জুলাই গণঅভ্যুত্থান

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে দৃশ্যমান অগ্রগতি

অনলাইন ডেস্ক: জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যা, নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার তদন্ত ও বিচারে দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। ইতিমধ্যে চারটি মামলার তদন্ত শেষে ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হয়েছে ফরমাল চার্জ (আনুষ্ঠানিক অভিযোগ)। এর মধ্যে দুটি মামলা অভিযোগ গঠন পর্যায়ে রয়েছে। এছাড়া যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, মিরপুর, রামপুরা, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের আরো দশটি মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে।

এদিকে রাজধানীর চানখাঁরপুলে ছয় জনকে হত্যার মামলায় অভিযোগ গঠনের শুনানি শেষ হয়েছে। মামলায় অভিযুক্ত আট আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হবে কি না সেই বিষয়ে ১৪ জুলাই আদেশের জন্য দিন ধার্য রয়েছে। এছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন জনের বিরুদ্ধে করা মামলার অভিযোগ গঠন বিষয়ে শুনানি চলছে। সোমবার পরবর্তী শুনানি হবে। দুটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে করেন আইনজ্ঞরা।

এ প্রসঙ্গে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট গাজী এম এইচ তামিম ইত্তেফাককে বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনের পর ছয় মাসের ব্যবধানে চারটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তদন্ত সংস্থা। আরো দশটি মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর প্রসিকিউশন তা পর্যালোচনা করে এক সপ্তাহ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ফরমাল চার্জ (আনুষ্ঠানিক অভিযোগ) ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেছে। আইনানুযায়ী প্রসিকিউশন ও ডিফেন্স যে সময় পাওয়ার সেটাই পাচ্ছে। যার কারণে এত অল্প সময়ে এত বড় বড় মামলার তদন্ত সম্পন্ন ও বিচারকাজের দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। তিনি বলেন, অভিযোগ গঠনের পর সাক্ষ্য গ্রহণের আগে ২১ দিন সময় দিতে হয়। আমরা আশা করছি, আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে শেখ হাসিনার মামলাসহ বেশ কয়েকটি মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়ে যাবে। সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হলে দ্রুত মামলার বিচার শেষ করতে সক্ষম হব বলে প্রসিকিউশন মনে করে।

প্রসিকিউশন কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থান চলাকালে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে দমাতে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর সঙ্গে যোগ দেয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে রাজধানী ঢাকাসহ দেশে ৫৬ হাজার বর্গমাইলে আন্দোলনরতদের ওপর নির্বিঘ্নে গুলি চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এতে দেড় হাজারের মতো ছাত্র-জনতাকে হত্যা এবং ২৫ হাজারের মতো মানুষকে গুরুতর আহত করা হয়। এসব নিহত-আহতের ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন কার্যালয়ে ৪২৯টি অভিযোগ দাখিল করেন ভিকটিম ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। এসব অভিযোগের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিবেচনা করে ট্রাইব্যুনালে ২৭টি বিবিধ মামলা দায়ের করে প্রসিকিউশন। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে শেখ হাসিনা ও তার সরকারের সাবেক অনেক মন্ত্রী ও এমপিদের। আসামির তালিকায় আছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং মাঠ পর্যায়ে থেকে ছাত্র-জনতার ওপর সরাসরি গুলি করেছেন এমন পুলিশ সদস্যরা। এসব মামলায় ২০৬ জন আসামির মধ্যে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন ৭৩ জন। পলাতক রয়েছেন ১৩২ জন। যাদের অনেকের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি রয়েছে।

প্রসঙ্গত গত বছরের জুলাই মাসে শুরু হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন। একপর্যায়ে তা সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। সেই আন্দোলন দমাতে ছাত্র-জনতার ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে গুলি চালাতে নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। তার এই নির্দেশনা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের মাধ্যমে যায় তত্কালীন পুলিশের আইজিপির কাছে। আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন তার অধীনস্থ পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পৌঁছে দেন, যা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার ফরমাল চার্জে উল্লেখ করেছেন প্রসিকিউশন। কিন্তু গুলি চালিয়ে ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেননি শেখ হাসিনা। গণঅভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট দেশ থেকে পালিয়ে যান তিনি। আশ্রয় নেন ভারতে।

মামলা ও আসামির সংখ্যা :গণঅভ্যুত্থান চলাকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার পুনর্গঠন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। পুনর্গঠিত ঐ ট্রাইব্যুনালে দায়েরকৃত বিবিধ দুটি মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গত ১৭ অক্টোবর প্রথম গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির মধ্য দিয়ে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরপর একে একে বেশ কয়েকটি বিবিধ মামলায় পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল। তদন্তাধীন মামলার মধ্যে চারটি মামলার তদন্ত শেষ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ দুটি এবং ট্রাইব্যুনাল-২ এ আশুলিয়ায় ছয় লাশ পোড়ানো এবং রংপুরে আবু সাঈদ হত্যা মামলা ফরমাল চার্জ দাখিল করেছে প্রসিকিউশন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি করেছেন চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম। হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটির (ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়) অভিযোগ আনা হয়েছে মামলায়। আগামী ৭ জুলাই এই মামলার পলাতক আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত কৌঁসুলি তার বক্তব্য উপস্থাপন করবেন। বিচারপতি মো. গোলাম মুর্তজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল পহেলা জুলাই এই দিন ধার্য করে দিয়েছেন। এছাড়া একই ট্রাইব্যুনালে রাজধানীর চাঁনখারপুলে ছয় জনকে গুলি করে হত্যার মামলায় ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আট পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি শেষ হয়েছে। ১৪ জুলাই আদেশের জন্য দিন ধার্য রাখা আছে।

এদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ রংপুরের আবু সাঈদ হত্যা মামলায় ৩০ জনকে অভিযুক্ত করে ফরমাল চার্জ দাখিল করা হয়েছে। অভিযুক্তদের মধ্যে রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি হাসিবুর রশীদসহ ২৬ জন পলাতক থাকায় তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। আগামী ১০ জুলাই পরবর্তী শুনানির জন্য দিন ধার্য রয়েছে। গত ৩০ জুন এই আদেশ দেন বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল। একই ট্রাইব্যুনালে সাভারের আশুলিয়ায় ছয় জনকে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার মামলায় স্থানীয় এমপি সাইফুল ইসলাম, ঢাকা রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলামসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে ফরমাল চার্জ আমলে নিয়ে পলাতক আট আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। আগামী ১৩ জুলাই মামলার পরবর্তী শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।

এই চার মামলা ছাড়াও সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৩ জনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে। এছাড়া গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গুমের ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে এবং মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশে হামলার ঘটনায় করা আরেকটি মামলার তদন্ত করছে তদন্ত সংস্থা। এই মামলায় হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি রয়েছে।

Related Articles

Back to top button