ভারত-পাকিস্তান, যুদ্ধবিরতির স্থায়িত্ব নিয়ে সংশয় যে কারণে 

অনলাইন ডেস্ক: চার দিনের সংঘর্ষের পর পরমাণু শক্তিধর দুই প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তান অবশেষে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির কথা জানান। এরপর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও একই তথ্য জানান। এরপর দুই দেশের পক্ষ থেকেও যুদ্ধবিরতির বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।

কিন্তু এই যুদ্ধবিরতি দুই শত্রু দেশের মধ্যে কতদিন স্থায়ী হবে সেটা নিয়ে সংশয় রয়েছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন এবং কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা পৃথক পৃথক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। কারণ যুদ্ধবিরতির কয়েক ঘণ্টা পরই যুদ্ধবিরতি লংঘনের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ভারত-পাকিস্তান সত্যি যুদ্ধে লিপ্ত ছিল?

এক কথায় জবাব হচ্ছে-‘না’। ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, ড্রোন হামলা এবং কামানের গোলাবর্ষণসহ তীব্র সামরিক সংঘাত সত্ত্বেও কোনো সরকারই আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করেনি। ভারত ও পাকিস্তান তাদের সামরিক পদক্ষেপগুলোকে নির্দিষ্ট সমন্বিত ‘সামরিক অভিযান’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। গত ২২ এপ্রিল পহেলগামে পর্যটকদের ওপর এক মারাত্মক হামলার জবাবে ভারত ‘অপারেশন সিঁদুর’ শুরু করার কয়েক দিন পর শনিবার পাকিস্তান ‘বুনিয়ান মারসুস’ নামে একটি প্রতিশোধমূলক আক্রমণ শুরু করেছে, যার আরবি অর্থ ‘সিসার প্রাচীর’।

পহেলগামে হামলার জন্য ভারত আক্রমণের পেছনে পাকিস্তানভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে দায়ী করেছে। তবে এই দুই দেশের জন্য এটি অস্বাভাবিক নয়। পূর্ববর্তী বড় সংঘর্ষে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করেনি, এমনকি হাজার হাজার সৈন্য এবং বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার পরেও।

যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতা নিয়ে ভিন্নমত

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেওয়ার পর দুই দেশই সেটিতে সম্মত জানায়। মার্কো রুবিও জানিয়েছিলেন, দুই দেশের সংকট নিয়ে নিরপেক্ষ কোনো দেশে আলোচনায় বসবে দুই দেশ।

কিন্তু ভারতের তথ্য মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, এই চুক্তি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ সংকট সমাধানে কাজ করার জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নেতৃত্বের প্রশংসা করেন। তিনি চীনকে অত্যন্ত কাছের, খুব বিশ্বাসযোগ্য এক বন্ধু দেশ বলে উল্লেখ করে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। আর বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতিতে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

আলোচনার সঙ্গে পরিচিত একজন পাকিস্তানি সূত্র সিএনএনকে বলেছেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশেষ করে রুবিও এই চুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি জানান, উভয় পক্ষই যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। তিনি জানান, দুই দেশের সামরিক অভিযানবিষয়ক মহাপরিচালক ১২ মে আলোচনা করবেন। আর ইশাক দার জানিয়েছেন, দুই দেশের মধ্যকার সামরিক ও হটলাইন চ্যানেল চালু করা হয়েছে।

মধ্যস্থতা নিয়ে ভিন্নমতের বিষয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত নিজেকে একটি উঠতি পরাশক্তি হিসেবে মনে করে। দেশটি দীর্ঘদিন ধরেই আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। অন্যদিকে বিশ্লেষকরা বলছেন যে, বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল পাকিস্তান এটিকে স্বাগত জানায়।

ওয়াশিংটন ডিসির একটি থিংক ট্যাংক হাডসন ইনস্টিটিউটের ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার গবেষণা ফেলো ড. অপর্ণা পান্ডা বলেন, ‘ভারত কখনো কোনো বিরোধে মধ্যস্থতা গ্রহণ করেনি, তা সে ভারত-পাকিস্তান হোক বা ভারত-চীন হোক, অথবা অন্য কোনো বিরোধ হোক।’ তিনি আরো বলেন, অন্যদিকে পাকিস্তান সর্বদা আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার চেষ্টা করেছে, তাই তারা এর প্রশংসা করবে। কারণ কাশ্মীর বিরোধ নিয়ে আলোচনা এবং সমাধানের জন্য এটিই ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করার একমাত্র উপায়।

যুদ্ধবিরতি ঘোষণার মাত্র দুই দিন আগে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ফক্স নিউজকে বলেছিলেন, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে আমেরিকা হস্তক্ষেপ করবে না। কারণ, এখানে আমেরিকার কোনো স্বার্থ নেই। কিন্তু এরপরই কেন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যস্থতায় জড়িয়ে পড়ল? এ বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শুক্রবার প্রশাসন এই সংঘাত নিয়ে খুবই ভয়াবহ তথ্য পায়। এরপরই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেয় যে, যুদ্ধ বন্ধে মধ্যস্থতা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।

যুদ্ধবিরতি কি স্থায়ী হবে?

দুই দেশ যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে। কিন্তু এর দুই ঘণ্টা পরই ভারতশাসিত কাশ্মীরে বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের কারণ তাৎক্ষণিকভাবে জানা না গেলেও বিভিন্ন শহরে ব্ল‍্যাকআউটের ঘটনা ঘটে। এরপর পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরেও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি যুদ্ধবিরতি লংঘনের জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেন। তবে পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার সেই অভিযোগ অস্বীকার করেন। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে যে, নিরপেক্ষ কোনো দেশে দুই দেশ আলোচনায় বসবে। কিন্তু ভারতের তথ্য মন্ত্রণালয় জানায়, পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের আর কোনো আলোচনায় বসারও সিদ্ধান্ত হয়নি।

লন্ডনের এসওএএস (সোয়াস) বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়ান ইনস্টিটিউটের পরিচালক সুবীর সিনহা আলজাজিরাকে বলেন, বৃহত্তর দ্বিপাক্ষিক আলোচনা একটি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং প্রক্রিয়া হবে। কারণ ভারত পূর্বে এই ধরনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল। সিনহা বলেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকারের পাকিস্তানের প্রতি এই তথাকথিত কঠোর নীতির একটি যুক্তি ছিল যে, সমস্যা সমাধানের জন্য একটি বিস্তৃত এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতি নিয়ে আলোচনা করা আর সম্ভব নয়।’ তার মতে, এটি ভারত সরকারের অবস্থানের বিপরীতে পরিণত হবে। কারণ ভারতের ডানপন্থিরা এটা মানবে না। তাদের সদস্যরা পাকিস্তানের ওপর আক্রমণের আহ্বান জানিয়ে আসছে।

সিনহা বলেন, সিন্ধু পানি বণ্টন চুক্তি স্থগিত করেছে ভারত। আর সিমলা চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পাকিস্তান। ভারতের সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি হলেও সিন্ধু পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে না ভারত। আবার কাশ্মীর নিয়ে দুই দেশের সমস্যা দীর্ঘদিনের। সহসাই এর সমাধান হওয়ার আশাও কেউ দেখছেন না।

Related Articles

Back to top button