বিহার নির্বাচন ঘিরে ছড়াচ্ছে এআই-নির্মিত ভুয়া ছবি-ভিডিও

অনলাইন ডেস্ক: ভারতের বিহার নির্বাচনের মুখে অনলাইনে বিভ্রান্তিকর প্রচার নিয়ে চিন্তায় দেশটির নির্বাচন কমিশন। এআই নির্মিত আপত্তিকর কনটেন্ট বাগে আনতে সতর্কবার্তা জারি করা হয়েছে।
শুধু মিটিং-মিছিল নয়, সোশ্যাল মিডিয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রচারের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এর মাধ্যমে অনেক সময়ে ভুয়া তথ্য তুলে ধরা হয়। বিভ্রান্তিকর প্রচার চালানো হয়। সেসব রুখতে চাইছে নির্বাচন কমিশন।
সোশ্যাল মিডিয়ায় কুৎসা
নির্বাচন মানে শুধুই দেয়াল লিখন নয়, সোশ্যাল মিডিয়ার ওয়াল প্রচারের বড় জায়গা হয়ে উঠেছে। প্রচারমূলক বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য লেখার পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে নেতা ও নেত্রীদের ব্যঙ্গাত্মক ছবি প্রকাশ করা হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলে ধরা হয় এমন অনেক ছবি যা ফটোশপ করে বানানো।
এই ভুয়া ছবিকে ব্যবহার করে অনেক সময় নেতাদের চরিত্রহানি করা হয়। তাদের সম্পর্কে মিথ্যে কথা প্রচার করা হয়। রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য বিভিন্ন দলের সমর্থকরা এই কাজ করেন। এ নিয়ে গত কয়েকটি নির্বাচনে কমিশনের কাছে অজস্র অভিযোগ জমা পড়েছিল।
এই সমস্যা বাড়িয়ে তুলেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই)। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভুয়া প্রচারকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সময় দেখা যাচ্ছে, একেবারে কাল্পনিক কোনো উপস্থাপনা রাজনৈতিক স্বার্থে সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলে ধরা হচ্ছে, যার কোনো ভিত্তি নেই। অথচ লক্ষ-কোটি মানুষের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে।
সতর্কাবস্থায় নির্বাচন কমিশন
আগামী নভেম্বরে বিহার বিধানসভা নির্বাচন। একইসঙ্গে ছটি বিধানসভার উপনির্বাচন হবে অন্য রাজ্যে। এরপরে আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভার ভোট হতে চলেছে। এসবের আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়ো প্রচার নিয়ে বিশেষ সতর্কতা নিচ্ছে কমিশন।
সূত্রের খবর, নির্বাচনের প্রচারে এআই ব্যবহার করে ভুয়া তথ্য, জাল ছবি ছড়ালে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। ডিপ ফেক ব্যবহার করে তৈরি ভিডিও সম্পর্কে সজাগ থাকতে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। নির্বাচনী প্রচারে এআই ব্যবহার করা হলে, সেটা স্পষ্ট করে ঘোষণা করতে হবে। অর্থাৎ এআই জেনারেটেড বা ডিজিটালি এনহ্যান্সড কোনো কনটেন্ট সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করা হলে জানাতে হবে, এটা কীভাবে তৈরি হয়েছে।
যদি এই ধরনের প্রচার চালানো হয় এবং তা হয় কুৎসামূলক, সেক্ষেত্রে আদর্শ আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগ আনা হবে সংশ্লিষ্ট প্রার্থী ও রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে আসা অভিযোগের উপরেই শুধু নির্ভর করবে না কমিশন, তাদের নিজস্ব নজরদারি ব্যবস্থা চালু থাকবে।
প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই এখন ইনফরমেশন টেকনোলজি (আইটি) সেল তৈরি হয়েছে। এই সেল-এর কাজই হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায় দলের প্রচার পরিচালনা করা। এছাড়াও রয়েছেন দলের সমর্থক ও কর্মীরা, যারা ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট থেকে এ ধরনের কন্টেন্ট তুলে ধরেন।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্মিত ভিডিও অজস্র নমুনা
বিহার নির্বাচন উপলক্ষে একটি এআই নির্মিত ভিডিও ঘিরে বিতর্ক হয়েছে। এক্স হ্যান্ডেলে একটি ছোট ভিডিও পোস্ট করে বিহার কংগ্রেস। একেবারে কাল্পনিক চিত্রনাট্যের উপরে তৈরি এই ভিডিওর শুরুতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বলতে শোনা যায়, আজকের মতো ভোটচুরির কাজ শেষ হয়েছে। এবার শুতে যাই।
এরপরে দেখা যায় ঘুমোতে যাচ্ছেন মোদি এবং সেই ঘুমে তার স্বপ্নে হাজির হচ্ছেন তার মা হীরাবেন। তিনি নোটবন্দি থেকে ভোট চুরি, একাধিক বিষয় তার পুত্রকে ভর্ৎসনা করছেন। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর ‘ডিপ ফেক’ ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়া ঘুরে বেড়িয়েছে, যেখানে তাকে গরবা নাচতে দেখা গিয়েছে।
এই ধরনের ভিডিও ব্যঙ্গাত্মক হলেও সম্পূর্ণ কাল্পনিক ও বিভ্রান্তিকর হওয়ায় এ ব্যাপারে আপত্তি রয়েছে নির্বাচন কমিশনের। সূত্রের খবর, এগুলির প্রচার কঠোরভাবে রোখা হবে আগামী নির্বাচনে।
প্রধানমন্ত্রী যখন এমন কটাক্ষের মুখে, তখন অন্য নেতারা রেহাই পাবেন কেন। নরেন্দ্র মোদি ও তার মা-কে নিয়ে তৈরি ভিডিও দেখেই বোঝা গিয়েছিল, এটা কাল্পনিক ও ব্যঙ্গাত্মক প্রচার। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তথ্য এমন ভাবে বিকৃত করা হচ্ছে যা বোঝার উপায় থাকছে না সাধারণ মানুষের।
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন সম্প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছিলেন, এআই ব্যবহার করে তার ভুয়া ভিডিও তৈরি হচ্ছে। সেটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হচ্ছে, মানুষের মোবাইলে ঘুরছে। অনেক ক্ষেত্রে এর মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বিকৃত করে প্রচার করা হচ্ছে।
কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে মধ্যপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের আগে একটা ভুয়া ভিডিও ছড়ানো হয়েছিল। সেই ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, রাহুল নিজের দলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। তার দলই দুর্নীতির মূলে, এমনটা বলছেন। এর বিরুদ্ধে কমিশনের কাছে অভিযোগ দায়ের হয়েছিল।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যঙ্গাত্মক ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছিল। দেশের এমন কোনো শীর্ষ নেতা নেই বললেই চলে, যাকে নিয়ে এমন ভিডিও তৈরি হয়নি।
সম্প্রতি কংগ্রেসের পোস্ট করা একটি ভিডিওকে ভুয়া তকমা দিয়েছে খোদ নির্বাচন কমিশন। বিহারে ভোটার তালিকার নিবিড় সমীক্ষা নিয়ে একটি ভিডিও গত আগস্টে এক্স হ্যান্ডেলে দিয়েছিল কংগ্রেস। তারা ভোট চুরির অভিযোগ এনেছিল। সেখানে ব্যবহৃত বক্তব্য এআই নির্মিত বলে রাহুলের দলের সমালোচনা করেছে কমিশন।
নিয়ন্ত্রণ কি আদৌ সম্ভব?
ভারতের নির্বাচন কমিশন অতীতেও সোশ্যাল মিডিয়ার ভুয়া কন্টেন্টের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল। কিন্তু ক্রমশ উন্নত হতে থাকা তথ্যপ্রযুক্তির যুগে কি আদৌ সোশ্যাল মিডিয়ার উপরে নিয়ন্ত্রণ জারি করা সম্ভব?
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তির অধ্যাপক মুনমুন ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেন,একটা ভিডিও তৈরির পর সোশ্যাল মিডিয়ায় দিলেই সেটা ছড়িয়ে পড়ে। সেই ভিডিওটা ভুয়া নাকি আসল, সেটা সবার আগে যাচাই করতে পারে একমাত্র সোশ্যাল মিডিয়া। একমাত্র ডেটা চেক করে বলা সম্ভব যে এটা প্রকৃত ক্যামেরার ডেটা, নাকি কোনো সফটওয়্যার ব্যবহার করে করা হয়েছে। ভিডিওর ফাইল যখন তৈরি হয় তখন তাতে সমস্ত কিছু লেখা থাকে। তাই জাল ভিডিও যাচাই করে দেখার দায়িত্বটা নির্বাচন কমিশনের আগে সোশ্যাল মিডিয়ার নেওয়া উচিত।
তিনি বলেন, সরকারের উচিত সোশ্যাল মিডিয়ায় যুক্ত পেশাদারদের সঙ্গে কথা বলা। যাতে ভিডিও ছড়িয়ে যাওয়ার আগে তা শনাক্ত করা যায়। ধরুন, এখন কোনো ভিডিও যা সমস্যা তৈরি করতে পারে, সেটা ফেসবুক তার নিজস্ব এআই টেকনোলজি ব্যবহার করে বন্ধ করে দিতে পারে। ঠিক একইভাবে যে যে ধরনের কনটেন্ট নির্বাচন কমিশন চাইছে না, সবার প্রথমে যখন সেটা আপলোড হচ্ছে, তখন সেটাকে ব্লক করার ব্যবস্থা করতে হবে। এই ভিডিও একবার ছড়িয়ে যাওয়ার পর যখন সাধারণ ব্যবহারকারী সেটা পাচ্ছেন, তার পক্ষে কোনোভাবে বোঝা সম্ভব নয় যে ফাইলটা আসল না জাল। যদি তিনি এক্সপার্ট হোন, তবে সেটা সম্ভব।
সাইবার অপরাধ বিশেষজ্ঞ সন্দীপ সেনগুপ্ত ডিডাব্লিউকে বলেন, যারা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করছেন, এ ধরনের ভিডিও দেখছেন, তারাই এ সম্পর্কে রিপোর্ট করবেন। এন্ড ইউজারদের রিপোর্টের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। তখন দেখা হবে, কোন আইপি অ্যাড্রেস থেকে, কোন সার্ভার থেকে এটা প্রথম পাবলিশ করা হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই অনুযায়ী ট্র্যাক করা হবে।
চাবিকাঠি যাদের হাতে
তবে এক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। মুনমুন বলেন, ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপের সঙ্গে কথা বলতে হবে এবং জানাতে হবে বিষয়টা। যখন কেউ একটা ভিডিও প্রথম আপলোড করছেন, তখন চেক করা উচিত যে সেটা এআই সফটওয়্যার দিয়ে বানানো নাকি আসল। এরাই প্রথমে ফ্যাক্ট চেক করতে পারবেন। নির্বাচন কমিশন টিম বানিয়ে কিছু করার আগে এটা প্রথমে করতে হবে। ভিডিও ছড়ানোর আগে যদি বন্ধ করা যায়, সেটা সবচেয়ে ভালো হবে।
সন্দীপ বলেন, এ ধরনের ভিডিও যেখানে প্রকাশিত হয়েছে, তার রিপোর্ট পেলে নির্বাচন কমিশন বা অন্য কোনো সংস্থা বিষয়টা সংশ্লিষ্ট প্লাটফর্মে জানাতে পারে। যেমন মেটাকে ফেক ভিডিও সংক্রান্ত অভিযোগ ফরওয়ার্ড করতে পারে। সেটা খতিয়ে দেখে ওই সংস্থা কোনো পদক্ষেপ নিতেও পারে।
অভিযোগ জমা পড়ার পরে ব্যবস্থা নেওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে ভুয়া ভিডিওর উদ্দেশ্য সাধিত হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে নির্বাচনের আগে এমন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভিডিও প্রচার কীভাবে আটকানো যেতে পারে?
মুনমুন বলেন, সবার আগে চিহ্নিত করতে হবে কারা এই ভিডিও ছড়াতে পারেন। এটা একেবারে সাধারণ মানুষের কাজ নয়। এই উদ্দেশ্যমূলক ভিডিও কোনো সংস্থা বা দলকে টাকা দিয়ে বানাতে হয়। পার্টির শীর্ষস্থানীয় মানুষেরা অথবা এ ব্যাপারে যাদের ইন্টারেস্ট আছে, তারা এ ব্যাপারে যুক্ত থাকতে পারেন। তাই নির্বাচন কমিশনকে এই নিয়ম টা চালু করতে হবে, যাদের পক্ষে এই ভিডিও ছড়ানো হচ্ছে, তাদের চিহ্নিত করতে হবে।