তৎকালীন ভিসি আব্দুস সাত্তার কারাগারে, দুই মেয়াদে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেন যবিপ্রবিকে

অনলাইন ডেস্ক: যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (যবিপ্রবি) দুই মেয়াদে উপাচার্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন অধ্যাপক ড. আবদুস সাত্তার। ২০০৯ সালের ৭ এপ্রিল থেকে ২০১৭ সালের ৬ এপ্রিল পর্যন্ত দায়িত্ব পালনকালে বিশ্ববিদ্যালয়কে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছিলেন।

নিয়োগ, পদোন্নতি ও টেন্ডার বাণিজ্যের টাকা ও কমিশন কালেকশন করতেন স্ত্রী নাসিমা আক্তার ও একদল শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী সিন্ডিকেট। তাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠলেও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক থাকায় ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সাবেক উপাচার্য আবদুস সাত্তারের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ পড়ে দুদকে। সম্প্রতি দুদক সাবেক উপাচার্য আবদুস সাত্তার ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করেছে। সোমবার (১৬ জুন) দুদকের একটি মামলায় আবদুস সাত্তারকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত।

এ বিষয়ে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক সালাহউদ্দিন বলেন, দুর্নীতির অভিযোগে সম্প্রতি অধ্যাপক আবদুস সাত্তারের নামে তিনটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে একটি বিচারাধীন। বাকি দুটি তদন্তাধীন রয়েছে।

জানতে চাইলে সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) যশোরের সাবেক সভাপতি ও সাবেক অধ্যক্ষ শাহীন ইকবাল বলেন, একজন সাবেক উপাচার্য দুর্নীতির মামলায় কারাগারে গেলেন। শিক্ষক হিসাবে এটা দুঃখজনক। অভিযোগ সত্য হলে অবশ্যই নিন্দনীয়। দোষী হলে শাস্তি হোক। তবে নিরপরাধী হলে উদ্দেশ্যমূলকভাবে যেন হয়রানির শিকার না হন।

দুদকের মামলায় কারাগারে : অবৈধভাবে কর্মকর্তা নিয়োগ ও সরকারি ৬১ লাখ ৩১ হাজার ৭৩২ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০২৩ সালের ২১ আগস্ট যবিপ্রবির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সাত্তারসহ তিনজনের নামে মামলা করেন দুদক যশোরের তৎকালীন উপপরিচালক আল-আমিন। মামলার তদন্ত শেষে সম্প্রতি আদালতে চার্জশিট দেয় দুদক। তিন আসামিকে গ্রেফতারে পরোয়ানা জারি করেন আদালত। দুই আসামি আব্দুর রউফ ও ড. কামাল উদ্দিন জামিন নেন। সোমবার ধার্য তারিখে সিনিয়র জেলা ও দায়রা (সিনিয়র স্পেশাল) জজ আদালতে হাজির হয়ে জামিন আবেদন করেন অধ্যাপক ড. আবদুস সাত্তার। বিচারক জামিন না মঞ্জুর করে আসামিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন দুদকের পিপি সিরাজুল ইসলাম।

মামলার চার্জশিটে বলা হয়, ২০০৯ সালের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী সহকারী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) পদে আবেদন করেন আসামি আব্দুর রউফ। নিয়োগের জন্য গঠিত তিন সদস্যবিশিষ্ট বাছাই বোর্ডের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন উপাচার্য ড. আবদুস সাত্তার।

বাছাই বোর্ডের আরেক সদস্য ছিলেন ইবির উপ-উপাচার্য ড. কামাল উদ্দিন। বিজ্ঞপ্তির শর্ত অনুযায়ী পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কর্মকর্তা হিসাবে আব্দুর রউফের কোনো পূর্ব-অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও বাছাই বোর্ড অবৈধভাবে তাকে প্রথমে সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করে। পরে অভিজ্ঞতার ঘাটতি থাকায় তাকে সেকশন অফিসার (গ্রেড-১, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করে।

রিজেন্ট বোর্ড সভাপতি হিসাবে সাবেক ভিসি ড. আবদুস সাত্তার উন্মুক্ত বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই তাকে সেকশন অফিসার হিসাবে নিয়োগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। আব্দুর রউফ সেকশন অফিসার পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে কর্মরত থাকা অবস্থায় ২০১৪ সালে সহকারী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) পদে এবং ২০২১ সালে উপপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। অবৈধ নিয়োগে ২০০৯ সালের অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত তিনি বেতন-ভাতা বাবদ ৬১ লাখ ৩১ হাজার ৭৩২ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

দুদকের দুটি মামলা তদন্তাধীন : চলতি বছরের ২৭ মে সাবেক ভিসি আবদুস সাত্তারসহ ৬ জনের নামে মামলা করেন দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত জেলা কার্যালয় যশোরের উপসহকারী পরিচালক চিরঞ্জীব নিয়োগী। মামলার এজাহারে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন, সংবিধি, নিয়োগ নীতিমালা ও ইউজিসির নির্দেশনা লঙ্ঘন করে মো. শরিফুল ইসলামকে অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। মো. শরিফুল ইসলাম ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বেতন বাবদ ৫২ লাখ ২৬ হাজার ৬৮৫ টাকা সরকারি কোষাগার থেকে উত্তোলন করে রাষ্ট্রের ক্ষতিসাধন করেছেন, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

এদিকে চলতি বছরের ৪ মার্চ অবৈধভাবে সহকারী অধ্যাপক নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগে আবদুস সাত্তারসহ চারজনের নামে মামলা করেন দুদক যশোর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক জালাল উদ্দিন। মামলার অভিযোগে বলা হয়, অভিযুক্তরা পরস্পর যোগসাজশে নিয়োগ নীতিমালার শর্ত ভঙ্গ করে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও ড. ইকবাল কবীর জাহিদকে অবৈধভাবে সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ প্রদান করেন।

আরও যত অভিযোগ : যবিপ্রবির তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবদুস সাত্তারের নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন তার কলেজ শিক্ষিকা স্ত্রী নাসিমা আক্তার। চাকরি প্রার্থীদের কাছ থেকে ঘুস হিসাবে জমি লিখে নেওয়ারও অভিযোগ ছিল। এলাকার দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা নগদে ঘুস দিতে না পারায় জমি লিখে নিতেন বলেও অভিযোগ আছে। ২০১৭ সালে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় দৈনিক যুগান্তরে।

ক্যাম্পাসে কোটি টাকার বাংলো বাড়ি থাকলেও সেখানে থাকতেন না তৎকালীন উপাচার্য আবদুস সাত্তার। তিনি শহরের পালবাড়ি এলাকায় নিজের বাড়িতে থাকতেন। নিজের বাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসাবে দেখিয়ে প্রতি মাসে বিশ্ববিদ্যালয় কোষাগার থেকে ভাড়া তুলতেন। এ নিয়েও সংবাদ প্রকাশ করে যুগান্তর।

২০১৭ সালের ৫ এপ্রিল ভিসি হিসাবে শেষ কর্মদিবসের আগে ৩০ দিনে তিনি তিনটি রিজেন্ট বোর্ডের সভা করেন। ওই সভায় নিয়োগ, পদোন্নতি ও অর্থছাড়ের হিড়িক বসান। এ বিষয়ে তখন যুগান্তরে সংবাদ প্রকাশিত হয়।

Related Articles

Back to top button