সরকারের ঋণ গ্রহণে বড় বিশৃঙ্খলা

অনলাইন ডেস্ক: রাজস্ব আয় কম হওয়ায় চলতি ব্যয় মেটাতে সরকারকে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বড় অঙ্কের ঋণ গ্রহণ করতে হচ্ছে। সরকারের বড় অঙ্কের ঋণের জোগান আসে ব্যাংক খাত থেকে। কিন্তু এবার তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংক খাত চাহিদা অনুযায়ী সরকারকে বড় অঙ্কের ঋণের জোগান নিশ্চিত করতে পারছে না।

উলটো ব্যাংকে তারল্যের জোগান বাড়াতে সরকার এ খাত থেকে নেওয়া আগের ঋণ কিছুটা পরিশোধ করছে। ফলে সরকার বাধ্য হয়েই ঋণের জন্য হাত দিচ্ছে নন-ব্যাংক খাতের ওপর। এর মধ্যে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান (ফাইন্যান্স কোম্পানি), বিমা কোম্পানি ও সরকারি খাতের সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ঋণ নিতে হচ্ছে।

এ খাত থেকে চলতি অর্থবছরে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এই ৫ মাসেই নেওয়া হয়েছে ২৩ হাজার কোটি টাকা। যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ৯৮ শতাংশ। ফলে এ খাত থেকে সরকারকে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি ঋণ গ্রহণ করতে হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

তারল্য সংকটের কারণে ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ব্যাংক থেকে ঋণ পাচ্ছে না। অন্যদিকে নন-ব্যাংক খাতের ওপর মাত্রাতিরিক্ত চাপ। এছাড়া নন-ব্যাংক ঋণের সুদের হারও বেশি। এতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এসব মিলে সরকারের ঋণ গ্রহণের খাতে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

এর মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং নন-ব্যাংক খাত থেকে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এ খাতের মধ্যে শুধু সঞ্চয়পত্র থেকে নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। প্রায় ৬৬ শতাংশই সঞ্চয়পত্র থেকে নেওয়ার কথা।

চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাত থেকে নেওয়া হয়েছে ২২ হাজার ২৯০ কোটি টাকা। যা এ খাতের লক্ষ্যমাত্রার ১৬ দশমিক ২১ শতাংশ। এসব নতুন ঋণ নিয়ে সরকার আগের নেওয়া ঋণ থেকে ৩ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে।

গত অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে সরকার ব্যাংক খাত থেকে চার গুণের বেশি ঋণ গ্রহণ করেছে। গত অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছিল সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা।

এদিকে চলতি অর্থবছরের এখন পর্যন্ত নতুন সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা কমেছে। আওয়ামী লীগ সরকার জুলাইয়ে ১ হাজার ৩০০ কোটি ছাপানো টাকায় ঋণ নিয়েছিল। ফলে জুলাইয়ে ছাপানো টাকায় ঋণের স্থিতি ছিল ১ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকা।

নতুন সরকার ছাপানো টাকায় এখন পর্যন্ত কোনো ঋণ গ্রহণ করেনি। তারা বরং ১ জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ছাপানো টাকায় আগের সরকারের সময়ে নেওয়া ঋণের মধ্যে ৪২ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে পরিশোধ করা হয়েছিল ২৭ হাজার কেটি টাকা। ফলে ছাপানো টাকার স্থিতি কমেছে।

তবে ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট কমাতে টাকা ছাপিয়ে ছয়টি ব্যাংকে ২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ধার দিয়েছে। এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব উৎস থেকে দেওয়া হয়েছে। সরকারের ঋণ খাতে এ অর্থ নেওয়া হয়নি।

চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে নন-ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ বেড়ে ২৩ হাজার কোটি টাকায় ছাড়িয়েছে। যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ৯৮ শতাংশ ঋণ নেওয়া হয়েছে ৫ মাসেই। গত অর্থবছরের একই সময়ে নেওয়া হয়েছিল ৪ হাজার কোটি টাকা। গত অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে নন-ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ বেড়েছে পৌনে ছয় গুণ বেশি।

এর মধ্যে সঞ্চয়পত্র থেকে জুলাই থেকে অক্টোবর সময়ে গ্রস ঋণ নেওয়া হয়েছে ২১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে নিট ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে গ্রস ঋণ ২৯ হাজার কোটি টাকা হলেও নতুন কোনো নিট ঋণ নেয়নি। বরং গ্রস ঋণের চেয়ে ২ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা বেশি পরিশোধ করেছে। এর বাইরে ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, ট্রেজারি বন্ডের মাধ্যমে ১১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, অন্যান্য দেশে সরকারের ঋণ গ্রহণের জন্য নন-ব্যাংক খাত বড় ভ‚মিকা পালন করলেও বাংলাদেশে এ খাতের বিকাশ হচ্ছে কম। এর মধ্যে সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেট এখনো সক্রিয় করা সম্ভব হয়নি। প্রাইমারি বন্ড মার্কেটে শুধু ব্যাংক, ফাইন্যান্স কোম্পানি ও বিমা কোম্পানিগুলো অংশগ্রহণ করছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই বিনিয়োগ করছে ব্যাংকগুলো।

ফাইন্যান্স কোম্পানি ও বিমা কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ খুবই কম। সুযোগ থাকলেও করপোরেট প্রতিষ্ঠান বা সাধারণ সঞ্চয়কারীরা এতে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছে না। ফলে এ খাত থেকে সরকারের বড় অঙ্কের ঋণের জোগান আসছে না। শুধু সরকারি খাতের সঞ্চয়পত্রগুলোতেই সাধারণ সঞ্চয়কারীরা বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন।

তারা বিল বা বন্ডে বিনিয়োগ করছেন না। অথচ আইএমএফ বারবার বলে আসছে, সরকারের ঋণ গ্রহণে ব্যাংক খাতের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নন-ব্যাংক খাত বিশেষ করে ট্রেজারি বিল ও বন্ড বিক্রি করে ঋণ নেওয়ার জন্য। সঞ্চয়পত্র থেকেও ঋণ নিতে তারা নিরুৎসাহিত করছে। কিন্তু সরকার ট্রেজারি ও বন্ডে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের টানতে পারছে না।

এদিকে নন-ব্যাংক খাতের সব উপকরণেরই সুদের হার বেশি। এর মধ্যে সঞ্চয়পত্রে সুদের হার ১০ থেকে ১২ শতাংশ। সরকারের ৩ মাস থেকে এক বছর মেয়াদি তিনটি ট্রেজারি বিল রয়েছে। এগুলোতে সুদের হার ১১ দশমিক ৭৩ শতাংশ থেকে ১১ দশমকি ৯৮ শতাংশ।

২ বছর থেকে ২০ বছর মেয়াদি ৫ ধরনের ট্রেজারি বন্ড রয়েছে। এগুলোর সুদের হার ১২ দশমিক ২৭ শতাংশ থেকে ১২ দশমিক ৭১ শতাংশ। ফলে ট্রেজারি বন্ডে সঞ্চয় করলেই বেশি মুনাফা পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু তারপরও এতে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না সাধারণ সঞ্চয়কারীরা। অথচ ভালো ব্যাংকগুলো এখন ৯ শতাংশের বেশি মুনাফা দিচ্ছে না।

সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে ব্যাপক লুটপাটের কারণে এ খাতটি এখন দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে বেশকিছু ব্যাংক গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্যারান্টিতে কয়েকটি সবল ব্যাংক দুর্বল ব্যাংককে টাকা ধার দিয়েছে। কলমানি মার্কেটেও লেনদেন কম হচ্ছে। বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমে গেছে। এ কারণে সরকার ব্যাংক খাত থেকে চাহিদা অণুযায়ী ঋণ গ্রহণ করতে পারছে না।

অথচ আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে ঋণের জোগান দিতে কোনো কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংকের ওপর ট্রেজারি বিল বা বন্ড কেনার বিষয়টি চাপিয়ে দিত। যেটি এখন হচ্ছে না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ব্যাংকগুলোতে অতিরিক্ত তারল্য কমে গেছে। গত বছরের জুনে ব্যাংকগুলোতে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ১ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে তা ১ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকায় নেমে গিয়েছিল। অক্টোবরে কিছুটা বেড়ে ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ২০২৩ সালের জুনে তা ২ লাখ কোটি টাকার বেশি ছিল। ওই বছরের সেপ্টেম্বর থেকেই অতিরিক্ত তারল্য কমে ২ লাখ কোটি টাকার নিচে নেমে আসে।

জুনে ব্যাংকগুলোতে তারল্য ছিল ৪ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা। অক্টোবরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকায়। আলোচ্য সময়ে তারল্য কমেছে ৫ হাজার কোটি টাকা। যে কারণে সরকারকে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে চাহিদা অনুযায়ী ঋণের জোগান দিতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এদিকে সরকারের রাজস্ব আয় কমে যাওয়ায় সরকারের ঋণের চাহিদাও বেড়েছে। গত অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে সরকারের রাজস্ব আহরণ বেড়েছিল ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে রাজস্ব আয় বাড়েনি। বরং কমেছে ১ দশমিক ০৩ শতাংশ। অথচ সরকারের খরচ বেড়েছে। রাজস্ব আয় কমায় সরকার কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি অনুসরণ করছে। উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়ন কমিয়ে দিয়েছে। তারপরও সরকারের ঋণ গ্রহণ কমছে না। কারণ রাজস্ব আয় কমায় চলতি ব্যয় মেটাতে হচ্ছে ঋণ করে। সূত্র: দৈনিক যুগান্তর

Related Articles

Back to top button