অর্থ পাচারে রাজনীতিবিদ, আমলা এবং ব্যবসায়ী নির্বাচনি বছরে বাড়ে টাকা পাচার

অনলাইন ডেস্ক: জাতীয় নির্বাচন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার বছর এলেই বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচার বেড়ে যায়। এ সময়ে ক্ষমতা পরিবর্তনের শঙ্কায় কিছু রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যবসায়ী বিভিন্ন দেশে অর্থ নিয়ে যান। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই), সুইস ব্যাংক এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে এ তথ্য মিলেছে। সংস্থাগুলোর রিপোর্ট অনুসারে আগের বছরের তুলনায় ২০২৪, ২০১৮, ২০১৪ এবং ২০০৭ সালে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার বেড়েছে। আলোচ্য বছরগুলো বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ব্যাপক আলোচিত ছিল। বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের বেশির ভাগই যায় শীর্ষ দশ দেশে। এক্ষেত্রে কর সুবিধা পাওয়া যায় এবং আইনের শাসন আছে, অপরাধীরা সেসব দেশকেই বেছে নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে-সংযুক্ত আবর আমিরাত, সিঙ্গাপুর, কানাডা, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, হংকং এবং থাইল্যান্ড। পাচারকারীদের অধিকাংশই প্রভাবশালী অথবা তাদের সম্পৃক্ত।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, কয়েক বছর পর্যন্ত অর্থ পাচার বাড়ছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্টে এমন তথ্যই উঠে এসেছে। তিনি বলেন, টাকা পাচারের অনেক কারণ আছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অন্যতম। সাধারণত রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির হলে টাকা পাচার হয়ে থাকে। আর বিনিয়োগ না হলেও টাকা পাচার বাড়ে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সুইজারল্যান্ডে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সুইস ব্যাংক প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশে নির্বাচন হয়েছে, ওই বছর টাকা পাচার বেড়েছে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশে সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচন হয়েছে। এরপর ছাত্র-জনতার আন্দোলনসহ নানা কারণে অস্থির ছিল ওই বছর। কিন্তু বৃহস্পতিবার প্রকাশিত সুইস ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে আগের বছরের তুলনায় ২০২৪ সালে বাংলাদেশিদের আমানত ৩৩ গুণ বেড়েছে। আলোচ্য বছরে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানত ছিল ৫৮ কোটি ৯৫ লাখ সুইস ফ্র্যাংক। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৮ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা। আগের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে এই আমানত ছিল ১ কোটি ৭৭ লাখ ফ্র্যাংক বা ২৬৫ কোটি টাকা। আবার ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আর ২০১৭ সালে বাংলাদেশিদের আমানত ছিল ৪৮ কোটি ১৩ লাখ ফ্র্যাংক। কিন্তু ২০১৮ সালে তা বেড়ে ৬১ কোটি ৭৭ লাখ ফ্র্যাংকে উন্নীত হয়। এছাড়া ২০১৪ সালে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর আগের বছর ২০১৩ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানত ছিল ৩৭ কোটি ১৮ লাখ ফ্র্যাংক। কিন্তু ২০১৪ সালে অর্থাৎ নির্বাচনি বছরে তা বেড়ে ৫০ কোটি ৬০ লাখ সুইস ফ্র্যাংকে উন্নীত হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অন্যতম অস্থির বছর ছিল ২০০৭ সাল। বছরটিকে ওয়ান-ইলেভেন হিসাবে ধরা হয়। ওই বছর টাকা পাচার বেড়েছে। ২০০৬ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানত ছিল ১২ কোটি ৪০ লাখ সুইস ফ্র্যাংক। কিন্তু পরের বছর অর্থাৎ ২০০৭ সালে তা বেড়ে দ্বিগুণ ২৪ কোটি ৩০ লাখে উন্নীত হয়।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ৫ কারণে টাকা পাচার হচ্ছে। এর মধ্যে দেশে বিনিয়োগের পরিবেশের অভাব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার শঙ্কা, রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর দুর্বল নজরদারি, আইনের শাসনের ঘাটতি এবং বেপরোয়া দুর্নীতি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে অর্থ পাচারের বড় রোড দুবাই। বিভিন্ন ব্যক্তি বড় অঙ্কের ঘুস লেনদেন করলে সেটি বাংলাদেশে নয়, দুবাইতে বসে ডলারে পরিশোধ করতে হয়। পরে তা বিভিন্ন দেশে চলে যায়। এরপর আসে সিঙ্গাপুরের নাম। তবে অনেকে বলছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞার পর পরিস্থিতি ভিন্নরূপ। সেক্ষেত্রে দেশটিতে পাচার কিছুটা কমেছে বলে অনেকের ধারণা।
আন্তর্জাতিক ৬টি সংস্থার রিপোর্টে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের তথ্য আসছে। এগুলো হলো-জিএফআই, সুইস ব্যাংক, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম (আইসিআইজে) প্রকাশিত পানামা, প্যারাডাইস ও পেনডোরা পেপার্স, জাতিসংঘের উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ইউএনডিপি) রিপোর্ট এবং মালয়েশিয়া প্রকাশিত সেদেশের সেকেন্ড হোম রিপোর্ট। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও সিঙ্গাপুরে বেশ কিছু বাংলাদেশির অর্থ পাচারের তথ্য মিলেছে। সংস্থাগুলোর রিপোর্টে অর্থ পাচারে শতাধিক বাংলাদেশির নাম উঠে এসেছে। এর মধ্যে রাজনীতিবিদ, আমলা এবং ব্যবসায়ীদের নেতাদের নাম রয়েছে।
দেশের আর্থিক খাতের প্রকৃত অবস্থা মূল্যায়নে শ্বেতপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে প্রধান করে গঠিত কমিটি ইতোমধ্যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগ শাসনামলের ১৫ বছরে দেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। স্থানীয় মুদ্রায় যা ২৮ লাখ কোটি টাকা। এই পরিমাণ টাকা গত ৫ বছরে দেওয়া দেশের জাতীয় বাজেটের চেয়েও বেশি। আলোচ্য সময়ে প্রতিবছর পাচার হয়েছে ১৬ বিলিয়ন ডলার বা ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ১৫ বছরের পাচারের অর্থ দিয়েই ৭৮টি পদ্মা সেতু করা সম্ভব।
ইতোমধ্যে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানের সম্পদ যুক্তরাজ্যে জব্দ হয়েছে। একই দেশে জব্দ হয়েছে বিতর্কিত ব্যবসায়ী সালমান ও তার পরিবারের সম্পদ। সিঙ্গাপুরে অর্থ পাচার করেছেন এই তালিকায় রয়েছেন ব্যাংক খাতের মাফিয়া সাইফুল আলম (এস আলম) মাসুদ ও দেশের জ্বালানি খাতের বড় ব্যবসায়ী সামিট গ্রুপের নাম। এছাড়া দুই বছর আগে ভারতে গ্রেফতার রয়েছেন এস আলমের সহযোগী ফাস ফাইন্যান্সের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদার। ইতোমধ্যে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআইকেও দেওয়া তার জবানবন্দিতে দেশের রাজনৈতিক সাবেক ও বর্তমান রাঘববোয়ালদের নাম উঠে এসেছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম (আইসিআইজে) প্রকাশিত পানামা ও প্যারাডাইস পেপার্সে ৯২ জন বাংলাদেশির নাম এসেছে। এর মধ্যে অনেক রাঘববোয়ালের নাম প্রকাশিত হয়েছে, যারা বর্তমানে ক্ষমতাশালী। কুয়েতে বাংলাদেশি সংসদ-সদস্য শহিদ ইসলাম পাপুল, যুবলীগ নেতা ইসলাম চৌধুরী সম্রাট এবং ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নিশান মাহামুদ শামীমসহ বেশকিছু নাম ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। এদিকে শেয়ারবাজারে জালিয়াতির মাধ্যমে ৪ মিউচুয়াল ফান্ড থেকে ২০২২ সালে ২৩৫ কোটি টাকা সরিয়ে নিয়েছে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি ইউনিভার্সাল ফাইন্যান্সিয়াল সলিউশন (ইউএফএস)। এর মধ্যে ইউএফএসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ হামজা আলমগীরের নেতৃত্বে ১৭০ কোটি ৬৯ লাখ টাকা সরাসরি আত্মসাতের প্রমাণ পেয়েছে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। অন্যদিকে পাচারের অর্থ ফেরাতে বেশকিছু পদক্ষেপের কথা বলছে সরকার। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পাচার ঠেকাতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। না হলে এই টাকা আর দেশে ফেরত আসবে না। জানা গেছে, বিদেশে শ্রমিক যাওয়া বাড়লেও হুন্ডির প্রবণতা বৃদ্ধির ফলে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রত্যাশিত রেমিট্যান্স আসছে না। অন্যতম কারণ অর্থ পাচারকারীরা হুন্ডিকে ব্যবহার করে বিদেশেই টাকা রেখে দিচ্ছে। দেশে ওই প্রবাসীদের পরিবারকে বাংলাদেশি মুদ্রায় অর্থ পরিশোধ করছে। যা দেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। জিএফআইর প্রতিবেদনে বলা হয়, ৬ বছরে দেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। স্থানীয় মুদ্রায় যা সাড়ে ৫ লাখ কোটি টাকা। গড়ে প্রতিবছর পাচার হচ্ছে ৯১ হাজার কোটি টাকা।