উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে পানিতে ডুবে মৃত্যু

- ঈদের ছুটিতেই ৮১ জনের মৃত্যু
- বছরে পানিতে ডুবে ১৪ হাজারের বেশি শিশু মারা যায়
- শিশুদের সাঁতার শেখানোর পরামর্শ
অনলাইন ডেস্ক: বর্ষা মৌসুম এলেই পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর ঘটনা বাড়ে। যা রীতিমতো উদ্বেগের। বর্ষাকালে টানা বৃষ্টিতে নদী-খাল-বিল, পুকুর-ডোবা পানিতে পূর্ণ হয়ে যায়। ফলে মাছ ধরতে গিয়ে, গোসল করতে গিয়ে, কিংবা পা পিছলে পড়ে পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এবার ঈদের ছুটিতে কমপক্ষে ৮১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। গত কয়েক বছর ধরে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা, জনসচেতনতা ও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ সত্ত্বেও কমছে না পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা। বিশেষত শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে এই মৃত্যুর হার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।
সম্প্রতি কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে মাছ ধরতে গিয়ে পানিতে ডুবে দুই ভাইবোনের মৃত্যু হয়। উপজেলার রায়গঞ্জ ইউনিয়নের পশ্চিম রায়গঞ্জ বালাবাড়ী এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। মৃত দুই শিশু ইব্রাহীম আলী (০৮) ও তাবাসসুম (০৯) সম্পর্কে মামাতো ও ফুপাতো ভাইবোন।
গত ১৬ জুন রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজের পুকুরে সাঁতার শিখতে এসে পা পিছলে গভীর পানিতে ডুবে মারা যান সানজিদা আক্তার (১৭) নামে এক কলেজ শিক্ষার্থী। তিনি আজিমপুর অগ্রণী গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক ২য় বর্ষের ছাত্রী। সানজিদাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা মোহনা ইসলাম নামে ইডেনের ফিন্যান্স বিভাগের ছাত্রী জানান, সানজিদার বাসা পুরান ঢাকার চকবাজার এলাকায়। বাসায় গিয়ে তাকে পড়ান মোহনা। সকালে তারা ফোনে যোগাযোগ করে একসঙ্গে বাসা থেকে বের হন। উদ্দেশ্য ছিল ইডেন কলেজের পুকুরে দুই জনই সাঁতার শিখবে। সেই পরিকল্পনামতে ইডেন কলেজের ভেতর ঢুকে দুই জনই পুকুরে নামেন। পুকুরের পাড়বাঁধা সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে গোসল করার সময় পা পিছলে গভীর পানিতে ডুবে যায় সানজিদা। তখন মোহনার চিৎকারে আশপাশের শিক্ষার্থী ও কর্মচারীরা এসে পানি থেকে তাকে তুলেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক সানজিদাকে মৃত ঘোষণা করেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের তথ্যমতে, গত এক দশকে বিশ্বব্যাপী পানিতে ডুবে ২৫ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি বছর পানিতে ডুবে ১৪ হাজারের বেশি শিশু মারা যায়, যা পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ। পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার বেশির ভাগ ঘটনা ঘটে আশপাশের জলাশয়গুলোতে, যার কারণে গ্রামেই এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটে থাকে।
জাতিসংঘ শিশু তহবিল-ইউনিসেফের গবেষণা বলছে, এই মৃত্যু প্রতিরোধযোগ্য। শিশুদের সাঁতার শেখানো, জলাশয় ঘিরে বেড়া দেওয়া ও প্রাক-স্কুল শিশুদের জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্রের মতো নিরাপদ স্থান তৈরি করা এবং পরিবার, কমিউনিটি ও জাতীয় পর্যায়ে সচেতনতা বাড়ানো গেলে হাজার হাজার জীবন বাঁচবে।
ন্যাশনাল এ্যালায়েন্স ফর ড্রাউনিং প্রিভেনসনের আহ্বায়ক সদরুল হাসান মজুমদার ইত্তেফাককে বলেন, ইউএন রেজুলেশনের আলোকে আমরা পানিতে ডুবে মৃত্যুর জাতীয় কৌশলপত্র তৈরি করেছি। সরকারের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে, তবে সরকার পরিবর্তন হওয়ার কারণে এখনো সেই কৌশলপত্র অনুমোদন হয় নাই। তিনি বলেন, এই কৌশলপত্রটি সরকার নীতিগতভাবে অনুমোদন দিলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর একটা দায়িত্ব বাড়বে।
দীর্ঘদিন ধরে পানিতে ডোবা প্রতিরোধে কাজ করা এই বিশেষজ্ঞ জানান, কেবল প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। সাঁতার শেখাটাকে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে। সকাল ৯টা থেকে ২টা পর্যন্ত যে শিশুরা পানিতে পড়ে মারা যায়, তারা কিন্তু ঘর থেকে মাত্র ২২ গজ দূরে ডুবে মৃত্যুবরণ করে। সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সচেতনতা তৈরি করা। এই সচেতনতার জন্যে সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন। তিনি বলেন, শহরের বাবা-মায়েদের জন্যে শিশুদের সাঁতার শেখানোটা কিছুটা চ্যালেঞ্জ। কারণ শহরে সুযোগ কম। কিন্তু গ্রামের বাবা-মায়েরা যদি মনে করেন যে তার সন্তানকে আগে সাঁতার শেখাতে হবে, তাহলে সরকারি-বেসরকারি কারো কোনো সাপোর্ট প্রয়োজন পড়বে না। শুধু বাবা-মাকে মনে করতে হবে শিশুর বয়স ছয় বছর হয়েছে, তাকে সাঁতার শেখাতে হবে। বাবা-মাকে অন্য সবকিছুর মতো সাঁতারটা জীবনরক্ষাকারী কৌশল, সেটা বুঝতে হবে। বাবা-মায়েদের মধ্যে এই সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।