শেয়ারবাজারের সংকট নেতৃত্বের দুর্বলতায়

অনলাইন ডেস্ক: শেয়ারবাজারে সংকট আরও বেড়েছে। ৫ আগস্টের পর দেশের অর্থনীতির অন্যান্য খাতে ইতিবাচক পরিবর্তন এলেও ব্যতিক্রম শুধু শেয়ারবাজার। বৃদ্ধি তো দূরের কথা, উলটো প্রতিদিনই কমছে মূল্যসূচক ও বাজারমূলধন। কমছে তারল্যপ্রবাহ। গত ৫ মাসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মূল্যসূচক ৮১৮ পয়েন্ট কমেছে। এতে ডিএসইর বাজারমূলধন কমেছে ৫৪ হাজার কোটি টাকা। সবকিছু মিলে শেয়ারবাজার গভীর খাদের কিনারায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারের এই অবস্থার পেছনে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নেতৃত্বের দুর্বলতা দায়ী। একদিকে বর্তমান কমিশনের শেয়ারবাজারের মতো টেকনিক্যাল খাতের ব্যাপারে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা নেই। অপরদিকে যোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে সম্মিলিতভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলার দক্ষতা নেই। পুরো কমিশন বাজার থেকে বিচ্ছিন্ন। সংশ্লিষ্ট কোনো অংশীজনের সঙ্গে কথাও বলেন না বিএসইসির বর্তমান চেয়ারম্যান খোন্দকার রাশেদ মাকছুদ। কেউ দেখা করতে চাইলেও সাক্ষাৎ দেন না। তবে আলোচ্য সময়ে তারা বেশ কিছু কোম্পানিকে বড় ধরনের জরিমানা করেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই ঘটনায় মিডিয়া কাভারেজ ছাড়া তেমন কিছু অর্জিত হয়নি। কারণ এই জরিমানার টাকা আদায় হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। ফলে বর্তমান নেতৃত্বের পরিবর্তন না হলে বাজার ইতিবাচক হওয়ার সম্ভাবনা কম। এ পরিস্থিতিতে শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আজ বৈঠক করবেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।

এদিকে বাজার পরিস্থিতি নিয়ে সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছে যুগান্তর। সেখানে বেশকিছু তথ্য উঠে এসেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন পর্যন্ত পুঁজিবাজারে দুটি শব্দ খুব পরিচিত। একটি হলো আস্থার সংকট এবং অপরটি নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ অংশীজনদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা। কিন্তু ৫ আগস্টের পর আরও দুটি শব্দ যোগ হয়েছে। তা হলো বৈষম্য এবং সংস্কার। কিন্তু অন্যান্য খাতে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখানে এখনো সংস্কারের ছোঁয়া লাগেনি। তাদের মতে, এ খাতে সংস্কারে ৪টি বিষয় জরুরি। এগুলো হলো-সদিচ্ছা, জ্ঞান, চাপমুক্ত থাকা এবং গুণগত মানের নেতৃত্ব। কিন্তু বর্তমান কমিশনের সদিচ্ছা থাকলেও শেয়ারবাজারের মতো টেকনিক্যাল খাতের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা নেই। সরকার ও প্রভাবশালীদের পক্ষ থেকে বড় ধরনের চাপ নেই। কিন্তু নেতৃত্বের দুর্বলতা আছে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, ৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হলে পরপর কয়েকদিন ইতিবাচক হয় বাজার। তবে তা ধরে রাখা যায়নি। এ সময়ে বিএসইসিতে পরিবর্তন আসে। একজন চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়ে পরের দিন আবার পরিবর্তন করা হয়। পরে বর্তমান কমিশনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা একেবারেই অনভিজ্ঞ। বাজারের ব্যাপারে তাদের কোনো ধারণা নেই। নতুন উদ্ভাবন তো দূরের কথা, অনেক পরিভাষাই তারা বোঝেন না। এছাড়া নতুন কমিশনের বেশকিছু সিদ্ধান্ত ছিল বিতর্কিত। স্টক এক্সচেঞ্জের পর্ষদ গঠনে বেশকিছু সিদ্ধান্ত বাজারে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি করে। বিষয়টি বাজার সংশ্লিষ্টরা ভালোভাবে নেয়নি। এছাড়া কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান কোনো স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে কথা বলেন না। কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে পারেন না। অর্থাৎ কমিশন অনেকটাই বাজার থেকে বিচ্ছিন্ন। অন্যদিকে যেসব প্রতিষ্ঠান বেশি লেনদেন করে, এ ধরনের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট বন্ধ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট বন্ধ থাকা যৌক্তিক। তবে প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট বন্ধ রাখলে বিনিয়োগকারীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে ঘুরে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, উলটো টানা পতন অব্যাহত রয়েছে।

গত বছরের ১১ আগস্ট ডিএসইর মূল্যসূচক ছিল ৬ হাজার ১৫ পয়েন্ট। সোমবার পর্যন্ত তা কমে ৫ হাজার ১৯৮ পয়েন্টে নেমে এসেছে। এ হিসাবে ৫ মাসে সূচক ৮১৮ পয়েন্ট কমেছে। ওই সময়ে গড় লেনদেন ছিল ৭শ টাকায়। কিন্তু বর্তমানে তা ৩শ কোটি টাকার নিচে নেমে এসেছে। ১১ আগস্ট ডিএসইর বাজারমূলধন ছিল ৭ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে তা কমে ৬ লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকায় নেমে এসেছে। অর্থাৎ আলোচ্য সময়ে বাজারমূলধন ৫৪ হাজার কোটি টাকা কমেছে। মৌল ভিত্তিসম্পন্ন বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ারের দাম নিম্নমুখী। তবে বিএসইসি বলছে ভিন্নকথা। যারা আগে বাজারে কারসাজি করেছিল, তাদের বেশকিছু লোকজনের ব্যাপারে বিএসইসি ব্যবস্থা নিচ্ছে। ফলে ওই চক্রটি বাজারে পরিকল্পিতভাবে পতন ঘটাচ্ছে। এদিকে সরকার গঠিত শ্বেতপত্র কমিটির রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ১৫ বছরে শেয়ারবাজার থেকে এক লাখ কোটি টাকা আত্মসাৎ হয়েছে। জালিয়াতি, কারসাজি এবং ভুয়া কোম্পানি তালিকাভুক্তির মাধ্যমে নেওয়া হয়েছে এ টাকা। এক্ষেত্রে আর্থিক খাতের প্রভাবশালী উদ্যোক্তা গোষ্ঠী, ইস্যু ম্যানেজার, নিরীক্ষক ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কারসাজির চক্র গড়ে ওঠে। বিএসইসি এ ব্যাপারে তাদের দায়িত্ব পালন এবং বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। অর্থনীতির অবস্থা মূল্যায়নে গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বাজারের মূল সমস্যা বিনিয়োগকারীদের আস্থা সংকট। দীর্ঘদিন থেকে এই সংকট চলে আসছে। এর সঙ্গে অর্থনৈতিক বিভিন্ন সংকট, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং জাতীয় রাজনীতিসহ সবকিছু যোগ হয়েছে। ফলে সবার আগে আস্থা সংকট দূর করতে পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আস্থা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ বিনিয়োগকারীদের এই নিশ্চয়তা দিতে হবে, কারসাজির মাধ্যমে কেউ তার টাকা হাতিয়ে নিলে বিচার হবে। পাশাপাশি ভালো শেয়ারের সরবরাহ বাড়াতে হবে। তবে কাজটি খুব সহজ নয়।

যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, দীর্ঘদিন পর্যন্ত কয়েকটি গেম্বলার গ্রুপ অলিখিতভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করত। পরিস্থিতি একটু খারাপ হলেই কমিশন থেকে বড় হাউজ এবং কয়েকজন বড় বিনিয়োগকারীকে শেয়ার কিনে বাজার সাপোর্ট দিতে বলা হতো। বর্তমানে গ্রুপগুলো নিষ্ক্রিয়। ফলে বাজারে লেনদেন বাড়ছে না। বাজারের সংকটের আরেকটি কারণ মার্জিন ঋণ শেয়ার (কেনায় ঋণ সুবিধা)। বর্তমানে মার্জিন ঋণের হার ১:০.৮। অর্থাৎ কোনো বিনিয়োগকারীর ১ লাখ টাকা থাকলে তাকে আরও ৮০ হাজার টাকা ঋণ দেওয়া হবে। কিন্তু অনেক হাউজ এই সীমা মানেনি। ফলে বাজার কিছুটা নেতিবাচক হলেই শেয়ার বিক্রি করে ঋণ সমন্বয় করা হয়। এতে পতন আরও ত্বরান্বিত হয়। গত ১৫ বছরে নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠী ও পরিবারের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছিল পুরো দেশের রাজনীতি এবং অর্থনীতি। তারাই দেশ চালাবে, সম্পদ লুট করবে আর সাধারণ মানুষ তাতে রসদ জোগাবে। তাদের দুর্নীতি, দুঃশাসন ও বিচারহীনতার প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে। সবকিছু মিলে বিনিয়োগকারীদের চরম দুরবস্থা চলছে। এ অবস্থায় দক্ষ নেতৃত্বের মাধ্যমে বাজারে সংস্কার জরুরি।

অন্যদিকে ৫ আগস্টের পর সরকারের পক্ষ থেকে নীতিসহায়তার কথা জানানো হয়েছে। যেমন বিদ্যমান আইনে ৫০ লাখ টাকার অধিক মূলধনী আয়ের ওপর সর্বোচ্চ করহার ছিল ৩০ শতাংশ। সেই করহার কমিয়ে বর্তমানে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া সম্পদশালী করদাতাদের করের ওপর বিদ্যমান আইনে সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ হারে সারচার্জ দিতে হয়। এতে শেয়ারবাজার থেকে অর্জিত মূলধনী মুনাফার ওপর আয়কর ও সারচার্জ বাবদ মোট ৪০ দশমিক ৫০ শতাংশ হারে কর দিতে হতো। নতুন নিয়মে ৫০ লাখ টাকার বেশি মূলধনী মুনাফার ওপর প্রদেয় আয়কর ও সারচার্জ বাবদ সর্বোচ্চ করহার কমিয়ে ২০ দশমিক ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। তবে শেয়ারবাজারে তার তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি।

Related Articles

Back to top button