শেখ হাসিনাসহ তার পরিবারের সাত সদস্য দেশে-বিদেশে সম্পদের অনুসন্ধান শুরু
অনলাইন ডেস্ক: দুর্নীতি ও অর্থ পাচারে জড়িত সন্দেহে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ পরিবারের সাত সদস্যের নামে দেশে-বিদেশে থাকা অর্থসম্পদের তথ্য অনুসন্ধানে নেমেছে বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ)। এর মধ্যে আছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বোন শেখ রেহানা।
শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক, মেয়ে টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক ও আজমিনা সিদ্দিক। এদের নামে দেশের ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোতে থাকা অর্থসম্পদের তথ্য চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সম্প্রতি মানি লন্ডারিংবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা এগমন্ট গ্রুপের কাছেও চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে ওইসব ব্যক্তি ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে বিভিন্ন দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য খাতে থাকা সম্পদের তথ্য চাওয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, বিএফআইইউ ওইসব ব্যক্তির নামে বিভিন্ন দেশে থাকা অর্থসম্পদের তথ্য চেয়েছে মানি লন্ডারিং নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা এগমন্ট গ্রুপের কাছে। বাংলাদেশ এগমন্ট গ্রুপের সদস্য। বিশ্বের ১৭৭টি দেশের মানি লন্ডারিং বিষয়ে কাজ করা আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটগুলো এই গ্রুপের সদস্য। বাংলাদেশ থেকে যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি টাকা পাচার হচ্ছে সেসব দেশও এই গ্রুপের সদস্য। এর মধ্যে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ম্যাকাউ, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ আরও অনেক দেশ। এই গ্রুপের কাছে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো দেশ কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে তথ্য চাইলে তারা সংশ্লিষ্ট সদস্য দেশগুলো থেকে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে সরবরাহ করে। এর মাধ্যমে বিএফআইইউ অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তথ্য সংগ্রহ করেছে। এর আওতায় শেখ হাসিনাসহ তার পরিবারের আলোচ্য সাত সদস্যের বিষয়ে তথ্য চেয়েছে। এছাড়া বিএফআইইউ ৮১টি দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। এর আওতায় দেশভিত্তিক তথ্য সংগ্রহের সুযোগ রয়েছে।
সূত্র জানায়, বিএফআইইউ থেকে এগমন্ট গ্রুপের কাছে সম্প্রতি শেখ হাসিনাসহ তার পরিবারের সাত সদস্যের নামে বিদেশে থাকা সম্পদের তথ্য চেয়ে যে চিঠি দেওয়া হয়েছে তা এগমন্ট গ্রুপ সদস্য দেশগুলোর মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে কাজ করা আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের কাছে পাঠাবে। একেক দেশে আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট একেক নামে পরিচিত। যেমন ভারতে এর নাম ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট-ইন্ডিয়া, ম্যাকাউয়ে ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স অফিস, কুয়েতে কুয়েত ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট। এসব সংস্থা সংশ্লিষ্ট দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তা বাংলাদেশে পাঠাবে। এসব তথ্যের আলোকে বিএফআইইউ থেকে গোয়েন্দা প্রতিবেদন তৈরি করে তা পাঠাবে সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী সংস্থাগুলোর কাছে। ওইসব সংস্থা বিশদ তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
এর আগে গত সেপ্টেম্বরে বিএফআইইউ থেকে আওয়ামী লীগের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) এবং সিআরআইয়ের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইয়াং বাংলার ব্যাংক হিসাবের তথ্য চাওয়া হয়েছে। এতেও মোটা অঙ্কের সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য মিলেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক, মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক ও সাবেক মন্ত্রী নসরুল হামিদের ব্যাংক হিসাবের তথ্য তলব করা হয়েছে। একই সঙ্গে ওইসব হিসাব স্থগিত করা হয়েছে।
গত ডিসেম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের ও এর ট্রাস্টি হিসাবে শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানার ব্যাংক হিসাবের তথ্যও চাওয়া হয়েছে। এছাড়া এই ট্রাস্টের সঙ্গে জড়িত কিংবা ট্রাস্টের হিসাব থেকে যেসব হিসাবে অর্থ স্থানান্তর করা বা জমা হয়েছে, তাদের তথ্যও দিতে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, বিদেশে শেখ হাসিনা পরিবারের অনেক সদস্যের নামে সম্পদ রয়েছে বলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এসব বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছে বিএফআইইউ।
এর আগে বিএফআইইউ থেকে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক ৯ প্রভাবশালী মন্ত্রী, ১১ সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) ও তাদের স্ত্রী, সন্তান ও সহযোগীদের নামে অর্থসম্পদের তথ্য চাওয়া হয়েছে। এছাড়া ৭টি বড় ব্যবসায়িক গ্রুপের নামে বিদেশে থাকা অর্থসম্পদের তথ্যও চাওয়া হয়েছে। আরও রাজনৈতিক নেতা, ব্যাংকার, আমলা, পুলিশ কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী তাদের গ্রুপের নামও আছে অর্থসম্পদের তথ্য চাওয়ার তালিকায়। দেশে তদন্ত শেষে পর্যায়ক্রমে বিদেশে সম্পদের তথ্য চেয়ে চিঠি দেওয়া হবে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। টানা ১৫ বছরে তিনটি ভোটারবিহীন নির্বাচন করে সরকার ক্ষমতায় টিকে ছিল। ওই সময়ে দেশের আর্থিকসহ প্রায় সব খাতেই নজিরবিহীন লুটপাট করে টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এমনকি ৭টি ব্যাংক দখল করে টাকা লুট করা হয়েছে। এ কাজে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী, সংসদ সদস্য (এমপি), আমলা, ব্যবসায়ীরা ছিলেন সামনের সারিতে। পতনের পর সরকারের মন্ত্রী, এমপি ও সুবিধাভোগী ব্যবসায়ীদের একটি অংশ পালিয়ে গেছে। ওইসব ব্যক্তি ও তাদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে টাকা পাচারের তথ্য অনুসন্ধান চলছে। ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে টাকা পাচারের তথ্য মিলেছে। এছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন ও সিআইডির তদন্তেও টাকা পাচারের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার করা অর্থের বড় অংশই যাচ্ছে সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, কানাডা, দুবাই, যুক্তরাষ্ট্র, মারিশাস, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডসহ আরও কয়েকটি দেশে। এর মধ্যে সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকারের কাছে সহায়তা চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তারা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী সহায়তা করতে সম্মত হয়েছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া অর্থ উপদেষ্টা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরও বিভিন্ন বৈঠকে পাচার করা সম্পদ দেশে ফেরাতে সহায়তা চাচ্ছেন।
বিএফআইইউ থেকে আরও সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের ব্যাপারে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। তাদের বিষয়ে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ হচ্ছে। এতে সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেলেই তাদের বিষয়েও বিদেশে অর্থসম্পদের তথ্য চেয়ে চিঠি দেওয়া হবে বলে জানা গেছে।
এর আগে শেখ হাসিনা পরিবারের দুর্নীতি অনুসন্ধান ও পাচার করা টাকার সন্ধানে দুদক, সিআইডি ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সমন্বয়ে ১০টি টিম গঠন করা হয়েছে। সেগুলো সমন্বয় করছে বিএফআইইউ। গত বৃহস্পতিবার দুদকের নেতৃত্বে ১১টি দল গঠন করা হয়েছে পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে। এতে রয়েছে দুদক, এনবিআর ও সিআইডি।