ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন, দেশে গরমমসলার ৪৩% আসে অবৈধভাবে
অনলাইন ডেস্ক: সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) হিসাবে, দেশে বছরে জিরার চাহিদা ৬০ হাজার টন। এই চাহিদার বিপরীতে গত ২০২৩–২৪ অর্থবছর বৈধপথে জিরা আমদানি হয়েছে প্রায় ৩৪ হাজার টন। দেশে জিরা উৎপাদিত হয় না। এর মানে, চাহিদার তুলনায় ২৬ হাজার টন কম আমদানি হয়েছে; কিন্তু আমদানি কম হলেও দেশে জিরার ঘাটতি হয়নি। কারণ, বাকি জিরা অবৈধভাবে দেশে আনা হয়েছে।
জিরার মতো এলাচ, দারুচিনি ও লবঙ্গ—এ তিনটি মসলাও বছরের পর বছর ধরে চাহিদার চেয়ে কম আমদানি হচ্ছে। এসব মসলার চাহিদা ও আমদানির সার্বিক উঠে এসেছে বিটিটিসির এক প্রতিবেদনে। সংস্থাটির পর্যবেক্ষণ হলো, এ চারটি মসলার চাহিদার তুলনায় আমদানি ঘাটতি ৪৩ শতাংশ। তা সত্ত্বেও ঘাটতি ধরা না পড়ায় প্রতীয়মান হয় যে এসব পণ্য নিয়ে অনানুষ্ঠানিক বা অন্য কোনো উপায়ে (চোরাচালান বা মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে আমদানি) বাণিজ্য হচ্ছে।
মসলার পাশাপাশি পাঁচটি শুকনা ফল নিয়েও এমন অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্যের কথা বলেছে ট্যারিফ কমিশন। এই পাঁচটি ফল হলো কিশমিশ, কাজুবাদাম, কাঠবাদাম, পেস্তাবাদাম ও আলুবোখারা। খাবার সুস্বাদু করতে এসব শুকনা ফলের চাহিদা রয়েছে। আবার স্বাস্থ্যকর খাবার হিসেবেও এসব শুকনা ফলের কদর বেশি।
ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মসলা ও শুকনা ফলের নয়টি পণ্যের চাহিদা ১ লাখ ২৪ হাজার টন। গত অর্থবছরে আমদানি হয়েছে প্রায় ৬৮ হাজার টন। ঘাটতি ছিল ৫৬ হাজার টন, যা অনানুষ্ঠানিক পথে বাজারে ঢুকেছে। অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্যের মাধ্যমে দেশে আসা এই নয়টি পণ্যের খুচরা দাম প্রায় ৪ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা।
মসলা আমদানিকারকেরা অনেক দিন ধরে অভিযোগ করে আসছিলেন, চোরাই পথে ভারত থেকে মসলা আমদানি হচ্ছে। ট্যারিফ কমিশনও এই প্রথমবার অবৈধপথে মসলা আমদানির বিষয়টি তাদের প্রতিবেদনে তুলে ধরল। গত মঙ্গলবার প্রতিবেদনটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) পাঠানো হয়েছে।
মিথ্যা ঘোষণায় ও চোরাই পথে যা যা আসছে
ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনের সূত্র ধরে প্রথম আলো এনবিআরের আমদানি নথি পর্যালোচনা করেছে। পাশাপাশি চোরাচালানবিরোধী অভিযানের তথ্য পর্যালোচনা করে ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে অবৈধভাবে আনা পণ্যের মোটামুটি একটি চিত্র পাওয়া গেছে। যেমন গত বছর সীমান্ত এলাকায় অভিযান চালিয়ে বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ (বিজিবি) চোরাই পথে আনা ৬৫ হাজার ২৯৮ কেজি জিরা জব্দ করেছে। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, যে পরিমাণ জিরা অবৈধপথে আসে, তার খুব সামান্য পরিমাণই ধরা পড়ে।
আবার স্থলবন্দর দিয়ে উচ্চ শুল্কের পণ্যের ক্ষেত্রে নিয়মিত ওজনে কারচুপির ঘটনা ঘটে বলে জানা গেছে। এনবিআরের গত ২০২৩–২৪ অর্থবছরের আমদানি তথ্যে দেখা যায়, বুড়িমারী, হিলি, ভোমরা ও বিবিরবাজার স্থলবন্দর দিয়ে চারটি মসলার (জিরা, এলাচ, দারুচিনি ও লবঙ্গ) মোট ৭৮টি চালানে ওজনে কারচুপি ধরা পড়েছে। এর মধ্যে কিশমিশ ও কাজুবাদামের চালান ছিল ১৮টি। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বাস্তবে এই হার অনেক বেশি।
শুল্কহার যৌক্তিক করা হলে চোরাচালান কমবে, সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে এবং অত্যাবশ্যকীয় পণ্যগুলো মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকবে
মইনুল খান, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি)।
চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জভিত্তিক মসলা আমদানিকারক মিনহাজ এন্টারপ্রাইজের কর্ণধার রাইসুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতি কেজি ভারতীয় জিরা আমদানিতে আমাদের খরচ হচ্ছে ৬১১ টাকা। যাঁরা অবৈধভাবে জিরা আনছেন, তাঁরা বিক্রিই করছেন ৬০০ টাকায়। ফলে আমরা এখন আমদানি কমাতে বাধ্য হচ্ছি।’
বাংলাদেশ গরমমসলা ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি এনায়েত উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, চোরাচালানের বড় কারণ হলো মসলাপণ্যে উচ্চ শুল্কহার। শুল্কহার যৌক্তিক হলে যাঁরা বৈধপথে ব্যবসা করেন, তাঁরা বৈষম্যের শিকার হতেন না।
অত্যাবশ্যকীয় পণ্য, তবু শুল্কহার বেশি
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ২০১২ সালের জুলাই মাসে ১৭টি পণ্যকে অত্যাবশ্যকীয় বলে ঘোষণা করে। এই ১৭টি পণ্যের মধ্যে দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচি এবং জিরা—চারটি গরম মসলাও রয়েছে। যেসব পণ্যকে সাধারণ ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য বিবেচনা করা হয়, সেগুলোকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকায় রাখা হয়। কিন্তু গরমমসলা অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকায় থাকলেও এগুলোর ওপর শুল্ক–কর বেশি। যেমন এ চারটি মসলা আমদানিতে শুল্কহার হচ্ছে ৫৮ দশমিক ৬০ শতাংশ। এর মানে হলো মসলার আমদানিমূল্য যদি ১০০ টাকা হয়, তাহলে শুল্ক–কর দিতে হবে ৫৮ টাকা ৬০ পয়সা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর তথ্যে দেখা যায়, চলতি জানুয়ারির প্রথম ১০ দিনে খালাস হওয়া প্রতি কেজি জিরায় ২৫১ টাকা, দারুচিনিতে ১২২ টাকা, এলাচিতে ৫৩৫ টাকা, লবঙ্গে ২৮৫ টাকা করে শুল্ক–কর আদায় করেছে কাস্টমস।
মসলার মতো কিশমিশ, কাজুবাদাম, কাঠবাদাম, পেস্তাবাদাম ও আলুবোখারা এসব শুকনা ফলেও উচ্চ হারে শুল্ক আদায় করা হয় বলে ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন প্রতি কেজি কিশমিশে ২৮৯ টাকা, কাঠবাদামে ৩১০ টাকা, পেস্তাবাদামে ৬১৯ টাকা, আলুবোখারায় ১৫৪ টাকা ও কাজুবাদামে ৪৪৫ টাকা শুল্ক–কর আদায় করছে কাস্টমস। ৯ জানুয়ারি কিশমিশ আমদানিতে সম্পূরক শুল্কহার ১০ শতাংশ বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়। তাতে এখন কেজিপ্রতি শুল্ক–কর দাঁড়াবে ৩৩১ টাকা।
বর্তমানে প্রতি কেজি জিরায় ২৫১, দারুচিনিতে ১২২, এলাচিতে ৫৩৫, লবঙ্গে ২৮৫, কিশমিশে ৩৩১, কাঠবাদামে ৩১০, পেস্তাবাদামে ৬১৯, আলুবোখারায় ১৫৪ ও কাজুবাদামে ৪৪৫ টাকা করে শুল্ককর আদায় করছে কাস্টমস।
প্রতিবেদনটিতে ট্যারিফ কমিশনের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, এসব মসলা ও শুকনা ফলে উচ্চহারে শুল্ক–কর রয়েছে। এতে একদিকে যেমন মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি চোরাচালান বা মিথ্যা ঘোষণায় অর্থাৎ অনানুষ্ঠানিক পদ্ধতিতে আমদানি উৎসাহিত হচ্ছে। এতে সরকার যে পরিমাণ রাজস্ব পাওয়ার কথা তা পাচ্ছে না। সে জন্য চারটি মসলা এবং কিশমিশ ও আলুবোখারায় শুল্কহার ২৭ শতাংশ এবং কাজুবাদাম ও কাঠবাদামের শুল্কহার প্রায় ৪৬ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্যে দেখা গেছে, মসলাসহ এই নয়টি পণ্যে সরকার গত অর্থবছরে রাজস্ব আদায় করেছিল ১ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। হিসাব করে দেখা গেছে, ট্যারিফ কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী শুল্কহার কমানো হলে এবং অবৈধ চোরাচালান বন্ধ হলে সরকারের রাজস্ব আদায় হবে ১ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মইনুল খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মসলা ও শুষ্ক ফল মিলিয়ে অত্যাবশ্যকীয় নয়টি পণ্যে শুল্কহার যৌক্তিক করার প্রস্তাব দিয়েছি। শুল্কহার যৌক্তিক করা হলে চোরাচালান কমবে, সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে এবং অত্যাবশ্যকীয় পণ্যগুলো মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকবে।’ সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো