর্তা বলেন, সাধারণত জুন মাস অর্থবছরের শেষ মাস হওয়ায় তুলনামূলক বেশি রাজস্ব আদায় হয়। কিন্তু আন্দোলনের কারণে তা সম্ভব হয়নি। এই আন্দোলনের বড় প্রভাব পরেছে অর্থনীতিতে।

এদিকে এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মবিরতি ও শাটডাউন কর্মসূচি পালনের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। গতকাল বুধবার অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের (আইআরডি) এক আদেশে এই কমিটি গঠন করা হয়। আইআরডির যুগ্মসচিব সৈয়দ রবিউল ইসলামকে আহ্বায়ক করে গঠিত ৯ সদস্যবিশিষ্ট ঐ কমিটিতে অর্থ বিভাগ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, এনবিআর, আইআরডি, ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআই ও বিজিএমইএর প্রতিনিধি রাখা হয়েছে।

এই কমিটির কার্যপরিধিতে বলা হয়েছে তারা গত ২৮ ও ২৯ জুন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের অফিস বন্ধ থাকায় রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করবে। এছাড়া দুই মাসব্যাপী শুল্ক, ভ্যাট ও কর বিভাগের কর্মচারীদের কর্মসূচি পালনের কারণে সব কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, কাস্টম হাউজ, কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট এবং আওতাধীন অধিদপ্তর, পরিদপ্তরসহ অন্য দপ্তর ও কর কার্যালয়ে রাজস্ব ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ এবং এই কর্মসূচি পালনের কারণে শুল্কায়ন কার্যক্রম এবং সব স্থলবন্দর ও নৌবন্দরে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে ক্ষয়ক্ষতিসহ দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করবে। আগামী ৩০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে।

গত ১২ মে এনবিআর বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা এই দুটি বিভাগ করার অধ্যাদেশ জারি করা হয়। এর পর থেকে এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সব পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে সংস্কারে দাবিতে প্রায় দুই মাস আন্দোলন করেন। ২৮ ও ২৯ জুন সারা দেশে কাজ বন্ধ করে দেন তারা। এরপর ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের মধ্যস্থতায় আন্দোলন প্রত্যাহার করেন তারা। এরপর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়। আন্দোলন প্রত্যাহারের পর এখন পর্যন্ত তিন জন সদস্য ও একজন কমিশনারকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। এই পর্যন্ত ২১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ ছাড়া এনবিআরের দুই জন সদস্যসহ ১৬ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে দুদক। তাদের অধিকাংশই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।

এনবিআরের দ্বিতীয় সচিব মুকিতুল বরখাস্ত: এনবিআরের দ্বিতীয় সচিব ও উপকর কমিশনার মুকিতুল হাসানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে গোপন দলিল প্রকাশ করার অভিযোগ আনা হয়েছে। বুধবার এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান সই করা আদেশ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

প্রজ্ঞাপন সূত্রে জানা যায়, মুকিতুল হাসান রাষ্ট্রের অত্যন্ত গোপন দলিল প্রকাশপূর্বক চাকরির শৃঙ্খলা পরিপন্থী আচরণ করায় তার বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক বিভাগীয় কার্যধারা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। তাকে সরকারি চাকরি আইন অনুযায়ী এনবিআরের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগপূর্বক সরকারি চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

নিরাপত্তাপ্রহরী বরখাস্ত: এনবিআরের কর বিভাগের নিরাপত্তাপ্রহরী সেলিম মিয়াকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তিনি কর অঞ্চল-১০-এর সার্কেল-২০০-এর নিরাপত্তা প্রহরী। নিজের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে এনবিআর চেয়ারম্যান সম্পর্কে শিষ্টাচারবহির্ভূত মন্তব্য করায় তাকে বরখাস্ত করা হয়। মঙ্গলবার কর অঞ্চল-১০ থেকে এক চিঠিতে সেলিম মিয়াকে বরখাস্ত করা হয়। এই কর অঞ্চলের কর কমিশনার শাহ আলী চিঠিতে সই করেন। চিঠিতে বলা হয়, সেলিম মিয়ার নামে নিবন্ধন করা মোবাইল ফোন নম্বরের বিপরীতে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের (আইআরডি) সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান সম্পর্কে শিষ্টাচারবহির্ভূত মন্তব্য বা আচরণ করেন। যেহেতু সেলিম মিয়া স্বয়ং ঐ মোবাইল নম্বরটি তার নিজ নামে নিবন্ধন করা বলে স্বীকার করেছেন। তাই তার বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮-এর ৩ (খ) বিধি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা অনুযায়ী সেলিম মিয়াকে সরকারি চাকরি হইতে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। সাময়িক বরখাস্তকালীন সময়ে তিনি খোরপোশ প্রাপ্য হবেন।

এনবিআরের আরো সাত কর্মকর্তা-কর্মচারী বরখাস্ত: এনবিআরে আরও সাত কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বদলির আদেশ পাওয়ার পর যোগদান না করে প্রকাশ্যে আদেশ ছিঁড়ে ফেলায় তাদের বরখাস্ত করা হয়। এ নিয়ে মোট ২১ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। বুধবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এ সংক্রান্ত আদেশ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। বরখাস্ত হওয়া কর্মকর্তারা এনবিআর সংস্কারের আন্দোলনের সঙ্গে ছিলেন বলে জানা গেছে। সাময়িক বরখাস্ত কর্মকর্তারা হলেন—কর অঞ্চল-২-এর কর পরিদর্শক লোকমান হোসেন, ঢাকার আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিটের কর পরিদর্শক নাজমুল হাসান, আব্দুল্লাহ আল মামুন, কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট ঢাকা পশ্চিম সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ছালেহা খাতুন সাথি, কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট ঢাকা উত্তর সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা রৌশন আক্তার, কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট ঢাকা দক্ষিণের সিপাই সালেক খান, কর অঞ্চল ১৪-এর প্রধান সহকারী (নাজির) বি এম সবুজ।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, গত ২২ জুন এনবিআর বদলির আদেশ জারি করে। এই বদলির আদেশ অবজ্ঞাপূর্বক প্রকাশ্যে ছিঁড়ে ফেলার মাধ্যমে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করায় এবং এর মাধ্যমে বদলি আদেশ অমান্যকারীদের সমর্থন করায় সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। উল্লেখ্য, মঙ্গলবার ১৪ জন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্তের প্রজ্ঞাপন জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। তারাও এনবিআরে আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।

Related Articles

Back to top button