পাশাপাশি কবরে শায়িত মা-ছেলে, সেই দৃশ্য দেখে কাঁদছে গ্রামবাসী

অনলাইন ডেস্ক: এ যেন নিয়তির নির্মম পরিহাস। ভাঙা ভাঙা সুরে কথা বলে চারপাশ মাতিয়ে রাখতো তিন বছরের ছোট্ট শিশু মানারুল ইসলাম তাওহিদ। তবে কথার সুর স্পষ্ট ফুটে ওঠার আগেই পৃথিবীকে জানিয়েছে চিরবিদায়। তার পাশের কবরেই ঠাঁই হয়েছে মা ফারহানা আক্তার সুমির। তাদের পাশেই কবর দেওয়া হয়েছে সুমির চাচাতো দেবর সাইফুল ইসলামকে।
সড়ক দুর্ঘটনায় একই বাড়ির তিনজনের মৃত্যুর এমন করুণ দৃশ্য দেখে কাঁদছে পুরো এলাকার মানুষ। রোববার (১৫ জুন) রাতে তাদের দাফন শেষে এমন হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখা গেছে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার কাটাছরা ইউনিয়নে।
এর আগে শনিবার দুপুরে বারইয়ারহাট-খাগড়াছড়ি সড়কের চিনকীরহাট এলাকায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার সঙ্গে পিকআপ ভ্যানের মুখোমুখি সংঘর্ষে গুরুতর আহত হন তিনজন। এসময় ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান সাইফুল। সেদিন রাতেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রাণ হারান মা-ছেলে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এক বছর আগে স্থানীয় এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা কিনেন সুমির স্বামী জিয়া উদ্দিন বাবলু (৩০)। সেই অটোরিকশা চালিয়ে শনিবার দুপুরে স্ত্রী সুমি (২৫), ছেলে মানুরুল ইসলাম তাওহিদ (৩), মেয়ে কায়সার জাহান তানিশা (৭) ও চাচাতো ভাই সাইফুল ইসলাম শাহিনকে (১৭) নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে দাওয়াতে যাচ্ছিলেন। পথে বারইয়ারহাট-খাগড়াছড়ি সড়কের চিনকীরহাট এলাকায় অটোরিকশাটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বিপরীত দিক থেকে আসা বালুবোঝাই একটি পিকআপের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান বাবলুর চাচাতো ভাই সাইফুল ইসলাম শাহিন।
জিয়া উদ্দিন বাবলুর স্ত্রী ফারহানা আক্তার সুমি, মেয়ে তানিশা ও ছেলে তাওহিদকে গুরুতর আহত অবস্থায় চমেক হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ৯টায় মারা যান বাবলুর স্ত্রী ফারহানা আক্তার সুমি ও ছেলে মানারুল ইসলাম তাওহিদ।
একই বাড়ির তিনটি মানুষের একসঙ্গে মৃত্যুতে শোকে স্তব্ধ স্বজন ও এলাকার বাসিন্দারা। গ্রামজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় সড়ক দুর্ঘটনা, নিহত বেড়ে ১১চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় সড়ক দুর্ঘটনা, নিহত বেড়ে ১১
রোববার রাতে চমেক হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে তিনজনের মরদেহ নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সটি যখন সাইরেন বাজিয়ে উপজেলার কাটাছড়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যম বামনসুন্দর গ্রামের রহিম বক্স মাঝির বাড়িতে প্রবেশ করে তখন স্বজন ও এলাকাবাসীর কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে পুরো গ্রাম।
তারপর অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে বাড়ির উঠোনে আগে থেকেই রাখা খাটিয়ায় তোলা হয় একের পর এক মরদেহ।
আহত জিয়া উদ্দিন বাবলুর বৃদ্ধা মা বিবি হালিমা বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘আমার আদরের ছোট্ট নাতী, পুত্রবধূকে হারিয়ে ফেলেছি। মৃত্যুর সঙ্গে হাসপাতালে পাঞ্জা লড়ছে ছেলে এবং নাতনী। আমার মনকে কি করে সান্ত্বনা দিবো। আমার নাতী মানারুলের বয়স তো মাত্র তিন বছর। এই বয়সে তো তারা চলে যাওয়ার কথা না। আপনারা আমার নাতী-নাতনী, ছেলে এবং পুত্রবধূকে আমার বুকে ফিরেয়ে দেন।’
নিহত সাইফুল ইসলাম শাহিনের বাবা নুরুল করিম বলেন ‘আমার ৬ জন ছেলেমেয়ের মধ্যে সবার ছোট শাহিন। সে একটু সহজ সরল। যে যেদিকে যেতে বলে সেদিকে চলে যায়। শনিবার দুপুরে আমাদের কাউকে কিছু না জানিয়ে আমার ভাতিজার সাথে তার শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে চলে যায়। সেখানে যাওয়ার পথে একটি বালুবোঝাই পিকআপ ভ্যানের সঙ্গে অটোরিকশার সংঘর্ষে আমার ছেলেটি মারা যায়।’
আহত জিয়া উদ্দিনের বড় ভাই সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘চমেক হাসপাতালে এখনো চিকিৎসাধীন আছেন জিয়া উদ্দিন এবং তার মেয়ে কায়সার জাহান তানিশা। এর মধ্যেই তিনজনের মরদেহ দাফন করা হয়েছে। পাশাপাশি কবরে ছোট শায়িত হয়েছে আমার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী ফারজানা আক্তার সুমি ও তার ছেলে মানারুল ইসলাম তাওহিদের কবর। রোববার বাদ এশা পারিবারিক কবরস্থানে জানাযা শেষে তাদের দাফন করা হয়েছে।’
এলাকাবাসী বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় বামনসুন্দর এলাকার মা-ছেলেসহ একই বাড়ির মৃত্যুর ঘটনায় এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে মা-ছেলের জন্য পাশাপাশি কবর খোড়ার দৃশ্য দেখে স্বজন ও প্রতিবেশীদের অশ্রু জলে সিক্ত হচ্ছে। অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন।
জোরারগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সাব্বির মোহাম্মদ সেলিম বলেন, নিহত সাইফুল ইসলামের বড় ভাই মোহাম্মদ রুবেল বাদী হয়ে পিকআপের চালক শাহাবুদ্দিনকে আসামি করে থানায় একটি মামলা করেছেন। তিনজনের মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পিকআপ চালককে আটকের জন্য অভিযান চলছে।