এনসিটিবির সামনে কর্মসূচি চলাকালে হাতাহাতি ও হামলা, অনেকে আহত

নিজস্ব প্রতিবেদক: পাঠ্যপুস্তকে ‘আদিবাসী’ শব্দসংবলিত গ্রাফিতি রাখা ও না রাখা নিয়ে দুই পক্ষের বিক্ষোভ কর্মসূচির চলাকালে হাতাহাতি ও হামলা হয়েছে। এতে অনেকে আহত হয়েছেন।

আজ বুধবার রাজধানীর মতিঝিলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ভবনের সামনে এ ঘটনা ঘটে।

পাঠ্যপুস্তকে ‘আদিবাসী’ শব্দ প্রবেশ এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানবিরোধী অখণ্ড ভারতের কল্পিত গ্রাফিতি সংযোজনের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তিসহ ৫ দফা দাবিতে আজ সকালে এনসিটিবি ভবন ঘেরাও করে ‘স্টুডেন্ট ফর সভরেন্টি’ নামের একটি সংগঠন।

অন্যদিকে ‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতা’র ব্যানারে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর একদল লোক পাঠ্যবইয়ে গ্রাফিতিটি পুনর্বহালের দাবিতে এনসিটিবির সামনে কর্মসূচি পালন করতে যায়।

ঘটনাস্থলে অবস্থান করে দেখা যায়, এনসিটিবির সামনে আগে থেকেই ‘স্টুডেন্ট ফর সভরেন্টি’র ব্যানারে একদল লোক অবস্থান নিয়ে ছিলেন। পরে দুপুর পৌনে ১২টার দিকে সেখানে যায় ‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতা’র ব্যানারধারীরা।

সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতার ব্যানারে কর্মসূচিটি ছিল পূর্বনির্ধারিত। স্টুডেন্ট ফর সভরেন্টির ব্যানারেও সেখানে গতকাল কর্মসূচি দেওয়া হয়।

সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতার ব্যানারে লোকেরা এনসিটিবির সামনে গেলে দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি হয়। পুলিশ গিয়ে দুই পক্ষকে সরিয়ে দিয়ে মাঝে অবস্থান নেয়। তখন দুই পাশ থেকে দুই পক্ষ পরস্পরবিরোধী স্লোগান দিচ্ছিল। ঘটনাস্থলে অবস্থান করে দেখা যায়, বেলা একটার কিছু সময় পর কিছু লোক সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতার ব্যানারে আসা মানুষের ওপর হামলা চালান। এতে কয়েকজন আহত হন, তাঁদের মধ্যে একজন নারী।

স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টি দাবি করেছে, তাদের ওপর হামলা হয়েছে। অন্যদিকে সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতা দাবি করেছে, তাদের ওপর হামলা করা হয়েছে পরিকল্পিতভাবে।

পুলিশ তখন লাঠিপেটা করে দুই পক্ষকে সরিয়ে দিয়ে এনসিটিবি ভবনের সামনে অবস্থান নেয়। বেলা দেড়টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত স্টুডেন্ট ফর সভরেন্টির ব্যানারে আসা লোকজন মতিঝিলের শাপলা চত্বর এলাকার দিকে ছিলেন। আর সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতার ব্যানারে আসা লোকজন ঘটনাস্থল ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন।

নবম ও দশম শ্রেণির ‘বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও নির্মিতি’ বইয়ের পেছনের প্রচ্ছদে ‘আদিবাসী’ শব্দ থাকা একটি গ্রাফিতি যুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু এর প্রতিবাদ জানিয়ে তা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টি। এরপর সরকার সেটি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় এবং পাঠ্যবইয়ের পিডিএফ সংস্করণ থেকে সেটি সরিয়ে নতুন একটি গ্রাফিতি সংযুক্ত করা হয়।

পাঠ্যপুস্তকে ‘আদিবাসী’ শব্দসংবলিত গ্রাফিতি রাখা ও না রাখা নিয়ে দুই পক্ষের বিক্ষোভ কর্মসূচির চলাকালে হাতাহাতি ও হামলার ঘটনা ঘটেছে। আজ বুধবার রাজধানীর মতিঝিলে এনসিটিবি ভবনের সামনে
পাঠ্যপুস্তকে ‘আদিবাসী’ শব্দসংবলিত গ্রাফিতি রাখা ও না রাখা নিয়ে দুই পক্ষের বিক্ষোভ কর্মসূচির চলাকালে হাতাহাতি ও হামলার ঘটনা ঘটেছে। আজ বুধবার রাজধানীর মতিঝিলে এনসিটিবি ভবনের সামনেছবি: শুভ্র কান্তি দাশ
তবে স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টি আগের গ্রাফিতিটি সংযোজনের দায়ে রাখাল রাহা ওরফে সাজ্জাদের অপসারণ এবং এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনার দাবি করছে।

আজ এনসিটিবির সামনে আয়োজিত কর্মসূচিতে পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরেন স্টুডেন্ট ফর সভরেন্টির যুগ্ম আহ্বায়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মুহম্মদ ইয়াকুব মজুমদার। দাবির মধ্যে রয়েছে অবাঙালিদের (ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী) আদিবাসী সম্বোধন করে কোনো বক্তব্য দেওয়া যাবে না, কোনো বইপুস্তক ছাপানো যাবে না, লেখালেখি করা যাবে না, কোনো নাটক-সিনেমা বা গল্পকাহিনি রচনা করা যাবে না। বাঙালিদেরই বাংলাদেশের একমাত্র আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি থাকতে হবে। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের (অবাঙালি) ‘আদিবাসী’ বলা ও প্রচারণাকে রাষ্ট্রদ্রোহী অপরাধ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে।

কর্মসূচিতে স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টির আহ্বায়ক মুহম্মদ জিয়াউল হক বলেন, আদিবাসী শব্দটি কোনো জাতিগত পরিচয় নয়। কাজেই আদিবাসী শব্দের বিরোধিতা করলে রেসিজম (বর্ণবাদ) হয় না।

অন্যদিকে সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতার দাবি হলো, আগের গ্রাফিটিতি পাঠ্যবইয়ে পুনর্বহাল করা। এনসিটিবির সামনে কর্মসূচি পালন করতে যাওয়া অলিক মৃ আজ দুপুর ১২টার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, এনসিটিবি পাঠ‍্যবইয়ে এবার ‘আদিবাসী’ লেখা গ্রাফিতি যুক্ত করেছিল। তার বিরুদ্ধে ‘মব’ তৈরি করা হয়। পরে আদিবাসী লেখা গ্রাফিতি বাদ দেওয়া হয়েছে। ওই গ্রাফিতি পুনর্বহাল করতে হবে।

এদিকে দুই পক্ষই দাবি করেছে, তাদের ওপর হামলা হয়েছে এবং তাদের লোক আহত হয়েছে।

জিয়াউল হক বলেন, ‘আমরা অবস্থান কর্মসূচি শেষ করে চলে যাওয়ার সময় হামলা চালানো হয়েছে। এতে ১৪-১৫ জন আহত হয়েছেন। এতে একজনের অবস্থা গুরুত্বর। তিনি একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।’

ঘটনার পর রক্তাক্ত দুজনের একজনকে একটি ভ্যানে, একজনকে একটি রিকশায় করে নিয়ে যেতে দেখা যায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আহত নয় ব্যক্তি সেখানে চিকিৎসার জন্য গিয়েছেন। তাঁরা হলেন ধনজেতরা (২৮), অন্তত ধামাই (৩৫), ফুটন্ত চাকমা (২২), ইসাবা শুহরাত (৩২), রেংইয়ং ম্র (২৭), রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা তঞ্চঙ্গ্যা (২৫), ডোনায়ই ম্রো (২৫), শৈলী (২৭) ও ডিবিসি টিভির সাংবাদিক জুয়েল মার্ক (৩৫)।

তাঁদের মধ্যে রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা তঞ্চঙ্গ্যা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নির্বাহী কমিটির সদস্য বলে ফেসবুকে এক পোস্টে জানান সংগঠনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা। তিনি বলেন, স্টুডেন্ট ফর সভরেন্টির হামলায় রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা তঞ্চঙ্গ্যা গুরুতর আহত হয়েছেন।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য দীপায়ন খিসা বলেন, এটা ‘মব’ বাহিনীর হামলা। তারা আগে থেকেই সেখানে লাঠিসোঁটা নিয়ে অবস্থান নিয়েছিল। হামলায় তাঁদের ১২ জন আহত হয়েছেন। তিনি অবিলম্বে এই ঘটনার তদন্ত, জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও বিচার দাবি করেন।

Related Articles

Back to top button