বারবার কেন ডোবে চট্টগ্রাম

১৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প, তবু মিলছে না কাঙ্ক্ষিত সুফল
অনলাইন ডেস্ক: চট্টগ্রামে বৃষ্টি মানেই আতঙ্ক। আকাশে মেঘ জমলেই নগরবাসীর মনে জেগে ওঠে এক অজানা শঙ্কা—আজ আবার ডুববে না তো! প্রতিনিয়ত বৃষ্টির তোড় বাড়লেই পানিতে ডুবে যায় এই নগরী। প্রধান প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলি পর্যন্ত ডুবে যায়, কোথাও হাঁটু পানি, আবার কোথাও কোথাও কোমর সমান পানিতে। অচল হয়ে পড়ে গাড়ির চাকা। বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে ব্যবসা-বাণিজ্য। শিক্ষার্থী ও অফিসগামী মানুষের ভোগান্তি যেন নিত্যদিনের চিত্র। গত পাঁচ বছরে জলাবদ্ধতায় খাল-নালায় পড়ে ১৫ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। পানিতে বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হয়ে এ বছরই মৃত্যু হয়েছে তিন জনের।
অথচ প্রায় ৭০ লাখ জনসংখ্যার এই বাণিজ্যিক নগরীতে জলাবদ্ধতা নিরসনে বিগত বছরগুলোতে নেওয়া হয়েছে একাধিক মেগা প্রকল্প। বর্তমানে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) মেগা প্রকল্পসহ চারটি প্রকল্পের কাজ চলছে চট্টগ্রামে। এগুলোর মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকা। প্রকল্পগুলোর বেশির ভাগ অংশের কাজ শেষ হয়েছে বলে দাবি করা হলেও মিলছে না এর সুফল।
২০১৭ সালে সিডিএ হাতে নেয় ৩৬টি খাল নিয়ে বৃহত্ একটি প্রকল্প। যার ব্যয় একসময় ছিল ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা, এখন তা গিয়ে ঠেকেছে ৮ হাজার ৬২৬ কোটিতে। প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষের দিকে। কিছুটা অগ্রগতি চোখে পড়ছে অনেক জায়গায়। এবারের বর্ষায় শহরের কিছু জায়গায় পানি জমলেও দ্রুত নেমে গেছে। তবে এখনো হিজড়া খালের মতো গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি স্থানে জমি অধিগ্রহণ ও সংস্কারকাজ পিছিয়ে থাকায় নগরবাসী পুরোপুরি স্বস্তিতে নেই। জলাবদ্ধতায় প্রাণহানি, বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু স্পষ্ট বার্তা দেয় যে এই সংকট এখনো পুরোপুরি কাটেনি।
জানা গেছে, সিডিএর মেগা প্রকল্পের আওতায় রয়েছে ১৭৬ কিলোমিটার প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণ, ৪৫টি সেতু, ছয়টি কালভার্ট, ৪২টি সিল্ট ট্র্যাপ, পাঁচটি রেগুলেটর নির্মাণ, ১০ দশমিক ৭৭ কিলোমিটর নতুন নালা, ৮৫ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার খালের পাশে সড়ক নির্মাণ ও ১৫ দশমিক ৫০ কিলোমিটার নালা সম্প্রসারণ। প্রকল্পটির পূর্ত কাজ করছে সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কন্সট্রাকশন ব্রিগেড।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পের অগ্রগতি এখন পর্যন্ত ৯০ শতাংশ। ৩৬টি খালের মধ্যে ২৫টি খালের কাজ শতভাগ শেষ। বাকিগুলোর মধ্যে ছয়টি খালের কাজ ৯০ শতাংশের বেশি শেষ হয়েছে। আর পাঁচটি খালের কাজ ৯০ শতাংশের নিচে। ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতার কারণে হিজড়া খালের কার্যক্রমে ধীরগতি দেখা দিয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড-পাউবোর অধীনে চলমান ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলমগ্নতা/জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন’ নামের প্রকল্পটির খরচ ধরা হয়েছে ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। এ প্রকল্পে বিভিন্ন খালের সঙ্গে যুক্ত ২৩টি স্লুইসগেট থাকছে। কর্ণফুলী নদীর তীরে বাঁধসহ রাস্তা নির্মাণে ২ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকার অন্য একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সিডিএ। এতে খালের মুখে ১২টি স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয়েছে ইতিমধ্যে। এর মধ্যে আছে চাক্তাই ও রাজাখালীর মতো গুরুত্বপূর্ণ দুটি খাল। এছাড়া বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত দুই দশমিক নয় কিলোমিটার দীর্ঘ বাড়ইপাড়া খাল খননে ব্যয় হচ্ছে ১৩৭৪ কোটি টাকা। এই খালটির কাজ ৯৫ শতাংশ শেষ হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনায় আশার আলো :প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ৯ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সভায় চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তাত্ক্ষণিক নির্দেশ প্রদান করেন এবং জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করতে চার উপদেষ্টাকে (সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, ফারুক ই আজম বীর প্রতীক এবং আদিলুর রহমান খান) বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ১৮ জানুয়ারি তিন উপদেষ্টা চট্টগ্রাম সফর করে সরেজমিন মাঠ পর্যবেক্ষণ করেন এবং ১৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আগামী চার মাসের মধ্যে জলাবদ্ধতা সমস্যার দৃশ্যমান অগ্রগতির লক্ষ্যে এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করেন।
বৈঠকে বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা চার মাসের কর্মপরিকল্পনা উপস্থাপন করেন। কর্মপরিকল্পনার ওপর আলোচনা শেষে কিছু সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর মধ্যে রয়েছে, পাহাড় কাটা বন্ধে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ অবিলম্বে ব্যবস্থা নেবে, এসব এলাকায় বিদ্যুত্ ও ওয়াসার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে। পলিথিন ও পিইটি বোতলের ব্যবহার সীমিত করে এগুলো রিসাইক্লিংয়ের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পক্ষে সেনাবাহিনী কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোর কাজ দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করতে হবে, যাতে আগামী বর্ষার আগে নগরবাসী এর সুফল পেতে পারে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের স্লুইসগেটগুলোর অপ্রশস্ততা ও স্থাপিত পাম্পগুলোর কম ক্ষমতা বিষয়ে আলোচনা হয়। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জলাবদ্ধতা নিরসনের কথা মাথায় রেখে মেইনটেন্যান্স ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা জোরদার করবে, যাতে বৃষ্টির পানি দ্রুত নেমে যায়। পানিপ্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী কালভার্টগুলোর উচ্চতা বাড়ানো হবে এবং ওয়াসা ও অন্যান্য ইউটিলিটির লাইন সরিয়ে নেওয়া হবে। সংস্থাগুলোকে বলা হয়েছে, কর্তব্য পালনে ব্যর্থ ব্যক্তি বা সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং বর্তমান কার্যক্রমের সাফল্যের ভিত্তিতে চলমান প্রকল্পগুলোর ভবিষ্যত্ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
কর্ম পরিকল্পনায় নালা ও খালের অবৈধ দখলদারদের দায়ের করা বিচারাধীন বিভিন্ন মামলার নিষ্পত্তি বিষয়ে সহায়তা কামনা করা হয়। এছাড়া যত্রতত্র ময়লা ফেলা থেকে নাগরিকদের বিরত রাখতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার জন্য চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে প্রয়োজনীয়সংখ্যক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পদস্থ করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়। এছাড়া চট্টগ্রাম শহরের প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি ড্রেনগুলো পরিষ্কার করা ও শহরবাসী যাতে নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা ফেলে, সেজন্য শ্রেণিভিত্তিক বর্জ্য আলাদা করে সংগ্রহ করে তা ডাম্পিংয়ের ব্যবস্থা করার জন্য থোক বরাদ্দ প্রদানের ও একটি সমন্বয় কমিটি গঠনের জন্য অনুরোধ জানানো হয়। বৈঠকে উপদেষ্টারা সরকারের পক্ষ থেকে মামলার নিষ্পত্তি, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয়সংখ্যক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পদস্থ করা, সমন্বয় কমিটি গঠন ও থোক বরাদ্দ প্রদান করার প্রতিশ্রুতি দেন।
২০০০ সালে প্রণীত আইন অনুযায়ী স্থানীয় সরকার, জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন ও সিডিএ জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান সংরক্ষণ করবে। কিন্তু এ আইনকে বিভিন্ন ভাবে ফাঁকি দিয়ে চট্টগ্রামে পুকুর ও জলাশয় ভরাটের কাজ চল।ে ১৯৯১ সালে জেলা মত্স্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী চট্টগ্রামে জলাশয়ের সংখ্যা ১৯ হাজার ২৫০, অন্যদিকে সিডিএর ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যানের আওতায় ২০০৬-০৭ সালে ৭৭০ বর্গকিলোমিটার জলাশয় চিহ্নিত করছে ৪ হাজার ৫২৩টি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের এক গবেষণায় (মোরশেদ ও তৈয়ব চৌধুরী, ২০১৮) নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে ১ হাজার ৩৫২টি জলাশয় চিহ্নিত করা হয়। এ গবেষণায় দেখা যায়, চট্টগ্রামে প্রতি বছর ১০ শতাংশ হারে পুকুর ও জলাশয় হ্রাস পাচ্ছে। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সব পুকুর ও জলাশয় ভরাট করে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের ফলে নগরের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিপর্যস্ত হচ্ছে এবং অল্প সময়ের বৃষ্টিতে পর্যাপ্ত জলাশয়ের অভাবে নগরী তলিয়ে যাচ্ছে জলাবদ্ধতায়।
ড. ইকবাল সরোয়ার বলেন, বিবিএসের দুর্যোগসংক্রান্ত ২০১৬-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৯-২০১৪ পর্যন্ত জলাবদ্ধতায় বাংলাদেশে প্রতি বছর ৩১ মিলিয়ন ডলার সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। এ ক্ষতি না হলে বাংলাদেশের জিডিপি প্রতি বছর শূন্য দশমিক ২ শতাংশ বৃদ্ধি পেত।
গত এক দশকে (২০১১-২০২১) জলাবদ্ধতায় চট্টগ্রামের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র খাতুনগঞ্জ, চাক্তাই, আসাদগঞ্জ ও কোরবানীগঞ্জে ২ হাজার ৫১৭ টাকার ক্ষতি হয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫ হাজার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ী। এছাড়া চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতার কারণে যানবাহন চলাচল বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নষ্ট হয় ব্যক্তিগত ও পাবলিক পরিবহন। ২০২৩-এর জলাবদ্ধতার কারণে চসিকের ১ হাজার ৩০০ কিমি সড়কের মধ্যে ৫০ কিমি সড়ক সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এছাড়া দুই কিলোমিটার ফুটপাত ও দুই কিলোমিটার ড্রেন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
‘সিডিএর প্রকল্পটি ত্রুটিপূর্ণ’ :ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন অব বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম শাখার সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদার ইত্তেফাককে বলেন, চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পটির জন্মই হয়েছে ত্রুটির মধ্য দিয়ে। শুরুতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড যৌথভাবে সমীক্ষার মাধ্যমে একটি প্রকল্প তৈরি করে সরকারকে দিয়েছিল। কিন্তু সরকার এটা বিবেচনায় না নিয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পাঠানো ত্রুটিপূর্ণ একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয়। এই প্রকল্পটি চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে নেওয়া সবচেয়ে বড় প্রকল্প, যা আগামী বর্ষার আগেই শেষ হয়ে যাবে। প্রকল্পটি ত্রুটিপূর্ণ বলছি এই কারণে যে, এতে রিটেনশন পন্ড (জলাধার) করার কথা ছিল। কিন্তু সেটা হয়নি। যেখানে ৫৭টা টাইডাল রেগুলেটর (জোয়ার নিয়ন্ত্রণকারী ফটক) করার কথা, সেখানে হয়েছে মাত্র পাঁচটা। এই প্রকল্পটা প্রথমে সিডিএ করার কথা ছিল। পরে এতে সেনাবাহিনীকে যুক্ত করা হয়। তবে সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালকরা নিজেদের দক্ষতা দিয়ে ত্রুটিপূর্ণ এই প্রকল্পটি কিন্তু অনেকখানি এগিয়ে নিয়ে গেছেন। সেনাবাহিনী দক্ষতার সঙ্গে কাজ না করলে অবস্থা আরো খারাপ হতো। কিছুদিন আগে চার উপদেষ্টা চট্টগ্রামে আসেন। তাদের কঠোর নির্দেশনার কারণে এ বছর এই প্রকল্পের কিছু সুফল কিন্তু চট্টগ্রামের মানুষ পেয়েছেন। তবে এই সুফল ধরে রাখতে হলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে আরো দক্ষ করতে তুলতে হবে। তাদের আধুনিক মেশিনারিজ কিনে দিতে হবে, প্রশিক্ষিত জনবল লাগবে।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম শহরে একসময় ১০৪টি খাল ছিল। সেটা কমতে কমতে এখন ৭৭- এ এসে দাঁড়িয়েছে। আবার এই ৭৭টা খালের মধ্যে জলাবদ্ধতা প্রকল্পের আওতায় কাজ হয়েছে ৩৬টির। ২১টি খালের সংস্কার বাকি রয়ে গেছে। যতদূর জানতে পেরেছি চট্টগ্রামের মেয়র এই ২১টা খালের জন্য একটি প্রকল্প সরকারের কাছে দিয়েছিন। ২১ খালের সংস্কার না হলে জলাবদ্ধতা থেকেই যাবে।
সংকট বাড়াচ্ছে দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা :চট্টগ্রাম শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। তবে জলাবদ্ধতা নিরসনে সরকারের নেওয়া মেগা প্রকল্পের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনকে না দিয়ে দেওয়া হয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে। এ বিষয়টি ঐ সময় ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিলেও তত্কালীন সরকার এতে কর্ণপাত করেনি। সিটি করপোরেশনকে অন্তর্ভুক্ত না করার ফলে জলাবদ্ধতা প্রকল্পটি কাঙ্ক্ষিত গতি পায়নি বলে অনেকে মনে করেন।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম শহরে বিভিন্ন উত্স থেকে দৈনিক ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার টন বর্জ্য সৃষ্টি হয়। কিন্তু বর্জ্য অপসারণের জন্য প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে দৈনিক ২৫০-৩০০ টন বর্জ্য রাস্তা, নালা, নর্দমা, খালে বিচ্ছিন্নভাবে পড়ে থাকে এবং পরবর্তী সময়ে এসব বর্জ্য নালা ও খালে পড়ে ড্রেনেজ ব্যবস্থার প্রতিবন্ধকতা ও শহরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করছে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম শহরের শত শত টন বিভিন্ন প্লাস্টিক বর্জ্য প্রতিনিয়ত জমা হচ্ছে কর্ণফুলী নদীতে, ফলে নদীদূষণসহ ভরাট হচ্ছে তলদেশ। কর্ণফুলী নদীতে ২০১৮ সালের ড্রেজিংয়ের সময় ৪৮ লাখ ঘনমিটার বালিযুক্ত মাটি উত্তোলন করা হয়, এর মধ্যে ২২ লাখ ঘনমিটার ছিল পলিথিনযুক্ত বালিমাটি।
মেয়র যা বললেন :চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, চট্টগ্রামের প্রধান সমস্যা জলাবদ্ধতা। ইতিমধ্যে প্রায় ৫০-৬০ শতাংশ সমাধান করা সম্ভব হয়েছে। গত ১০ বছরের তুলনায় এবার জলাবদ্ধতা অনেকটাই কমেছে। জলাবদ্ধতা সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে হলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে আরো ঢেলে সাজানোর প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে মেয়র বলেন, আমাদের অনেকগুলো নতুন মেশিনারিজ কিনতে হবে। আমাদের কাছে এখন যা আছে, সেগুলো ১৬-১৭ বছরের পুরোনো। যেমন ধরেন টিজি বা এক্সকাভেটর যেগুলো আছে, নড়বড়ে হয়ে গেছে। এগুলো দিয়ে কাজ করতে গেলে ভেঙে যায়। এসব পুরোনো যন্ত্র দিয়ে আপনি নালা-নর্দমা পরিষ্কার করবেন কীভাবে। আমরা এজন্য সরকারের কাছে ৪০০ কোটি টাকা চেয়েছি। কিন্তু ১০০ কোটি টাকা কেটে ৩০০ কোটি দিচ্ছে। আমরা যুক্তরাজ্যের সঙ্গে যৌথভাবে ‘ময়লা থেকে সম্পদ’ নামে একটি কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। এলজিআরডিতে এই ফাইল দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। যুক্তরাজ্যের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাও এটা নিয়ে উপদেষ্টার কাছে গেছেন। কিন্তু তারাও ব্যর্থ হয়েছেন। এখানে আমি সচিবদের কোনো দোষ দেখি না। উপদেষ্টার ওখানে ফাইল নয়ছয় হয়ে যায়। আগে দেখতাম সচিবরা ধীরগতিতে কাজ করত। মন্ত্রীরা কোনো প্রকল্প দিলে সচিবরা আটকে রাখত। এখন উলটা হচ্ছে। সচিবরা দ্রুত ফাইল স্বাক্ষর করে উপদেষ্টার কাছে পাঠান। কিন্তু সেখানে গিয়ে ফাইল আটকে যায়।
মেয়র আরো বলেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে ১৬০০ কিলোমিটার ড্রেন পরিষ্কার রাখতে হয়। আমরা ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান দিয়েছি। নগরীর ২১টি খাল সংস্কার হয়নি। এর জন্য টাকা প্রয়োজন। জলাবদ্ধতা প্রকল্পের আওতায় ৩৬টি খালের কাজ হয়েছে। এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হবে। এর জন্য ফান্ড লাগবে। আমাদেরকে যেন কিছু ফান্ড দেওয়া হয়।
জলাবদ্ধতা নিয়ন্ত্রণে কিছু পরামর্শ :জলাবদ্ধতা সমস্যা থেকে মুক্ত হতে কিছু উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে অধ্যাপক ড. ইকবাল সরওয়ার। এর মধ্যে রয়েছে, পূর্বের মাস্টারপ্ল্যানের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সময়োপযোগী আধুনিক বাস্তবসম্মত ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন, দখলকৃত নালা-খাল উদ্ধার করে চট্টগ্রাম শহরের প্রকৃত ড্রেনেজ ডাটাবেজ প্রণয়ন করা, বিদ্যমান খাল ও নালার ওপর প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিতকরণ ও অপসারণ করতে হবে, নিয়মিত ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে খাল পরিষ্কার ও বিদ্যমান খালের প্রশস্ততা বৃদ্ধি করা, সিটি করপোরেশন, সিডিএ, ওয়াসা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন সেবা সংস্থাগুলো একটি সমন্বয় কমিটির মাধ্যমে জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করবে, পরিকল্পিতভাবে কালভার্ট, ব্রিজ নির্মাণ করা এবং শহরে সবুজের আচ্ছাদন বৃদ্ধি করা, কঠোর নজরদারির মাধ্যমে পাহাড় কাটা বন্ধ করা এবং পানির প্রাকৃতিক জলাধার-নগরীর পুকুর জলাশয় ও নিচু জমিগুলো রক্ষা করতে হবে এবং এ ব্যাপারে রাজনৈতিক মতৈক্য খুবই জরুরি, জোয়ারজনিত জলাবদ্ধতা নিরসনে খালগুলোর মুখে যথাযথ স্লুইসগেট স্থাপন করা এবং খালের মধ্যে বর্জ্য নিক্ষেপ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা, নালা ও খাল অবৈধ দখল ও ভরাট থেকে রক্ষা এবং সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক প্রচারণার ব্যবস্থা করা, যত্রতত্র অপরিকল্পিত স্থাপনা গড়ে ওঠায় জলাবদ্ধতা নিরসনে রাজনৈতিক ও সামাজিক একতা প্রয়োজন, এজন্য সঠিক পরিকল্পনা, দক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও সচেতনতার ওপর দৃষ্টি দিতে হবে।
উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খানের পরামর্শ :সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত নিবন্ধে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, চট্টগ্রাম শহর দেশের অন্যান্য শহর থেকে কিছুটা ভিন্ন। নগরী ও এর আশপাশে বেশ কিছু টিলা ও পাহাড় ছিল। বৃষ্টির পানি অপসারণের জন্য ছিল অনেক খাল। ভূমি ঢালু বিধায় বৃষ্টির পানি খাল বেয়ে দ্রুত নেমে যেত। নিজে চট্টগ্রামে বড় হয়েছি বিধায় শৈশব থেকে তাই দেখে এসেছি। তাহলে এখন এ জলাবদ্ধতা কেন? জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ দুটি। নির্বিচারে পাহাড় কাটা এবং খালগুলো ভরাট হয়ে যাওয়া। পাহাড় কাটার কারণে একদিকে ঢালু জমি সমতল হওয়ায় পানি আটকে থাকছে। আবার পাহাড়ের বালু খালের তলদেশে জমা হয়ে খালের গভীরতা কমাচ্ছে এবং বৃষ্টি ও বন্যার পানি অপসারণের ক্ষমতা হ্রাস করছে।
এখন যা করতে হবে, চট্টগ্রাম শহরের সব ধরনের পাহাড় কাটা বন্ধ করা, চট্টগ্রাম শহরের প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি ড্রেনগুলো পরিষ্কারের ব্যবস্থা নেওয়া, পানি নিষ্কাশনের জন্য নির্মাণাধীন স্লুইসগেট রেগুলেটরগুলোর নির্মাণকাজ দ্রুত সম্পন্ন করা, চট্টগ্রাম শহরের খালগুলো পরিষ্কার করা, খালগুলো অবৈধ দখলমুক্ত করে এগুলোর খননকাজ দ্রুত সম্পন্ন করা, যেখানে সেখানে ময়লা ফেলা বন্ধ করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া, কর্ণফুলী নদীর প্রয়োজনীয় নাব্য ও গভীরতা বজায় রাখার জন্য মেইনটেন্যান্স ড্রেজিং করা এবং জলাবদ্ধতার হটস্পটগুলোয় পাম্পহাউজ চালু করা।
কবে মিলবে পুরোপুরি মুক্তি: প্রায় দেড় দশক ধরে জলাবদ্ধতার ভোগান্তি থেকে চট্টগ্রাম নগরবাসীকে মুক্তি দিতে নগরীর ৩৬টি খাল নিয়ে যে মেগা প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছিল তা শেষের দিকে। এই প্রকল্পের পাশাপাশি অন্য আরো যেসব কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে সেগুলো শেষ হলে আগামী বছর নগরীর মানুষ বর্ষা মৌসুমে স্বস্তি পেতে পারেন বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই নাগরিকদের। যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলার অভ্যাস থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে জলাবদ্ধ নগরীর অভিশাপ থেকে মুক্তি মিলবে না কোনো কালেই। তথ্য ওছবি: দৈনিক ইত্তেফাক