এবার মঙ্গল শোভাযাত্রায় থাকবে ফ্যাসিস্টের দৈত্যাকৃতির প্রতিকৃতি

থাকবে বাঘ ইলিশ পায়রার প্রতিকৃতির পাশাপাশি নানা আকৃতির মুখোশ, চারুকলায় ব্যস্ত শিল্পীরা

অনলাইন ডেস্ক: বিকালের সূর্য তখন হেলে পড়েছে। চারুকলা প্রাঙ্গণে পা রাখতেই একটু হোঁচট খেতে হলো। দেখা গেল, মাত্র দুয়েক জন তরুণ শিল্পী আঁকাআঁকিতে ব্যস্ত। সাধারণত চৈত্রের ২৩তম দিনে এ সময়ে জমজমাট থাকে চারুকলা প্রাঙ্গণ। নববর্ষ উদ্যাপনের সবচেয়ে বড় আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়ে দিনরাত ব্যস্ত থাকে সবাই। তাই চৈত্রের শেষপ্রান্তে এসেও চারুকলায় নীরবতা দেখে খটকা লাগল। অবশ্য বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যার আলোছায়ায় জয়নুল গ্যালারি পেরিয়ে সামনে এগুতেই দেখা গেল চিরচেনা সেই দৃশ্য। ধীরে ধীরে সেই উপস্থিতি বেড়ে চতুর্গুণ হলো। দেখা গেল বেশকিছু মোটিফ বা অবকাঠামো দৃশ্যমান। দেখা গেল, হাতুড়ি বাটালের ঠোকাঠুকি। আমগাছের নিচে বিশাল আকৃতির ইলিশের ওপর খবরের কাগজের প্রলেপ দিয়ে অবয়ব দেওয়া হচ্ছে, এর পাশেই চার বেহাড়ার পালকি, আরেকটু এগুতেই তেঁতুলতলায় দেখা গেল দাঁতাল মুখের এক নারীর মুখাবয়ব, মাথায় খাড়া চারটি শিং, হা করা বিকৃত মুখ, বিশাল আকৃতির নাক, ভয়ার্ত দুটো চোখ। এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রধান এই প্রতিকৃতিটি ফ্যাসিবাদের বীভত্স রূপ হিসেবে নির্মিত হয়েছে। পাশেই দেখা গেল ক্ষিপ্রতার প্রতীক হিসেবে বাঘের প্রতিকৃতি। তারই পাশে শান্তির প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে পায়রা। এবারের পহেলা বৈশাখ ১৪৩২ বাংলা নববর্ষকে এসব প্রতিকৃতির মধ্য দিয়ে স্বাগত জানাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ।

গতকাল রবিবার সরেজমিনে চারুকলা অনুষদ ঘুরে দেখা গেছে, প্রধানতম অবকাঠামোর নির্মাণকাজ প্রায় ৭০ শতাংশই শেষ। প্রথম বর্ষের ছাত্র থেকে শুরু করে ৪০ বছর বয়সি প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও শিল্পীর তত্ত্বাবধানে চলছে মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রধান মোটিফ বা অবকাঠামো নির্মাণের কাজ। তবে জয়নুল গ্যালারির সামনে শিল্পকর্ম নির্মাণ ও বেচাকেনা ঘিরে প্রতি বছর যে প্রাণবন্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবার তার দেখা মেলেনি। কারণ হিসেবে প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা জানান, ঈদের পরে গতকালই তারা কর্মযজ্ঞ শুরু করেছেন।

শিল্পী ও কারিগররা জানালেন, তারা আশা করছেন, যথাসময়েই কাজ শেষ হবে। ত্রিমাত্রিক অবকাঠামো নির্মাণের দায়িত্বে থাকা ভাস্কর্য বিভাগের একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী দীপক রঞ্জন সরকার জানান, ফ্যাসিস্টের দৈত্যাকৃতির প্রতিকৃতির উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট, ৩৬ জুলাই ত্রিমাত্রিক প্রতিকৃতির দৈঘ্য ১০০ ফুট লম্বা। ইলিশ মাছ, বাংলার বাঘ ও পায়রার উচ্চতা হবে ১৬ ফুট। পাশাপাশি জুলাই আন্দোলনের ওপর ভিত্তি করে প্রতিকী রূপ দেওয়া হবে বিভিন্ন মোটিফে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ইসরাফিল রতন ইত্তেফাককে বলেন, এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’। এই প্রতিপাদ্যে চব্বিশের চেতনা ধারণ করে সমকাল, ইতিহাস, ঐতিহ্যকে মাথায় রেখে এবারের পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে। উল্লিখিত চারটি মোটিফের বাইরে মীর মুগ্ধের স্মৃতি স্মরণ করে একটি পানির বোতল তৈরি করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। তবে তাতে মীর মুগ্ধের প্রতিকৃতি রাখা হবে না।

তিনি বলেন, অন্যান্য বছর শিল্পীদের অনেকে আসতেন আবার আসতেনও না। এবার চেষ্টা করছি সবাইকে কীভাবে যুক্ত করা যায়। সব শ্রেণি-পেশার মানুষ তো আছেই, শিল্পীদেরও যুক্ত করা হচ্ছে। কারণ এটা একটা সর্বজনীন উত্সব।

তিনি জানান, এবারের শোভাযাত্রায় বড় মোটিফ হবে ৬টি, মাঝারি মোটিফ ৫৫টি, ছোট মোটিফ ৪২৬টি, শোভাযাত্রার মুকুট ৫০০০টিসহ, থাকছে পাখা, সুলতানি আমলের মোগল মিনিয়েচারভিত্তিক মুখোশ, হাতি, বাঘ, পেঁচাসহ পশুপাখির মুখোশ থাকবে।

এছাড়া শোভাযাত্রায় ঐতিহ্যবাহি পিস্টনবাঁশি’, বাংলা ঢোল, ও করোনেট বাঁশি সহযোগে ত্রিশ শিল্পীর সম্মিলিত বিন্যাসে দেশাত্মবোধক গান গাওয়া হবে। আর এসব কর্মযজ্ঞের সঙ্গে যুক্ত থাকছে প্রায় ছয় শতাধিক মানুষ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক এ বি এম শহীদুল ইসলাম ইত্তেফাককে জানান, প্রতি বছরের মতো এবারও সরাচিত্র, জলরংসহ বিভিন্ন মাধ্যমে আঁকা শিল্পকর্ম বিক্রি থেকে পাওয়া অর্থ দিয়েই নববর্ষ উদ্যাপনের এ আয়োজন করছে চারুকলা অনুষদ। তিনি জানান, রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী শখের হাঁড়ির নকশা দিয়ে সাজিয়ে তোলা হবে চারুকলা অনুষদের সীমানাপ্রাচীর। লোকশিল্পের মোটিফ ফুল-পাখি-লতাপাতা দিয়ে নান্দনিক করে তোলা হবে দেওয়াল। গতকাল সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, এরই মধ্যে বহিরাঙ্গের দেওয়ালে হলুদ রংয়ের প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। এর ওপর লোকশিল্পের নানা মোটিফ ফুটিয়ে তুলবেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। চারুকলার বকুলতলায় বাংলা বছরের শেষ দিন চৈত্রসংক্রান্তির অনুষ্ঠান থাকবে বলেও নিশ্চিত করেছেন তিনি। বিকাল ৪টা থেকে নাচ-গানের এ আয়োজন চলবে রাত ১০টা পর্যন্ত।

জাতীয় পহেলা বৈশাখ

Related Articles

Back to top button