দক্ষিণ কোরিয়ায় ‘একগুঁয়ে’ প্রেসিডেন্টের বিদায়

অনলাইন ডেস্ক: দক্ষিণ কোরিয়ার সাংবিধানিক আদালত রায় দিয়েছে যে, ইউন সুক ইওল গত ডিসেম্বরে সামরিক আইন জারির ঘোষণা দিয়ে তার ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। এজন্য তাকে স্থায়ীভাবে দায়িত্ব থেকে অপসারণ করা হলো। দক্ষিণ কোরিয়া সব সময় একটি শান্তিপূর্ণ এবং গর্বিত গণতন্ত্র চর্চা করে আসছে। এই দেশটির কোথাও কখনো সামরিক দখলদারিত্ব হতে পারে, এমনটা কেউ আশাও করেনি। এ কারণে, যখন প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইণ্ডল সামরিক আইন জারির ঘোষণা দেন, তার সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের আদেশ দেন, তখন গোটা দেশ ও বিশ্বের সবাই স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। বিক্ষোভের মুখে মাত্র ছয় ঘণ্টার মধ্যে তিনি আদেশটি বাতিল করতে বাধ্য হন।
দক্ষিণ কোরিয়ার এই প্রেসিডেন্টের সবচেয়ে কাছের কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি। যাতে বোঝা যায় যে, কী কারণে একসময়কার সফল এবং নীতিবান প্রসিকিউটর (আইনপ্রণেতা), যিনি সঠিক এবং ভুলের পার্থক্য করার জন্য পরিচিত ছিলেন, তিনি কেন স্বৈরশাসন শুরু করতে বাধ্য হলেন। যে সিদ্ধান্ত তার দেশকে বিপথগামী করতে পারত, তার আন্তর্জাতিক খ্যাতি নষ্ট করতে পারত এবং তার ক্যারিয়ার ধ্বংস করতে পারত।
ছোটবেলা থেকে, ইউন ‘জয়ের ব্যাপারে মরিয়া ছিল’, তার সবচেয়ে পুরোনো বন্ধু, চুলউ লি সামরিক আইন ঘোষণার পরবর্তী সপ্তাহগুলোয় বিবিসিকে এ কথা বলেন। তিনি জানান, ইউন একবার কোনো সিদ্ধান্ত নিলে, সেটা বাস্তবায়ন করতে একরোখা থাকত। তার ন্যায়ের প্রতি শক্ত বিশ্বাস ছিল। একজন রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর হিসেবে, ইউন নিজের খ্যাতি গড়ে তোলেন একজন বিস্ফোরক চরিত্র হিসেবে। যিনি সঠিক এবং ভুলের সহজাত বোধকে কঠোরভাবে মেনে চলতেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে ইউনের তদন্তগুলো অযথাই আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। ইউন ২০১৩ সালে তিনি তার বসের নির্দেশ অমান্য করে গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত করেন। লির মতে, জনগণ ইউনকে সাহসী মনে করত, কারণ তিনি রাজনৈতিক চাপ উপেক্ষা করতে পেরেছিলেন। যখন তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার অভিশংসিত রক্ষণশীল প্রেসিডেন্ট পার্ক গিউন-হো এর বিচার করে তাকে কারাবন্দি করেন, তখন তিনি বামপন্থিদের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠেন। এ কারণে, তাকে বামপন্থি সরকারে প্রধান প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু, তিনি সুসম্পর্ক তৈরির বদলে, সরকারের এক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেন। ইউনের দৃঢ়, পক্ষপাতহীন মনোভাব তাকে অনেক জনসমর্থন এনে দেয়।
গত ডিসেম্বরে সামরিক আইন ঘোষণার পরপরই ইউনের প্রচারণা কৌসুলি কিম কুন-সিক বিবিসির কাছে বলেন, খুব আফসোস হয় যে, আমি তাকে আমাদের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছি। কিম কুন-সিক প্রথমে ইউনের আইনের প্রতি নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন, কিন্তু পরে তিনি দ্রুত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। কুন-সিক বলেন, তিনি আমাদের কোনো পরামর্শ শুনতেন না। শুধু নিজের ইচ্ছামতো কাজ করতেন। তিনি ছিলেন ভীষণ জেদি। তিনি গোপনে গোপনে আকস্মিক সিদ্ধান্ত নিতেন, যে বন্ধুদের সঙ্গে তিনি মদ্যপান করতেন, তাদের কাছ থেকে পরামর্শ নিতেন। আমরা জানতাম, তিনি একজন ঝুঁকিপূর্ণ মানুষ, কিন্তু আমরা ভেবেছি যে, তিনি আমাদের প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দিতে পারবেন। দল থেকে সমর্থন পাওয়ার পর, ইউনের রাজনীতি দ্রুত ডানপন্থার দিকে সরে যায়। ইউন বিরোধী দলের প্রতি চরম শত্রুভাবাপন্ন হয়ে ওঠেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে, বিরোধীদের উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক আছে।
ইউনের বন্ধু শিন (ছদ্মনাম) বলেন, ইউন পার্লামেন্টে ক্ষমতাধর বিরোধী দলের সঙ্গে সংঘাতের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন, যারা পার্লামেন্ট নিয়ন্ত্রণ করত। তিনি বিরোধীদের সঙ্গে মতভেদ দূর করতে সম্মত ছিলেন না। তিনি বিরোধী দলের নেতা, লি জে-মিয়াংকে একজন অপরাধী হিসেবে দেখতেন। তার স্ত্রী বিলাসবহুল উপহার গ্রহণ করায় সাধারণ মানুষ বিরক্ত ছিল। কিন্তু তিনি এজন্য ক্ষমা চাইতে অস্বীকার করেন। মানুষ তার সম্পর্কে কী ভাবছে; তারা কি মনে করে যে, তিনি ভালো কাজ করছেন কি না-এসব বিষয়কে তিনি খুব একটা পাত্তা দিতেন না। তার মেয়াদে তার পার্টি পার্লামেন্টারি নির্বাচনে এক কঠিন পরাজয়ের শিকার হয়। তবে ইউন তার পার্টির নির্বাচনি পরাজয় নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত ছিলেন না।
তিনি বিশ্বাস করতেন যে, বিরোধী দল উত্তর কোরিয়া থেকে নির্দেশনা নিত, সেই সঙ্গে যারা উত্তর কোরিয়া শাসনব্যবস্থা ধারণ করতেন, তারা ঐ নির্দেশ মতো চলত, যদিও তিনি কখনো এর কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি। তিনি ভাবতেন যে, যদি তারা ক্ষমতায় আসে, তারা দক্ষিণ কোরিয়াকে একটি কর্তৃত্ববাদী কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত করবে এবং দেশটিকে দেউলিয়া করে ফেলবে। বিরোধী দল যত শক্তিশালী হতে থাকে, ইউন ততই একগুঁয়ে হয়ে ওঠেন, তার প্রেসিডেন্সিয়াল ভেটো ব্যবহার করে পার্লামেন্টের সিদ্ধান্তগুলোকে আটকাতে থাকেন। তিনি এক বন্ধুকে বলেছিলেন, তারা আমাকে নামাতে, সরকারের পতন ঘটাতে এবং আমাদের গণতন্ত্র শেষ করতে চাইছে। আমরা এটা মেনে নিতে পারি না। গত ৩ ডিসেম্বর, অবশেষে তিনি সহ্য করতে না পেরে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারান।
তিনি সামরিক আইনকে বিরোধী দলকে শাস্তি দেওয়ার একটি পদ্ধতি হিসেবে দেখেছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, কারো তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো উচিত। যতই ভুল হোক, ইউন সেটাই করতেন যা তিনি সঠিক বলে মনে করতেন, এর পরিণতি কী হতে পারে সেটা খুব কমই ভাবতেন।
বিশ্ব সংবাদ দক্ষিণ কোরিয়া প্রেসিডেন্ট