হাঁটার পরিবেশ সবচেয়ে খারাপ মতিঝিলে
অনলাইন ডেস্ক: একটা সময় ঢাকার বাণিজ্যিক কেন্দ্র ছিল মতিঝিল। ধীরে ধীরে গুলশান, বনানী, কারওয়ান বাজারসহ আরো কয়েকটি এলাকায় সম্প্রসারণ হয়েছে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড। তবে ব্যবসা সম্প্রসারণ হলেও বাড়েনি নাগরিক সেবার মান।
একটা সময় ঢাকার বাণিজ্যিক কেন্দ্র ছিল মতিঝিল। ধীরে ধীরে গুলশান, বনানী, কারওয়ান বাজারসহ আরো কয়েকটি এলাকায় সম্প্রসারণ হয়েছে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড। তবে ব্যবসা সম্প্রসারণ হলেও বাড়েনি নাগরিক সেবার মান।
সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীর পাঁচটি বাণিজ্যিক এলাকার মধ্যে নাগরিকদের হাঁটার পরিবেশ সবচেয়ে খারাপ মতিঝিলে। গবেষণাটি করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষক ফাইরুজ আনিকা খান ও নওশিন তাবাসসুম। অন্য এলাকাগুলো হলো গুলশান-বনানী, মহাখালী, কারওয়ান বাজার ও মিরপুর। মতিঝিলের পর হাঁটার পরিবেশ সবচেয়ে খারাপ যথাক্রমে গুলশান-বনানী, মহাখালী, কারওয়ান বাজার ও মিরপুরের। এর মধ্যে তুলনামূলক ভালো অবস্থান মিরপুরের।
গবেষকরা দাবি করছেন, ঢাকার বাণিজ্যিক এলাকার ভূমি ব্যবহার, জনঘনত্ব, রাস্তার সংযোগ সুবিধা, ফুটপাত সুবিধা, ফুটপাতের মান, ফুটপাতে হাঁটার সুবিধা, ফুটপাতে প্রবেশের সুবিধা, ফুটপাতে চলাচলে সুরক্ষা ও নিরাপত্তা, পথচারীবান্ধব ও স্বস্তিদায়ক ফুটপাত—এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণা হয়নি। এ গবেষণায় হাঁটার সুবিধার বিষয়টি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে ট্রাফিকের চাপ, বায়ুদূষণ এবং অফিস সময়ে মানুষজনের সমাগমের বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।
রাজধানীর বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) ২০২২-২০৩৫ সূত্র উল্লেখ করে গবেষণায় বলা হয়েছে, ছয়টি এলাকার মধ্যে মতিঝিলে সড়ক রয়েছে ১০৫ কিলোমিটার। বিপরীতে এখানে ফুটপাত রয়েছে ৪১ কিলোমিটার। গুলশান-বনানীতে সড়ক রয়েছে ৮৭ কিলোমিটার, ফুটপাত ৭৩ কিলোমিটার, মহাখালীতে সড়ক রয়েছে ৩৯ কিলোমিটার, ফুটপাত ৫ কিলোমিটার, কারওয়ান বাজারে সড়ক ছয় কিলোমিটার, ফুটপাত এক কিলোমিটার এবং মিরপুরে সড়ক ৩৫২ কিলোমিটার এবং ফুটপাত ৪৪ কিলোমিটার।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পাঁচটি ওয়ার্ড নিয়ে মতিঝিল এলাকা গঠিত। এখানে দেশের সুপ্রতিষ্ঠিত বড় বড় কোম্পানির বাণিজ্যিক কার্যালয় রয়েছে। রয়েছে ব্যাংক, বীমা ও সরকারের নানা গুরুত্বপূর্ণ অফিস। সম্প্রতি এখানে স্থাপন করা হয়েছে মেট্রো স্টেশনও। মতিঝিলে রাস্তার পরিমাণ ১০৫ কিলোমিটার। আর এখানে হাঁটার রাস্তা রয়েছে মাত্র ৪১ কিলোমিটার, যার প্রায় পুরোটাই হকারদের দখলে।
নগরবিদরা বলছেন, মতিঝিলের নকশা করা হয়েছিল পথচারীবান্ধব হিসেবেই। এখানে হকারদের জন্য কোনো জায়গা রাখা হয়নি। ঢাকার অন্যান্য বাণিজ্যিক এলাকায় হকারদের জন্য জায়গা রাখা হয়েছে। কিন্তু মতিঝিল পুরোটাই বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে ডিজাইন করা হয়েছে। এখানে মিশ্র ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। ফলে দেখা যায়, সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত মতিঝিল এলাকা সরব থাকলেও এরপর এলাকাটি ভুতুড়ে এলাকায় পরিণত হয়। তবে বিশ্বের নতুন শহরগুলো এখন মিশ্র ব্যবহারের দিকেই এগোচ্ছে।
মতিঝিলে হাঁটার পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে। তবে সবই ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ী আর হকারের দখলে চলে গেছে। নানা কারণেই জৌলুশ হারানো মতিঝিলের নতুন করে ডিজাইন করার সময় এসেছে বলে মন্তব্য করেছেন রাজধানীর ড্যাপ ২০২২-২০৩৫-এর প্রকল্প পরিচালক ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) নগর গবেষক মো. আশরাফুল ইসলাম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘মতিঝিলে অনেক অফিস-আদালত রয়েছে। এখানে অসংখ্য মানুষের সমাগম হয়। ফলে হকাররা এখানে পসরা সাজিয়ে বসে। মানুষ অফিস করেই হাতের নাগালে ফল থেকে শুরু করে সব ধরনের পণ্য হকারদের কাছে পেয়ে যাচ্ছে। চাহিদা আছে বলেই হকারদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এতে কমছে হাঁটার সুবিধা। হকারদের উচ্ছেদ করে সমস্যার সমাধান হবে না। তাদের টাইম বেঁধে দেয়া যেতে পারে। বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত হকারদের বিক্রির সময়। রাজউক থেকে আমরা একটা প্ল্যানিং করছি কীভাবে মতিঝিলকে আরো চাপমুক্ত করার পাশাপাশি জনবান্ধব-পথচারীবান্ধব এলাকা করা যায়। প্রাথমিকভাবে ছোট ছোট পার্ক করার মাধ্যমে বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের কথা ভাবছি। চূড়ান্ত পরিকল্পনা শেষে একটা ভালো ডিজাইন উঠে আসবে।’
গবেষকরা বলছেন, ভূমি ব্যবহার, জনঘনত্ব, রাস্তার সংযোগ সুবিধা, ফুটপাত সুবিধা, ফুটপাতের মান, ফুটপাতে হাঁটার সুবিধা বিবেচনায় মতিঝিলের তুলনায় মিরপুরের অবস্থা ভালো। এটার সম্ভাব্য কারণ হতে পারে, মতিঝিলের অনেক পরে মিরপুর ঢাকা সিটির অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আর মতিঝিল যেভাবে বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে ডিজাইন হয়েছে মিরপুর সেভাবে হয়নি। মিরপুর মূলত আবাসিক এলাকা হিসেবেই ডিজাইন হয়েছে। ফলে এখানে পথচারীদের কথা যেমন মাথায় রাখা হয়েছে, একইভাবে হকারদের কথাও ভাবানায় রাখা হয়েছে। মতিঝিলের ক্ষেত্রে সেটা হয়নি।
মতিঝিল এলাকার ফুটপাতগুলো এখন পথচারীদের জন্য নয়, বরং সেগুলো এখন হকার আর সিটি করপোরেশনের পার্কিং স্পেসে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘উন্নত বিশ্বে সিবিডি এলাকায় মানুষকে ফুটপাতে হাঁটতে বাধ্য করা হয়। ব্যক্তিগত গাড়ি যেন সিবিডি এরিয়ায় না ঢোকে সে ব্যবস্থাও রয়েছে। কিন্তু ঢাকার দৃশ্যপট পুরোপুরি ভিন্ন। মতিঝিল কিংবা অন্যান্য বাণিজ্যক এলাকাগুলোর ফুটপাত হকারের দখলে। আর কিছু কিছু জায়গায় সিটি করপোরেশন নিজে পার্কিংয়ের জন্য ফুটপাত ইজারা দিয়ে রেখেছে। করপোরেশনের গুরুত্ব দেয়ার কথা ছিল জনগণ কীভাবে হাঁটার উন্নত পরিবেশ পাবে সেদিকে, কিন্তু তা না করে সংস্থাটি ব্যবসাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। ফলে মানুষের হাঁটার বিষয়টি সিটি করপোরেশনের কাছেও গুরুত্বের বাইরে চলে গেছে।’